1. tasermahmud@gmail.com : admi2017 :
  2. akazadjm@gmail.com : Taser Khan : Taser Khan
মঙ্গলবার, ২১ জানুয়ারী ২০২৫, ০৩:৪৮ অপরাহ্ন

লুটপাটে মূলধন তলানিতে, চলছেও খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে

‍ইউএস বাংলাদেশ ডেস্ক :
  • আপডেট টাইম : মঙ্গলবার, ২১ জানুয়ারী, ২০২৫

ব্যাংকের আর্থিক ভিত্তি বোঝা যায় সেটার মূলধন কাঠামো থেকে। যে ব্যাংকের মূলধন কাঠামো যত ভাল, সেই ব্যাংকের আর্থিক ভিত্তিও তত শক্তিশালী। এই সূচকেও সবচেয়ে তলানিতে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, গত জুন পর্যন্ত এই চারটি ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে সাড়ে ৫১ হাজার কোটি টাকা। যদিও প্রকৃত ঘাটতির পরিমাণ প্রায় ৯০ হাজার কোটি টাকা। মূলত স্বাস্থ্য কিছুটা ভাল দেখাতে প্রভিশন সংরক্ষণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বড় ধরনের ডেফারেল সুবিধা নিয়ে মূলধন ঘাটতির প্রকৃত চিত্র আড়াল করে রাখা হয়েছে। তারপরও এই চারটি ব্যাংকের তিনটিরই ঝুঁকিভিত্তিক মূলধন পর্যাপ্ততার অনুপাত ঋণাত্মক ধারায় নেমেছে। অন্যটির ইতিবাচক ধারায় থাকলেও তা গ্রহণযোগ্য সীমার অনেক নিচে। মূলত নানা অনিয়ম, দুর্নীতি আর লুটপাটে মূলধন খুইয়ে বছরের পর বছর বড় ধরনের ঘাটতি নিয়ে চলছে ব্যাংকগুলো।

সংশ্লিষ্টরা জানান, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ব্যাংক খাতে যতগুলো বড় ঋণ কেলেঙ্কারি ঘটেছে, সেগুলোর বেশিরভাগ হয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতেই। হলমার্ক, বিসমিল্লাহ, ক্রিসেন্ট, অ্যাননটেক্সের সঙ্গে সর্বশেষ যোগ হয়েছে বিতর্কিত এস আলম ও বেক্সিমকোর ঋণ লোপাটের ঘটনা। এসব ঘটনায় নামে-বেনামে ব্যাংকগুলো থেকে বড় অঙ্কের টাকা বের করে নেওয়া হয়েছে।

শুধু তাই নয়, সেই টাকার বড় একটা অংশ বিদেশে পাচার করা হয়েছে। এতে ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ লাগামহীনভাবে বাড়ছে। এতে ব্যাংকগুলোর ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের পরিমাণ দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। ফলে এর বিপরীতে ব্যাংকগুলোর মূলধন সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তাও বেড়েছে। কিন্তু নিয়ম মেনে তা সংরক্ষণ করতে পারছে না, ফলে বাড়ছে ঘাটতি। সূত্র জানায়, জনগণের করের টাকায় বাজেট বরাদ্দ থেকে ব্যাংকগুলোকে মূলধন দিয়ে সহায়তা করা হলে সমালোচনার মুখে ২০১৯-২০ অর্থবছর থেকে তা বন্ধ রাখা হয়েছে। এরপর মূলধন পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে শুরু করলে সরকারের পরামর্শে ডেফারেল সুবিধা দেওয়া শুরু করে বাংলাদেশ ব্যাংক।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, মূলধন মাইনাস মানে ব্যাংকগুলোতে মালিকপক্ষের কিছুই নেই। তবে সরকার মালিক হওয়ায় এটা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলে না। এ কারণে সরকারের পরামর্শে ডেফারেল সুবিধা দিয়ে তাদের ঘাটতি সহনীয় পর্যায়ে রাখা হয়, যাতে আর্থিক স্বাস্থ্য কিছুটা হলেও ভাল দেখাতে পারে। ব্যাংকগুলোর স্বার্থেই এই সুবিধা দিয়ে আসছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

সম্প্রতি সমঝোতা স্মারকের (এমওইউ) আওতায় বিভিন্ন শর্ত পরিপালনের অগ্রগতি নিয়ে ব্যাংকগুলোর সঙ্গে পৃথক বৈঠক করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর। বৈঠকে ব্যাংকগুলোকে আগামীতে আর ডেফারেল সুবিধা না দেওয়ার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, যদি অগ্রগতি না হয়, তাহলে বারবার এ ধরনের সহায়তা দেওয়ার মানে নেই। আগামীতে প্রকৃত অগ্রগতি কীভাবে হবে সেই পরিকল্পনা নেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি। সংশ্লিষ্টদের আশঙ্কা, চলমান ডেফারেল সুবিধা বন্ধ করে দেওয়া হলে ব্যাংকগুলোর ক্যামেলস রেটিংসে আরও অবনতিসহ সার্বিক ব্যবসায় নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে ব্যাংকগুলোর মূলধন ভিত্তি শক্তিশালী করার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংককে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের পরামর্শ দেন তারা।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে দুই ধরনের বড় সমস্যা রয়েছে। এগুলো হলো মূলধন ঘাটতি ও খেলাপি ঋণ। খেলাপি ঋণ বেশি হওয়ার কারণেই তাদের মূলধন ঘাটতিও বেশি। তবে মূলধন ঘাটতি পূরণে লাগাতার ডেফারেল সুবিধা দেওয়া মোটেও ঠিক হচ্ছে না। বরং তাদের মূলধন ঘাটতি পূরণে বাস্তবভিত্তিক কার্যকর পরিকল্পনা নিতে হবে। খেলাপি ঋণ আদায়ে জোর দিতে হবে।

সাধারণত কোনো ব্যাংক মূলধন ঘাটতিতে থাকলে তার আর্থিক ভিত্তির দুর্বলতা প্রকাশ পায়। ফলে ওই ব্যাংকের ওপর গ্রাহক তথা আমানতকারীদের আস্থা কমে যায়। বৈদেশিক লেনদেনেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। কারণ বিদেশি ব্যাংকগুলো প্রয়োজনীয় মূলধন রাখতে ব্যর্থ হওয়া ব্যাংকগুলোর সঙ্গে ঋণপত্র খুলতে চায় না। তখন এসব ব্যাংককে আমদানি নিষ্পত্তি করার জন্য বিদেশি ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে গ্যারান্টি নিতে হয়। এই গ্যারান্টি নিতে অতিরিক্ত ফি গুনতে হয়। আবার মূলধন সংকটে থাকা ব্যাংকগুলো লভ্যাংশ ঘোষণা করতে পারে না। ফলে বিনিয়োগকারীরা বঞ্চিত হন।

দেশের ব্যাংক খাতে মূলধন সংরক্ষণের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ব্যাসেল-৩ নীতিমালা অনুসরণ করা হয়। ওই নীতিমালা অনুযায়ী বর্তমানে তফসিলি ব্যাংকগুলোর কার্যক্রম চালানোর জন্য ন্যূনতম রক্ষিতব্য মূলধন (এমসিআর) ও ক্যাপিটাল কনজারভেশন বাফার (সিসিবি) থাকতে হবে তাদের মোট ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের ১০ শতাংশ ও আড়াই শতাংশ হারে। সেই সঙ্গে মূলধন ও দায়ের মধ্যে যথাযথ ভারসাম্য রক্ষায় ঝুঁকিভিত্তিক মূলধন পর্যাপ্ততার পাশাপাশি ব্যাংকগুলোকে ২০১৫ সাল থেকে ন্যূনতম ৩ শতাংশ লিভারেজ অনুপাত (এলআর) সংরক্ষণ করার নির্দেশনা প্রদান করা হয়, যা ২০২৩ সাল থেকে বাৎসরিক দশমিক ২৫ শতাংশ হারে ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধিপূর্বক ২০২৬ সালে ৪ শতাংশে উন্নীত করার নির্দেশনা রয়েছে। সে অনুযায়ী ২০২৪ সালের জন্য তফসিলি ব্যাংকগুলোকে লিভারেজ অনুপাত ন্যূনতম সাড়ে ৩ শতাংশ হারে সংরক্ষণ করার নির্দেশনা দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কিন্তু এসব নিয়ম মেনে এই চার ব্যাংকের কোনোটিই মূলধন সংরক্ষণ করতে পারছে না।

এমওইউর পর্যালোচনায় প্রতিবেদন বলছে, ডেফারেল সুবিধা নেওয়ার পরও গত জুন পর্যন্ত রাষ্ট্রায়ত্ত এই চার ব্যাংকের মূলধন ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়ায় ৫১ হাজার ৬৮৭ কোটি টাকা। ডেফারেল সুবিধাসহ এই ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৮৯ হাজার ৯৫৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ ব্যাংকগুলোর স্বাস্থ্য ভাল দেখাতে ব্যাংকগুলোকে ৩৮ হাজার ২৬৮ কোটি টাকার মূলধন ঘাটতি আর্থিক প্রতিবেদনে দেখানো থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ আমাদের সময়কে বলেন, আমিও মনে করি, কার কত মূলধন ঘাটতি রয়েছে তার প্রকৃত চিত্রই প্রতিফলিত হওয়া উচিত। কারণ এটা দেখতে পেলে পরিকল্পনা করাও সহজ হয়। আমি ২০০৪ সালে যখন এই ব্যাংকের এমডির দায়িত্বে ছিলাম, তখন ৫০০ কোটি টাকার মতো মূলধন ঘাটতি ছিল। এই ঘাটতি পূরণে তখন সরকার থেকে টাকা নিইনি। তারপরও সে সময় ঘাটতি পূরণ করেছিলাম, এটাই প্রকৃত পরীক্ষা। কিন্তু এখন বড় ঘাটতিতে ব্যাংক। সরকারের সহায়তা ছাড়া কীভাবে পূরণ সম্ভব- এ প্রশ্নে তিনি বলেন, আমাদের অ্যাসেটতো আছেই, যেটা খেলাপি হয়ে আটকে আছে। এখন এই ঋণগুলো কীভাবে আদায় করা যায় সেই পরিকল্পনা নিয়ে আমরা এগোচ্ছি। যদি নিয়ম মেনে এগুলো পুনঃতফসিল ও পুনর্গঠন করে দিতে পারি, তাহলে যাকে আমরা নন-পারফরমিং ঋণ বলছি সেটা পারফরমিং হবে। তখন ঋণ যেমন ফেরত আসবে, তেমনি এর সুদও আয় খাতে নিতে পারব। কিন্তু খেলাপির খাতায় থাকলে কিছুই করতে পারব না, উল্টো মূলধনের ওপর চাপ তৈরি হবে।

কোন ব্যাংকে কত ঘাটতি: রাষ্ট্রায়ত্ত এই চার ব্যাংকের মধ্যে সর্বোচ্চ মূলধন ঘাটতি রয়েছে জনতা ব্যাংকের। গত জুন পর্যন্ত ডেফারেল সুবিধাসহ ব্যাংকটির মূলধন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৪৬ হাজার ৩৫৮ কোটি টাকা। মূলধন ঘাটতির দিক থেকে দ্বিতীয় অবস্থানে অগ্রণী ব্যাংক। ডেফারেল সুবিধাসহ ব্যাংকটির ঘাটতি রয়েছে ২৬ হাজার ৫৬৩ কোটি টাকা। তৃতীয় অবস্থানে থাকা রূপালী ব্যাংকের ডেফারেলসহ ঘাটতির পরিমাণ ১১ হাজার ৩০২ কোটি টাকা। আর সোনালী ব্যাংকের ডেফারেলসহ ঘাটতি ছিল ৫ হাজার ৭৩২ কোটি টাকা।

তিনটির মূলধন পর্যাপ্ততার হার ঋণাত্মক, অন্যটিরও গ্রহণযোগ্য সীমার নিচে: মূলধন পর্যাপ্ততার হারে সবচেয়ে বেশি ঋণাত্মক জনতা ব্যাংকের। গত জুন পর্যন্ত হিসাবে এই ব্যাংকের সিআরএআর ঋণাত্মক হয় ১৪.৫৮ শতাংশ, যা সেপ্টেম্বরে আরও অবনতি হয়ে দাঁড়িয়েছে ঋণাত্মক ৩২.২৬ শতাংশ। অগ্রণী ব্যাংকের সিআরএআর গত জুনে ছিল ঋণাত্মক ৮.৯৪ শতাংশ, জুনে আরও অবনতি হয়ে দাঁড়িয়েছে ঋণাত্মক ১০.৯১ শতাংশ। রূপালী ব্যাংকের সিআরএআর জুনে ছিল ঋণাত্মক ৪.১৯ শতাংশ, যা সেপ্টেম্বরে আরও অবনতি হয়ে দাঁড়ায় ঋণাত্মক ৪.৩৮ শতাংশ। তবে সোনালী ব্যাংকের সিআরএআর ইতিবাচক ধারায় রয়েছে। গত জুনে ব্যাংকটির সিআরএআর ছিল ৬.৩৭ শতাশ, তবে সেপ্টেম্বরে অবনতি হয়ে দাঁড়িয়েছে ৫.৫৪ শতাংশ। এই হার ব্যাংক খাতে নির্ধারিত ১০ শতাংশের চেয়ে অনেক কম। জানা যায়, কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে গত আগস্ট মাসে ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি পূরণের কর্মপরিকল্পনা চাওয়া হয়েছিল। সে সময় ব্যাংকগুলোর দাখিল করা কর্মপরিকল্পনায় পর্যালোচনা করে বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছিল, ব্যাংকগুলো সমস্যা উত্তরণের জন্য যেসব কর্মপরিকল্পনা দাখিল করেছে তা স্বল্প কিংবা মধ্য মেয়াদি সময়ের জন্য সহায়ক নয়।

মূলধন ঘাটতির নেপথ্যে খেলাপি ঋণের লাগামহীন বৃদ্ধি: এই ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতির নেপথ্যে রয়েছে খেলাপি ঋণের লাগামহীন বৃদ্ধি। কারণ প্রত্যেকটি ব্যাংকের তাদের ঋণের শ্রেণিমান বিবেচনায় নিরাপত্তা সঞ্চিতি বা প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। এক্ষেত্রে খেলাপি ঋণের বিপরীতে ২০ থেকে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত প্রভিশন সংরক্ষণের নিয়ম রয়েছে। আর নিয়মিত ঋণের বিপরীতে তা ৫ শতাংশ। ফলে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ যত বাড়ে, প্রভিশন সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা তত বেড়ে যায়। আর প্রভিশন রাখতে না পারলে স্বাভাবিকভাবে মূলধন ঘাটতি বাড়ে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত বছর সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ১ লাখ ১৬ হাজার ৫৯৭ কোটি টাকা। এটি পুরো ব্যাংক খাতে মোট খেলাপি ঋণের প্রায় ৪১ শতাংশ।

নিউজটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019-2023 usbangladesh24.com