যুক্তরাজ্যের রাজধানী লন্ডনে দেশটির ক্ষমতাসীন লেবার পার্টির মন্ত্রী টিউলিপ সিদ্দিকি একটি ফ্ল্যাট উপহার পাওয়া নিয়ে মিথ্যাচার করেন। এ ঘটনায় টিউলিপ সিদ্দিকের ওপর পদত্যাগের চাপ জোরালো হয়েছে।
বহুল আলোচিত এই কেলেঙ্কারির ঘটনায় তিনি মন্ত্রিত্ব হারানোর ঝুঁকিতে পড়েছেন বলে রোববার ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ডেইলি মেইলের এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, টিউলিপ সিদ্দিককে একাধিকবার প্রশ্ন করা হয়েছে, ৭ লাখ পাউন্ডের মূল্যমানের দুই শয্যাকক্ষের ফ্ল্যাটটি তাকে উপহার দেয়া হয়েছে কিনা। তবে তিনি প্রথমে এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন এবং দাবি করেছেন যে তার বাবা-মা তাকে এই ফ্ল্যাট কিনে দিয়েছেন। এরপর, দ্য মেইল অন সানডে পত্রিকার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়ার হুমকিও দেন তিনি।
তবে, লেবার পার্টির একাধিক সূত্র জানিয়েছে, ফ্ল্যাটটি আসলে এক ডেভেলপার ‘কৃতজ্ঞতাস্বরূপ’ তাকে উপহার দিয়েছেন। ফ্ল্যাটটির মালিক ছিলেন বাংলাদেশী ডেভেলপার আব্দুল মোতালিফ। যিনি ২০০১ সালে এই ফ্ল্যাট কিনেছিলেন এবং পরে টিউলিপ সিদ্দিককে এটি হস্তান্তর করেন।
এই ঘটনার পর, ব্রিটেনের কয়েকজন এমপি টিউলিপ সিদ্দিককে তার সম্পত্তির বিষয়ে স্পষ্ট ব্যাখ্যা দিতে বলছেন। টরি এমপি বব ব্ল্যাকম্যান এবং ম্যাট ভিকার্সসহ অন্যান্যরা দাবি করেছেন, যদি টিউলিপ সিদ্দিক তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ পরিষ্কার না করেন। তবে তার মন্ত্রিত্ব অব্যাহত রাখা সম্ভব হবে না।
শনিবার রাতে ব্রিটেনের টরি এমপিরা দাবি জানিয়ে বলেন, টিউলিপ সিদ্দিক যদি তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে না পারেন, তাহলে তার মন্ত্রীর পদ থেকে সরে দাঁড়ানো উচিত।
লন্ডনের হ্যারো ইস্টের টরি এমপি বব ব্ল্যাকম্যান বলেন, টিউলিপ সিদ্দিককে তার সম্পত্তির বিষয়ে অবস্থান স্পষ্ট এবং ব্যাখ্যা করতে হবে, আসলে তিনি কী বলেছিলেন এবং কেন।
টিউলিপ বর্তমানে যুক্তরাজ্যের অর্থ মন্ত্রণালয়ের (ট্রেজারি) অর্থনীতিবিষয়ক মিনিস্টার (ইকোনমিক সেক্রেটারি) হিসেবে কর্মরত আছেন। মন্ত্রী হিসেবে তার কাজ হলো দেশটির আর্থিক খাতের অপরাধ-দুর্নীতি বন্ধ করা। বাংলাদেশের সদ্য ক্ষমতাচ্যুত স্বৈরাচারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বোন শেখ রেহানার মেয়ে তিনি।
বাংলাদেশে তিনি ও তার পরিবারের চার সদস্যের বিরুদ্ধে একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ৩ দশমিক ৯ বিলিয়ন পাউন্ড আত্মসাতের অভিযোগের তদন্ত চলছে।
এদিকে লন্ডনে টিউলিপ সিদ্দিকের (৪২) বোনকে দেয়া একটি বিনা মূল্যের ফ্ল্যাটের সন্ধান পাওয়া গেছে। শনিবার (৪ জানুয়ারি) যুক্তরাজ্যের সংবাদমাধ্যম দ্য সানডে টাইমস-এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানানো হয়েছে।
দ্য সানডে টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়, টিউলিপের পরিবার উত্তর লন্ডনের হ্যাম্পস্টেডের একটি ফ্ল্যাটে বসবাস করতেন। হ্যাম্পস্টেডের ফিঞ্চলে রোডের এই ফ্ল্যাটটি টিউলিপের বোন আজমিনাকে বিনা মূল্যে দিয়েছিলেন তার খালা শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ মিত্র বাংলাদেশি আইনজীবী মঈন গণি। তিনি শেখ হাসিনার সরকারের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর সাথে তার ছবি আছে।
যুক্তরাজ্যের ভূমি নিবন্ধনসংক্রান্ত নথিপত্রে বলা হয়েছে, অর্থ বা আর্থিকমূল্য রয়েছে, এমন কিছু ছাড়াই ফ্ল্যাটটি আজমিনাকে দেয়া হয়েছে। ফ্ল্যাট হস্তান্তরের সময় আজমিনার বয়স ছিল ১৮ বছর। তখন তিনি অক্সফোর্ডে পড়াশোনা শুরু করতে যাচ্ছিলেন।
টিউলিপ ঠিক কখন ফ্ল্যাটটিতে উঠেছিলেন, তা স্পষ্ট নয়। তবে ২০১২ সালের ডিসেম্বরে টিউলিপ ওয়ার্কিং মেনস কলেজের পরিচালক হিসেবে নিযুক্ত হওয়ার পর তিনি নথিতে তার ঠিকানা হিসেবে ফ্ল্যাটটি তালিকাভুক্ত করেন।
২০১৪ সালের জানুয়ারিতে ক্যামডেন আর্টস সেন্টারের ট্রাস্টি হওয়ার পর, ২০১৪ সালের মার্চে হ্যাম্পস্টেড ওয়েলস অ্যান্ড ক্যাম্পডেন ট্রাস্টের ট্রাস্টি হওয়ার পরও তিনি একই ঠিকানা ব্যবহার করেন। এছাড়া তার স্বামী ক্রিশ্চিয়ান পার্সি ২০১৬ সালের মে মাস পর্যন্ত এটিকে তার ঠিকানা হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছিলেন। তখন টিউলিপ হ্যাম্পস্টেড ও কিলবার্নের লেবার এমপি ছিলেন।
টিউলিপের বোন আজমিনার টনি ব্লেয়ার’স ইনস্টিটিউট ফর গ্লোবাল চেঞ্জে কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে। তিনি সম্প্রতি শিশুদের একটি দাতব্য প্রতিষ্ঠানে কাজ শুরু করেছেন। তিনি ফ্ল্যাটটি ২০২১ সালে ৬ লাখ ৫০ হাজার পাউন্ডে বিক্রি করে দেন।
উল্লেখ্য, ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে গত বছরের আগস্টে শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতাচ্যুত হয়। এরপর বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার শেখ হাসিনাকে ‘গণহত্যা, হত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের’ অভিযোগে অভিযুক্ত করেছে। এই অভিযোগের মধ্যে অন্তত ৮০০ বিক্ষোভকারীর মৃত্যুর বিষয়টি আছে। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও তহবিল তছরুপের অভিযোগও রয়েছে।
শেখ হাসিনা পরিবারের যেসব সদস্য সুবিধা নিয়েছেন বলে অভিযোগে বলা হচ্ছে, তাদের মধ্যে টিউলিপও রয়েছেন। তবে তিনি কোনো অন্যায়-অনিয়ম করার কথা অস্বীকার করে আসছেন। যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার বলেছেন, টিউলিপের ওপর তার আস্থা রয়েছে।
সূত্র : ডেইলি মেইল ও দ্য সানডে টাইমস
Leave a Reply