দেশজুড়ে গ্যাস পাইপলাইন নেটওয়ার্কের জরাজীর্ণ অবস্থা। শিল্পকারখানায় গ্যাস চুরি, অপব্যবহার, পাইপলাইনে ছিদ্র এবং অদক্ষ মেশিনারিজ ব্যবহারসহ নানা কারণে দেশে ব্যয়বহুল জ¦ালানি গ্যাসের অপচয় হচ্ছে। এই সিস্টেম লসের কারণে রাষ্ট্রের বিপুল পরিমাণ আর্থিক লোকসান হচ্ছে। গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলো চেষ্টা করছে সিস্টেম লস কমিয়ে আনতে, কিন্তু কার্যত সুফল মিলছে না। সিস্টেম লস কোনো মাসে কিছুটা কমলেও আবার দ্রুতই বেড়ে যাচ্ছে।
গত জুলাই-আগস্টে দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার পর অক্টোবরে গ্যাসের সিস্টেম লস বেড়ে গেছে। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, প্রশাসনসহ সব ক্ষেত্রে এক ধরনের অস্থিরতার সুযোগ নিয়ে সুযোগসন্ধানী শিল্প কারখানাগুলোয় গ্যাসের অপব্যবহার বেড়েছে। এতে সিস্টেম লসও বেড়েছে। জ¦ালানি বিভাগ থেকে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা গেছে, গত বছরের অক্টোবর মাসে ছয়টি গ্যাস বিতরণ কোম্পানি তাদের ইনটেক পয়েন্টে মোট গ্যাস গ্রহণ করেছে ২৪৪৩ মিলিয়ন ঘনফুট। সেটা বিক্রি হয়েছে ২১৬৯ দশমিক ২৯ মিলিয়ন ঘনফুট। অর্থাৎ, এক মাসেই প্রায় ২৩৫ দশমিক ৫৬ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের সিস্টেম লস হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এটা অত্যন্ত বেশি।
জ¦ালানি বিভাগ সূত্র জানায়, শুধু অক্টোবের জিটিসিএল পয়েন্ট থেকে ১৯১৮ দশমিক ৫৭ এমএমসিএম ঘনফুট গ্যাস সঞ্চালন করা হয়েছে। সেটা সঞ্চালিত হয়েছে ১৮৭৯ দশমিক ২০ এমএমসিএম গ্যাস। ৩৯ দশমিক ৩৬ এমএমসিএম সিস্টেম লস হয়েছে। শতকরা হিসাবে যা দাঁড়ায় ২ দশমিক ০৫ শতাংশ। আবার তিতাস গ্যাস কোম্পানিতে গ্যাস সরবরাহ করা হয়েছে ১৩০৬ এমএমসিএম, সেটা সঞ্চালিত হয়েছে বিতরণ পয়েন্টে ১১৩৭ দশমিক ২৫ এমএমসিএম। অর্থাৎ, ১৬৯ দশমিক ১৯ এমএমসিএম গ্যাসের অপচয় বা সিস্টেম লস হয়েছে, শতকরা হিসাবে যা ১২ দশমিক ৯৫ শতাংশ। কর্ণফুলী গ্যাস বিতরণ কোম্পানি ইনটেক পয়েন্টে গ্যাস গ্রহণ করেছে ২৫৮ দশমিক ২৮, বিতরণ করেছে ২৪৮ দশমিক ৩৩। লোকসান হয়েছে প্রায় ৯ দশমিক ৯৬ এমএমসিএম। সিস্টেম লস হয়েছে ৩ দশমিক ৮৬ শতাংশ।
জালালাবাদ গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি ইনটেক পয়েস্টে গ্যাস গ্রহণ করেছে ৩৫২ দশমিক ৬০ মিলিয়ন ঘনফুট, বিক্রি করেছে ৩৫১ দশমিক ৩৫১ দশমিক ৩৫ এমএমসিএম। অপারেশনাল অপচয় হয়েছে ১ দশমিক ২৫। সবচেয়ে কম সিস্টেম লস হয়েছে তাদের, শূন্য দশমিক ৩৫ শতাংশ। বাখরাবাদ গ্যাস বিতরণ কোম্পানি ২৪৩ দশমিক ৬৫ এমএমমিএম গ্যাস গ্রহণ করে বিক্রি করেছে ২২৫ দশমিক ১৮। সিস্টেম লস হয়েছে কোম্পানির ৭ দশমিক ৫৮ শতাংশ। পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস বিতরণ কোম্পানি গ্যাস গ্রহণ করেছে ১০৭ দশমিক ২১ মিলিয়ন ঘনফুট, বিক্রি বিবেচনায় কোম্পানির সিস্টেম লস হয়েছে ১ দশমিক ৫৬ শতাংশ। সুন্দরবন গ্যাস কোম্পানি ৯৭ দশমিক ২৭ এমএমসিএম গ্যাস গ্রহণ করে যেটুকু বিক্রি করেছে, তাতে কোম্পানির সিস্টেম লস হয়েছে ১ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ।
জ¦ালানি বিভাগের হিসাবে দেখা যায়, একই বছরের সেপ্টেম্বরে যেখানে গ্যাসের ইনটেক পয়েন্টে ২১৬৭ দশমিক ২৯ এমএমসিএম গ্যাসের বিপরীতে বিক্রি হয়েছে ২০৫৫ দশমিক ৪৩ এমএমসিএম। সেপ্টম্বেরে সবগুলো কোম্পানির গড় সিস্টেম লস ছিল ৫ দশমিক ১৬ শতাংশ। সেখানে অক্টোবরে সিস্টেম লস দাঁড়ায় সবগুলো কোম্পানির গড় ৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ।
এক দশক ধরে প্রচ- গ্যাস সংকটে আছে দেশ। সরকারি-বেসরকারি সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য মতে, দেশে বর্তমানে কমপক্ষে ৫ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের চাহিদা রয়েছে। এর বিপরীতে সর্বসাকুল্যে সরবরাহ করা হয় ২৭০০ থেকে ৩ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট। এর মধ্যে রয়েছে উচ্চমূল্যে বিদেশ থেকে আমদানিকৃত লিকুইড ন্যাচারাল গ্যাসও (এলএনজি)। এমন পরিস্থিতিতে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৪ হাজার ৫৯০ কোটি টাকার গ্যাস ‘সিস্টেম লস’ হয়েছে বলে জানিয়েছে পেট্রোবাংলা, শতকরা হিসাবে যা ৭ দশমিক ৫৬ শতাংশ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রকৃতপক্ষে দেশে সিস্টেম লসের পরিমাণ অনেক বেশি এবং এটি মোটেও সিস্টেম লস নয়। গ্যাসের অপব্যবহার ও চুরিকে সিস্টেম লস বলে চালিয়ে দিচ্ছে বিতরণ কোম্পানিগুলো। এর দায়ভার কোনো না কোনোভাবে সাধারণ গ্রাহকের কাঁধেই পড়ছে। প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গ্যাস সঞ্চালন ও বিতরণের দায়িত্ব গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি অব বাংলাদেশসহ (জিটিসিএল) সাতটি গ্যাস কোম্পানির সিস্টেম লস অনেক বেশি। তবে সবচেয়ে বেশি সিস্টেম লস তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির।
পেট্রোবাংলার একজন জ্যৈষ্ঠ কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, ২০২৩ সালের ১ জানুয়ারি থেকে গ্যাস সঞ্চালন ও বিতরণের বিভিন্ন পয়েন্ট মিটার স্থাপন করা হয়েছে। এসব মিটারের মাধ্যমে সিস্টেম লস বা গ্যাসের বিক্রি নির্ধারণ করা হয়।
অন্যদিকে, ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সিস্টেম লসের এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, পর্যায়ক্রমে সিস্টেম লস বেড়েছে। ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে যেখানে গড় সিস্টেম লস ছিল ৮ দশমিক ৭০ শতাংশ, সেখানে একই বছরের ডিসেম্বরে হয়েছে ৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ। ২০২৩ সালের এপ্রিলে তিতাসের সিস্টেম লস প্রায় ১১ শতাংশ পর্যন্ত হয়েছে। ২০২৪ সালের অক্টোবরে হয়েছে ১২ দশমিক ৯৫ শতাংশ।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শামসুল আলম আমাদের সময়কে বলেন, সিস্টেম লস কত হবে, এর একটা আন্তর্জাতিক হার রয়েছে। একটা শতকরা হিসাব থাকে। কিন্তু আমাদের দেশে সেই মানদ- নেই। গ্যাসের সরবরাহ এবং বিক্রির মধ্যে যে পার্থক্য হয়, এর সবটাই গ্রাহকের ঘাড়ে চাপানো হয়।
Leave a Reply