ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের সমাপ্তি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যান করেছে রাশিয়া। এই পরিকল্পনায় বলা হয়েছিল, ইউক্রেনের ন্যাটো সদস্যপদ ২০ বছরের জন্য স্থগিত রাখা হবে এবং তার বিনিময়ে যুদ্ধবিরতি হবে। তবে রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, ট্রাম্পের এই প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছে রাশিয়া। এখন বিশ্লেষকদের অনেকের আশঙ্কা, মস্কো সম্ভবত নিজের শর্তে এই যুদ্ধ শেষ করতে চাচ্ছে। আলজাজিরার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত নভেম্বর মাসে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ট্রাম্পের বিজয় এবং ইউক্রেনের প্রতি তার বিরূপ মনোভাব, আমেরিকার পক্ষ থেকে কিয়েভে সহায়তা প্রদান নিয়ে তার সমালোচনা, যুদ্ধ শেষ করার প্রতিশ্রুতিএ সবের কারণে ন্যাটো দেশগুলো চিন্তিত ছিল। আর ট্রাম্পও বহুবার বলেছেন, তিনি যেদিন দায়িত্ব নেবেন সেদিন থেকেই ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ করাবেন। অবশ্য আগে কখনো তিনি বলেননি, কী উপায়ে তিনি থামাবেন ওই সংঘাত। এবারও ট্রাম্প তার পরিকল্পনা সম্পর্কে খুব বেশি কিছু প্রকাশ করেননি। সেপ্টেম্বর মাসে এক পডকাস্ট সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘যদি আমি আপনাদের পরিকল্পনা দিই, তবে আমি তা ব্যবহার করতে পারব না, এটি সফল হবে না। অংশবিশেষ হলো এটি একটি চমক।’
ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের রিপোর্টে জানানো হয়েছে, ট্রাম্পের শান্তি পরিকল্পনায় ইউক্রেনের ন্যাটো সদস্যপদ ২০ বছরের জন্য স্থগিত করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এছাড়া, ট্রাম্পের ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স, সেপ্টেম্বর মাসে শোওন রায়ান শোতে বলেছেন যে, রাশিয়া-ইউক্রেন সীমান্তের মধ্যে একটি অসামরিক অঞ্চল বা ডি-মিলিটারাইজড জোন তৈরি করা হবে, যাতে রাশিয়া আবার আক্রমণ না করে।
তবে রুশ প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন বলেছেন, ইউক্রেনের ন্যাটো সদস্যপদ না দেওয়াই যুদ্ধবিরতির জন্য যথেষ্ট নয়। ২৬ ডিসেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি জানান, ট্রাম্পের পরিকল্পনা সম্পর্কে বিস্তারিত জানেন না, তবে ২০২১ সালে জো বাইডেনও ইউক্রেনের সদস্যপদ পেতে ১০ থেকে ১৫ বছর পেছানোর কথা বলেছিলেন।
পুতিন বলেন, আজ, কাল বা ১০ বছর এটা আমাদের জন্য কীই-বা পরিবর্তন আনবে? তিনি বলেন, ইউক্রেনের সদস্যপদ স্থগিত করার প্রস্তাব তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ নয়।
এর পরবর্তী দিন, রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভও ট্রাম্পের প্রস্তাব নাকচ করেন এবং জানান, ইউক্রেনের শান্তিরক্ষায় ব্রিটেন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সেনা মোতায়েনের প্রস্তাবও রাশিয়ার কাছে অগ্রহণযোগ্য।
ল্যাভরভও ট্রাম্পের প্রস্তাবের বিরুদ্ধে মন্তব্য করেন। তিনি জানান, ইউক্রেনের ন্যাটো সদস্যপদ ২০ বছর পিছিয়ে দেওয়ার এবং ইউক্রেনে শান্তিরক্ষা বাহিনী মোতায়েনের প্রস্তাব রাশিয়া মেনে নেবে না।
ইউক্রেনের যুদ্ধবিরতি চুক্তি নিয়ে পুতিন ‘ধাপ্পাবাজি’ করছেন বলে মনে করেন গবেষণা প্রতিষ্ঠান চ্যাথাম হাউজের রাশিয়া অ্যান্ড ইউরেশিয়া প্রোগ্রামের সহযোগী টিমোথি অ্যাশ। অ্যাশ আলজাজিরাকে বলেন, ‘পুতিন আলোচনার আগে সবকিছু প্রত্যাখ্যান করবেন, তবে তার একটি চুক্তি প্রয়োজন কারণ দীর্ঘ সময় ধরে যুদ্ধ চালানো তার পক্ষে সম্ভব নয়, অনেক মানুষ মারা যাচ্ছে।’
তিনি বলেন, যদি ট্রাম্প পুতিনকে এমন একটি চুক্তি দেন, যেখানে রাশিয়া ইউক্রেনের দখল করা অঞ্চলগুলো রাখবে, তবে মস্কো সেটি মেনে নেবে। অবশ্য অ্যাশ বলেন, ট্রাম্প শক্তিশালী অবস্থানে, পুতিন দুর্বল। ট্রাম্প দীর্ঘ যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারবেন কারণ প্রতিরক্ষা সামগ্রী বিক্রির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র লাভ করছে এবং কোনো মার্কিন সেনা নিহত হচ্ছে না। আশা করি, ট্রাম্প এটা বুঝতে পারবেন।
গত ৭ ডিসেম্বর ট্রাম্প, জেলেনস্কি এবং ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁর একটি ত্রিপাক্ষিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠক শেষে ট্রাম্প নিউ ইয়র্ক পোস্টকে জানান, জেলেনস্কি যুদ্ধবিরতি চান।
স্কাই নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জেলেনস্কি বলেন, ‘যদি আমরা যুদ্ধের উত্তপ্ত পর্যায় থামাতে চাই, তাহলে আমাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা ইউক্রেনের অঞ্চলগুলোকে ন্যাটোর ছত্রছায়ায় নিতে হবে। এটি দ্রুত করতে হবে। এরপর, ইউক্রেনের দখলকৃত অঞ্চলগুলো কূটনৈতিকভাবে ফিরে পাওয়া সম্ভব।’
যদিও ন্যাটো সদস্যরা ইউক্রেনকে জোটে যোগ দেওয়ার ক্ষেত্রে ‘অটুট’ পথের নিশ্চয়তা দিলেও, তারা এখনো ইউক্রেনকে অন্তর্ভুক্ত করতে সতর্ক, কারণ ইউক্রেন এখনো রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত।
ন্যাটো চুক্তিতে একটি পারস্পরিক প্রতিরক্ষা ধারা রয়েছে, যার মানে হলো যদি কোনো সদস্যকে আক্রমণ করা হয়, তবে অন্য সব সদস্যকে সেই আক্রমণে যুক্ত হতে হবে। ইউক্রেনের ন্যাটো সদস্যপদ গ্রহণের অর্থ হবে, সব ন্যাটো সদস্যই রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে।
রাশিয়া ন্যাটো সদস্যপদ নিয়ে যে সমঝোতা প্রস্তাব করেছে, সেটা অস্বীকার করেছে। এর ফলে কিয়েভ ও মস্কোর মধ্যে আলোচনা শুরু হওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে। ন্যাটো সদস্যপদ ছিল জেলেনস্কির শান্তি পরিকল্পনার মূল বিষয়।
তবে, অ্যাশের মতে, জেলেনস্কি ন্যাটো সদস্যপদ নিয়ে কিছু সমঝোতা করতে পারেন। কিন্তু, ইউক্রেনের নিরাপত্তা নিয়ে হয়তো তিনি কোনো আপস করতে চাইবেন না।
অ্যাশ বলেন, ‘ইউক্রেনকে নিশ্চিত করতে হবে যে, কোনো চুক্তির অধীনে পুতিন আবার আক্রমণ করতে পারবেন না। অথবা পশ্চিমের কাছ থেকে নিরাপত্তা গ্যারান্টি বা ইউক্রেনকে আত্মরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় সব উপকরণ সরবরাহের আশ্বাস পাওয়া লাগবে।’
Leave a Reply