বাংলাদেশের পাসপোর্টে সৌদি আরবে থাকা ৬৯ হাজার রোহিঙ্গার একটি তালিকা তৈরি করেছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশটি। তাদের পাসপোর্টের মেয়াদ দীর্ঘদিন আগে শেষ হয়ে যাওয়ায় তারা বাংলাদেশকে তাগাদা দিচ্ছে রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট নবায়ন করার জন্য।
গত রোববার বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার সময় সৌদি উপ-স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কেন দেরি হচ্ছে তা জানতে চেয়েছিল।
এরপর বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন, সৌদিতে থাকা ওই ৬৯ হাজার রোহিঙ্গার পাসপোর্ট বাংলাদেশ নবায়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান ঢাকায় একটি সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ‘তারা তো বাংলাদেশী পাসপোর্ট নিয়ে গিয়েছিল। সুতরাং আমরা শুধু তাদের পাসপোর্ট রিনিউ করে দেবো। তাদের নাম ঠিকানা পাসপোর্টে যেমন আছে, তেমন থাকবে।’
২০১০ সাল থেকেই রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট নবায়ন করার জন্য বাংলাদেশকে চাপ দিচ্ছে সৌদি আরব।
তবে এই সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের জন্য কয়েক ধরনের সঙ্কট তৈরি করতে পারে বলে মনে করছেন সাবেক কূটনীতিক ও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা।
সৌদি আরবে রোহিঙ্গাদের নিয়ে বাংলাদেশ উভয় সঙ্কট বা দু’ধারী তলোয়ারের মুখে পড়েছে বলে বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন।
বাংলাদেশী পাসপোর্টে সৌদিতে রোহিঙ্গারা
১৯৭৫ সালের পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের একটি অংশকে নিতে রাজি হয়েছিল সৌদি সরকার। বাংলাদেশ থেকে বেশ কিছু তখন রোহিঙ্গা বাংলাদেশের পাসপোর্ট নিয়ে সৌদি আরব পাড়ি জমায়। তখন পাকিস্তান থাকা কিছু রোহিঙ্গাও একই প্রক্রিয়া সৌদি আরব যায়।
এই অভিবাসন প্রক্রিয়ার জন্য মিয়ানমারের নাগরিক হলেও রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট দিয়েছিল বাংলাদেশ।
দেশটির দূতাবাসের সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ৯০-এর দশকের শেষে তিন লাখের মতো রোহিঙ্গা সৌদি আরব গিয়েছিল। তাদের একটি বড় অংশকে সে দেশের সরকার শরণার্থী হিসেবে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দিয়েছে।
সৌদি আরবে একসময় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন গোলাম মসীহ। তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের যখন পাসপোর্ট দেয়া হয়েছিল সে সব পাসপোর্ট অন্য বাংলাদেশীদের মতো সাধারণ পাসপোর্টই ছিল। বিশেষ কিছু যুক্ত ছিল না তাদের পাসপোর্টে।’
তিনি বলেন, ‘রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী ৭৫-৭৬ এর সময়ে একবার গেছে, ৮৩-৮৪ তে একবার গেছে, ৯৩-৯৪তে একবার গেছে।’
‘তখন অল্প সংখ্যক ওখানে গেলেও আস্তে আস্তে তাদের ছেলে মেয়ে হয়েছে, ফ্যামিলি বড় হয়েছে।’
মসীহ তার সময়ে ২০১৭ সালের কথা জানিয়ে বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘দায়িত্ব নিয়েই জানতে পারলাম ৩৫ হাজারের মতো রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট নবায়ন হয়নি।’
‘তাদের পাসপোর্ট নবায়ন না হলে এক ধরনের ক্রাইসিস থাকে। কেননা তাদের ছেলে-মেয়েরা পড়ালেখা করতে পারে না, বিদেশে যেতে পারে না। নানা সমস্যা রয়েছে এটি নিয়ে’, বলছিলেন তিনি।
অভিবাসন বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘সৌদি আরব যখন তাদের নিতে চেয়েছিল, তখন পাসপোর্ট দেয়া হয়েছিল সৌদি আরবে থাকার জন্যই।’
কিন্তু এখন সেটি নবায়ন করে বাংলাদেশে নাগরিক হওয়া যাবে কি না সেটি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন এই বিশ্লেষক।
তিনি বলছেন, ‘বিষয়টি খুবই স্পর্শকাতর এই কারণে তাদের কাছে যে পাসপোর্ট রয়েছে, সেটা আসলে আমাদের বৈধ পাসপোর্ট। সেই বৈধ পাসপোর্ট দেয়ার ক্ষেত্রে আমাদের কর্তৃপক্ষের একটা জবাবদিহিতার জায়গা আছে।’
সৌদি আরবের অব্যাহত চাপ
প্রায় চার যুগ আগে বাংলাদেশী পাসপোর্টে মধ্যপ্রাচ্যের দেশটিতে পাড়ি জমান মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গারা। তাদের পাসপোর্ট নবায়নে ২০১০ সাল থেকেই বাংলাদেশকে চাপ দিচ্ছে সৌদি আরব।
সর্বশেষ ২০২২ সালের ১৩ নভেম্বর বাংলাদেশ সফর করেন সৌদি সরকারের উপ-স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নাসির বিন আবদুল আজিজ আল দাউদ। তখনও তিনি সে দেশে অবস্থানরত ৬৯ হাজার রোহিঙ্গার হাতে পাসপোর্ট না থাকার কথা উল্লেখ করেন।
সৌদি আরবের পক্ষ থেকে তাদের বাংলাদেশী পাসপোর্ট দেওয়ার অনুরোধও জানানো হয়। এ নিয়ে বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে তার বৈঠক হয়।
পরে সৌদি আরবে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট সংক্রান্ত জটিলতা নিরসনে একটি উচ্চ পর্যায়ে কমিটি বা জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন হয়।
দেড় বছরের মাথায় আবারো দেশটির প্রতিনিধি দল বাংলাদেশে এসে একই বিষয় নিয়ে কথা বলেছে। রোববারের বৈঠকে তারা বাংলাদেশের কাছে স্পষ্টভাবে জানতে চেয়েছে, ৬৯ হাজার রোহিঙ্গার পাসপোর্ট নবায়ন করতে কেন এতো সময় লাগছে?
ওইদিনই বৈঠকের পর বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, ‘এই বিষয়টি নিয়ে তারা আমাদেরকে অনুরোধ করেছিলেন। আমরা গত বছর একটা সমঝোতা সাক্ষর করেছিলাম। সেটাতে আমরা স্লো যাচ্ছি কেন। আমাদের কোনো অসুবিধা আছে কী না এটা তারা জানতে চেয়েছেন।’
সাবেক রাষ্ট্রদূত গোলাম মসীহ বলেন, ‘সৌদি আরবের একটা নিয়ম হচ্ছে, স্টেটলেস কেউ থাকতে পারবে না। হয় তাদের কাছে পাসপোর্ট থাকতে হবে, নয়তো আইডি কার্ড থাকতে হবে। সে কারণেই স্বাভাবিকভাবে তাদের পক্ষ থেকে এক ধরনের চাপ আছে।’
বিশ্লেষকরা বলছেন, ‘বিভিন্ন সময় নানা অপরাধ কর্মকাণ্ডে এসব রোহিঙ্গা নাগরিকদের নাম আসছে। তারা আটক হলে দেখা যাচ্ছে তাদের অনেকেরই নেই বৈধ পাসপোর্ট। যেটি সে দেশের জন্য একটি বড় সঙ্কট।’
অভিবাসন বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর বলছেন, ‘যেহেতু আস্তে আস্তে সংখ্যায় বাড়ছে, সে কারণে সৌদি সরকার নিজেও তাদের দায়িত্ব নিতে চাচ্ছে না। তাছাড়া তারা যখন অপরাধ কর্মকাণ্ড করছে, তখন বাংলাদেশের নাম আসছে। হয়তো সে কারণেই তারা বাংলাদেশকে চাপ দিচ্ছে।’
নবায়ন করবে বাংলাদেশ
সৌদি সরকারের কয়েক বছরের অনুরোধের পর অবশেষে সে দেশে থাকা ৬৯ হাজার রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট নবায়ন করতে রাজি হয়েছে বাংলাদেশ।
সৌদি আরবের প্রতিনিধি দলের সাথে বৈঠকের পর বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, ‘তারা তখন বাংলাদেশের পাসপোর্ট নিয়ে গিয়েছিল। কাজেই আমরা শুধু নবায়ন করে দিবো।’
সৌদিতে কর্মরত বাংলাদেশ দূতাবাস কর্মকর্তারা বিষয়টিকে স্পর্শকাতর দাবি করে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
তবে তারা বলছেন, সৌদির নিয়ম হচ্ছে কোনো রাষ্ট্রই স্টেটলেস থাকবে না। তাকে কোনো না কোন একটা দেশের আইডেন্টিটি ধারণ করতে হবে। যে কারণে সৌদি আরব এ বিষয়টি নিয়ে কথা বলছে।
সাবেক রাষ্ট্রদূত মসীহ বলছেন, ‘যদি ভেরিফিকেশন করে পাওয়া যায় সে সত্যি বাংলাদেশ থেকে গিয়েছে, তাহলে অবশ্যই বাংলাদেশ সরকার স্বাভাবিকভাবে একটা স্টেপ তো নিবে।’
তবে এ কাজটি অনেক সময় সাপেক্ষ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
আসিফ মুনীর বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘যেহেতু রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের নাগরিক না। এখন তাদের পাসপোর্ট নবায়ন করার ক্ষেত্রে জাতিসংঘের সাথে আলাপ করে দ্বিপাক্ষিক কোন সমাধানে আসা উচিত।’
তবে নবায়ন করা হলে তাদের সৌদিতে রাখার বিষয়টিতে জোর দেয়ার জন্য পরামর্শ দিচ্ছেন সাবেক কূটনীতিকরা।
কারণ অনেকের আশঙ্কা রয়েছে, অপরাধে জড়িত বা সাজাপ্রাপ্ত অনেক রোহিঙ্গার কাছে বাংলাদেশী পাসপোর্ট থাকলে তাদের দেশে ফেরত পাঠিয়ে দেয়া হতে পারে।
উভয় সঙ্কটে বাংলাদেশ
১৯৭৫ পরবর্তী সময় থেকে বাংলাদেশের পাসপোর্ট নিয়ে রোহিঙ্গারা সৌদি আরবে পাড়ি জমালেও তাদের পাসপোর্ট নবায়নের তাগিদ দেয়া শুরু হয় মূলত ২০১০ সাল থেকে।
তখন রোহিঙ্গাদের সংখ্যা কম হলেও এখন আস্তে আস্তে সেটি বাড়তে শুরু করেছে।
সাবেক রাষ্ট্রদূত গোলাম মসীহ বলছেন, ‘ফ্যামিলি বড় হওয়ার কারণে এই সংখ্যা বাড়ছেই। এই বিষয়টিকেও গুরুত্ব দিচ্ছে সৌদি আরব।’
তবে, রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট নবায়ন করে নতুন করে তিনটি সঙ্কট বাংলাদেশের সামনে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দাঁড়াবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
তাদের আশঙ্কা, পাসপোর্ট নবায়ন করা হয়ে গেলে সৌদি আরব যদি কোনো কারণে তাদের বাংলাদেশে ফেরত পাঠায়, তাহলে তাদের গ্রহণ করতে বাধ্য থাকবে বাংলাদেশ।
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে আগে থেকেই সহমর্মিতার জায়গায় ছিল সৌদি আরব। আমার মনে হয় সেখান থেকে তারা সরে এসেছে। নবায়নের পর সৌদি থেকে রোহিঙ্গাদের দেশে ফেরত পাঠানোর সম্ভাবনা বেশি।’
তবে সাবেক রাষ্ট্রদূত গোলাম মসীহ বলছেন, ‘সৌদি আরব নিশ্চিত করেছে, নবায়ন করা হলে তারা কাউকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হবে না। সেক্ষেত্রে তাদের কাজের সুযোগ যেন হয়, অন্য কোনো সঙ্কট যেন না হয়, সেই বিষয়টিও নজরে রাখতে হবে।’
অন্য একটি কারণের দিকে বেশি জোর দিচ্ছেন অভিবাসন বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর।
তিনি বলছেন, ‘তাদের যখন পাসপোর্ট দেয়া হয়েছিল রোহিঙ্গা নাগরিক হিসেবে সৌদি যাওয়ার জন্য দেয়া হয়েছিল। এখন সেটি নবায়ন করা মানে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেয়া। যেখানে দেশের মধ্যে ১২ লাখ রোহিঙ্গা রয়েছে। কোনো কারণে তাদের বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হলে বাংলাদেশের মেনে নেয়া ছাড়া বিকল্প থাকবে না।’
কূটনীতিকরা মনে করছেন, এমন অবস্থায় রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট দেয়া হলে যে ১২ লাখ রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আছে, তাদের ফেরত পাঠানোর জন্য বাংলাদেশ যে আলোচনা করছে আন্তর্জাতিক মহলে, সেখানেও সমস্যা তৈরি হতে পারে।
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘তাদের বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে একবার স্বীকার করলে এই ৬৯ হাজার রোহিঙ্গাকে আর কোনোদিন মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর সুযোগ থাকবে না। সেক্ষেত্রে ওই ১২ লাখ রোহিঙ্গা নাগরিককে ফেরত পাঠানোর ক্ষেত্রেও আন্তর্জাতিক সঙ্কট তৈরি হতে পারে।’
আবার সৌদি আরবের সাথে বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকা, সেদেশে থাকা বিশাল শ্রমবাজার এবং আর্থিক সম্পর্কের কারণে তাদের অনুরোধ বাংলাদেশ ফেলতেও পারবে না। কারণ তা হলে শ্রমবাজারের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
তাহলে কী নবায়ন না করে এই ইস্যুর সমাধান সম্ভব? এমন প্রশ্নেও খুব একটা আশার আলো দেখছেন না অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা।
অভিবাসন বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক কোনো সংস্থার মাধ্যমে সঙ্কটের সমাধান খুঁজতে হবে বাংলাদেশকেই।’
ফলে সৌদি আরবে রোহিঙ্গাদের নিয়ে বাংলাদেশ দু’ধারী তলোয়ারের মুখে রয়েছে বলে মনে করেন সাবেক সচিব তৌহিদ হোসেন।
তার মতে, ‘যদি আমরা তাদের কথা না শুনি তাহলে তারা তাদের দেশে থাকা আমাদের দেশের নাগরিকদের ওপর বিভিন্ন ধরনের রেস্ট্রিকশন আরোপ করতে পারে। অন্যদিকে, আমরা যদি এটা মেনে নেই তাহলে রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে আমাদের যে অবস্থান সেটা সেটেল করতে পারব না।’
কিন্তু ভবিষ্যতে সেই ঝুঁকি থাকলেও সৌদি আরবের অনুরোধ মেনে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যে সেটাই পরিষ্কার হয়েছে।
সূত্র : বিবিসি
Leave a Reply