সূরা ইখলাস আল কুরআনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সূরা। এ সূরাটি আল্লাহর পূর্ণাঙ্গ পরিচয় প্রকাশ করে। ‘বলো, আল্লাহ একক। তিনি কারো মুখাপেক্ষী নন। তিনি জন্ম দেননি এবং তিনি জন্মগ্রহণ করেননি। তাঁর সমকক্ষ কেউ নেই।’ এই হলো, শাব্দিক অর্থ আর এর ভাবার্থ হলো, ‘বলো, তিনি আল্লাহ, এক ও একক। আল্লাহ কারোর ওপর নির্ভরশীল নন এবং সবাই তাঁর ওপর নির্ভরশীল। তিনি কোনো সন্তান জন্ম দেননি এবং তিনি কারো ঘরে জন্মগ্রহণ করেননি বা তাঁর কোনো সন্তান নেই এবং তিনি কারো সন্তান নন এবং তাঁর সমতুল্য কেউ নেই।’
এখানে মহান আল্লাহর চারটি পরিচয় দান করা হয়েছে।
এক. প্রথম আয়াতে আল্লাহর পরিচয় হচ্ছে, ‘তিনি আল্লাহ একক’। ব্যাকরণের সূত্র অনুসারে উলামায়ে কেরাম ‘হুয়া আল্লাহু আহাদ’ বাক্যটির বিভিন্ন বিশ্লেষণ দিয়েছেন। ‘হুয়া’ উদ্দেশ্য (সাবজেক্ট) ‘আল্লাহ’ তার বিধেয় (প্রিডিকেট) এবং ‘আহাদ’ তার দ্বিতীয় বিধেয়। এ বিশ্লেষণের দৃষ্টিতে এ বাক্যটির অর্থ হচ্ছে, তিনি (যাঁর সম্পর্কে তোমরা প্রশ্ন করছ) আল্লাহ একক। অন্য অর্থে এও হতে পারে এবং ভাষারীতির দিক দিয়ে এটাও ভুল নয় যে, তিনি আল্লাহ এক।
এ বাক্যটিতে মহান আল্লাহর জন্য ‘আহাদ’ শব্দটি যেভাবে ব্যবহার করা হয়েছে তা আরবি ভাষায় এ শব্দটির একটি অস্বাভাবিক ব্যবহার। সাধারণত অন্য একটি শব্দের সাথে সম্বন্ধের ভিত্তিতে এ শব্দটি ব্যবহৃত হয়, যেমন : ‘ইয়াউমুল আহাদ’ ‘সপ্তাহের প্রথমদিন’। অনুরূপভাবে ‘ফাবআছু আহাদাকুম’ ‘তোমদের কোনো একজনকে পাঠাও’। অথবা সাধারণ নেতিবাচক অর্থে এর ব্যবহার হয়। যেমন : ‘মা জায়ানি আহাদুন’ ‘আমার কাছে কেউ আসেনি’। কিংবা ব্যাপকতর ধারণাসহ প্রশ্ন সূচক বাক্যে বলা হয়। যেমন : ‘কাল ইনদাকা আহাদুন’ তোমার কাছে কি কেউ আছে’? এ ব্যাপকতর ধারণাসহ শর্ত প্রকাশক বাক্যে এর ব্যবহার হয়। যেমন : ‘ইন জায়াকা আহাদুন’ ‘যদি তোমার কাছে কেউ এসে থাকে।’ অথবা গণনায় বলা হয়।
যেমন : আহাদুন, ইছনানে, আহাদা আশারা অর্থাৎ এক, দুই, এগারো। এ সীমিত ব্যবহারগুলো ছাড়া কুরআন নাজিলের আগে আরবি ভাষায় ‘আহাদুন’ শব্দটির গুণবাচক অর্থে ব্যবহার অর্থাৎ কোনো ব্যক্তি বা জিনিসের গুণ প্রকাশ অর্থে ‘আহাদ’ শব্দের ব্যবহারের কোনো নজির নেই। আর আল কুরআন নাজিলের পর এ শব্দটি শুধু আল্লাহর সত্তার জন্য ব্যবহৃত হয়েছে। এ অস্বাভাবিক বর্ণনাপদ্ধতি স্বতঃস্ফূর্তভাবে এ কথা প্রকাশ করে যে, একক ও অদ্বিতীয় হওয়া আল্লাহর বিশেষ গুণ। বিশ্ব জাহানের কোনো কিছুই এ গুণে গুণান্বিত নয়। তিনি এক ও একক, তাঁর কোনো দ্বিতীয় নেই।
তারপর মুশরিক ও কুরাইশরা রাসূলুল্লাহ সা:কে তাঁর রব সম্পর্কে যেসব প্রশ্ন করেছিল সেগুলো সামনে রেখে দেখুন, ‘আল্লাহ’ বলার পর ‘আহাদ’ বলে কিভাবে আল্লাহর পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে। এক ‘আহাদ’ শব্দটির দ্বারা আল্লাহর ব্যাপক পরিচয় প্রদান করে। নিচে তার বিশদ ব্যাখ্যা প্রদান করা হয়েছে :
প্রথমত, এর মানে হচ্ছে, তিনি একাই রব। তাঁর ‘রুবুবিয়াতে’ কারো কোনো অংশ নেই। আর যেহেতু ইলাহ একমাত্র তিনিই হতে পারেন যিনি রব হন, তাই ‘উলুহিয়াতে’ও কেউ তাঁর শরিক নেই।
দ্বিতীয়ত, এর মানে এও হয় যে, তিনি একাই এ বিশ্ব জাহানের স্রষ্টা। এ সৃষ্টিকর্মে কেউ তাঁর সাথে শরিক নয়। তিনি একাই সমগ্র বিশ্ব রাজ্যের মালিক ও একচ্ছত্র অধিপতি। তিনি একাই বিশ্ব ব্যবস্থার পরিচালক ও ব্যবস্থাপক। সমগ্র সৃষ্টিজগতের রিজিক তিনি একাই দান করেন। সঙ্কটকালে তিনি একাই তাদের সাহায্য করেন ও ফরিয়াদ শোনেন। আল্লাহর সার্বভৌম কর্তৃত্বের এসব কাজকে তোমরা নিজেরাও আল্লাহর কাজ বলে মনে করো, এসব কাজে আর কারো সামান্যতম কোনো অংশ নেই।
তৃতীয়ত, তারা এ কথাও জিজ্ঞেস করেছিল, তিনি কিসের তৈরি। তাঁর বংশধারা কী। তিনি কোন প্রজাতির অন্তর্ভুক্ত। দুনিয়ার উত্তরাধিকার তিনি কার কাছ থেকে পেয়েছেন এবং তারপর কে এর উত্তরাধিকার হবে। আল্লাহ তাদের এসব প্রশ্নের জবাব একটিমাত্র ‘আহাদ’ শব্দের মাধ্যমে দিয়েছেন।
এর অর্থ হচ্ছে : ১. তিনি এক আল্লাহ চিরকাল আছেন এবং চিরকাল থাকবেন। তাঁর আগে কেউ আল্লাহ ছিল না এবং তাঁর পরও কেউ আল্লাহ হবে না। ২. আল্লাহর এমন কোনো প্রজাতি নেই, যার সদস্য তিনি হতে পারেন বরং একাই আল্লাহ এবং তাঁর সমগোত্রীয় ও সমজাতীয় কেউ নেই। ৩. তাঁর সত্তা নিছক ‘ওয়াহেদ’ এক নয় বরং ‘আহাদ’ একক, যেখানে কোন দিক দিয়ে একাধিক্যের সামান্যতম স্পর্শও নেই। তিনি বিভিন্ন উপাদানে গঠিত কোনো সত্তা নন। তাঁর সত্তাকে দ্বিখণ্ডিত করা যেতে পারে না। তাঁর কোনো আকার ও রূপ নেই। তিনি কোনো স্থানের গণ্ডিতে আবদ্ধ নন এবং তাঁর মধ্যে জিনিস আবদ্ধ হতে পারে না। তাঁর কোনো বর্ণ নেই। কোনো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নেই। তাঁর মধ্যে কোনো প্রকার পরিবর্তন-বিবর্তন ঘটে না। সব প্রকার ধরন ও প্রকরণমুক্ত ও বিবর্জিত তিনি একমাত্র সত্তা, যা সব দিক দিয়েই আহাদ বা একক।
এ পর্যায়ে এ কথাটি ভালোভাবে ব্যবহার করা হয় যেমনভাবে আমাদের ভাষায় আমরা ‘এক’ শব্দটি ব্যবহার করে থাকি। বিপুল সংখ্যাসম্বলিত কোনো সমষ্টিকেও তার সামগ্রিক সত্তাকে সামনে রেখে ‘ওয়াহেদ’ বা ‘এক’ বলা হয়। যেমন এক ব্যক্তি, এক জাতি, এক দেশ, এক পৃথিবী, এমনকি এক বিশ্ব জাহানও। আবার কোনো সমষ্টির প্রত্যেক অংশকেও আলাদা আলাদাভাবেও ‘এক’ই বলা হয়। কিন্তু ‘আহাদ’ বা একক শব্দটি আল্লাহ ছাড়া আর কারো জন্য ব্যবহার করা হয় না। এজন্য কুরআন মজিদে যেখানেই আল্লাহর জন্য ওয়াহেদ (এক) শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে সেখানেই বলা হয়েছে ‘ইলাহুন ওয়াহেদ’ এ মাবুদ বা ‘আল্লাহুল ওয়াহেদুল কাহহার’ এক আল্লাহই সবাইকে বিজিত ও পদানত করে রাখেন। কোথাও নিছক ‘ওয়াহেদ’ বলা হয়নি। কারণ যেসব জিনিসের মধ্যে বিপুল ও বিশাল সমষ্টি রয়েছে তাদের জন্যও এ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। বিপরীত পক্ষে আহাদ শব্দটি একমাত্র আল্লাহর জন্য ব্যবহৃত হয়েছে। কারণ আল্লাহই একমাত্র সত্তা ও অস্তিত্ব যার মধ্যে কোনো প্রকার একাধিক্য নেই। তাঁর একক সত্তা সবদিকে দিয়েই পূর্ণাঙ্গ।
দুই. দ্বিতীয় আয়াতে আল্লাহ তায়ালার আরো একটি শক্তিশালী পরিচয় হচ্ছে, ‘আল্লাহ কারো ওপর নির্ভরশীল নন এবং সবাই তাঁর ওপর নির্ভরশীল। মূলে ‘সামাদ’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এ শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে ছোয়াদ, মিম, দাল ধাতু থেকে। আরবি ভাষায় এ ধাতুটি থেকে যতগুলো শব্দের উৎপত্তি হয়েছে সেগুলোর ওপর নজর বুলালে এ শব্দটির অর্থেও ব্যাপকতা জানা যায়। যেমন : আস সামাদু, মনস্থ করা, ইচ্ছা করা। বিপুলায়তনবিশিষ্ট উন্নত স্থান এবং বিপুল ঘনত্ববিশিষ্ট উন্নত মর্যাদা। উচ্চ সমতল ছাদ। যুদ্ধে যে ব্যক্তি ক্ষুধার্ত ও পিপাসার্ত হয় না। প্রয়োজনের সময় যে সরদারের শরণাপন্ন হতে হয়।
‘আস সামাদু’ প্রত্যেক জিনিসের উঁচু অংশ। যে ব্যক্তির উপরে আর কেউ নেই। যে নেতার আনুগত্য করা হয় এবং তার সাহায্য ব্যতীত কোনো বিষয়ের ফায়সালা করা হয় না। অভাবীরা যে নেতার শরণাপন্ন হয়। চিরন্তন উন্নত মর্যাদা। এমন নিবিড় ও নি-িদ্র যার মধ্যে কোনো শূন্যতা ও ফাঁকা অংশ নেই, যেখান থেকে কোনো জিনিস বের হতে পারে না এবং কোনো জিনিস যার মধ্যে প্রবেশ করতে পারে না। যুদ্ধে যে ব্যক্তি ক্ষুধা-তৃষ্ণার শিকার হয় না।
কোনো সাহাবি রা: ও ইসলামী মনীষী বলেছেন, ‘সামাদ হচ্ছেন এমন এক সত্তা যাঁর উপরে আর কেউ নেই।’ কোনো সাহাবি রা: বলেছেন, ‘তিনি এমন সরদার, নেতা ও সমাজপতি, যার নেতৃত্ব পূর্ণতা লাভ করেছে এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। হজরত ইবনে আব্বাস রা:-এর উক্তি হচ্ছে : লোকেরা কোনো বিপদে-আপদে যার দিকে সাহায্য লাভের জন্য এগিয়ে যায়, তিনি সামাদ। তাঁর আর একটি উক্তি হচ্ছে : যে সরদার তার নেতৃত্ব, মর্যাদা, শ্রেষ্ঠত্ব, ধৈর্য, সংযম, জ্ঞান, বুদ্ধিমত্তা ও বিচক্ষণতায় পূর্ণতার অধিকারী তিনি সামাদ। হজরত আবু হুরাইরা রা: বলেছেন : ‘যিনি কারো ওপর নির্ভরশীল নন, সবাই তাঁর ওপর নির্ভরশীল, তিনিই সামাদ।’ ইকরামার একটি বক্তব্য হচ্ছে : ‘যার মধ্য থেকে কোনো জিনিস কোনো দিন বের হয়নি এবং বের হয়ও না আর যে পানাহার করে না, সে-ই সামাদ।
তিন. তৃতীয় আয়াতে আল্লাহর পরিচয় হচ্ছে ‘না তাঁর কোনো সন্তান আছে, না তিনি কারো সন্তান।’ কুরআন অন্যান্য আয়াতই এ আয়াতের ব্যাখ্যা। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আল্লাহই হচ্ছেন একমাত্র ইলাহ। কেউ তাঁর হবে, এ অবস্থা থেকে তিনি মুক্ত পাকপবিত্র। যা কিছু আকাশগুলো এবং যা কিছু জমিনে আছে, সবই তার মালিকাধীন’ (সূরা নিসা : ১৭১)। ‘জেনে রাখো, এরা যে বলছে আল্লাহর সন্তান আছে, এটা এদের নিজেদের মনগড়া কথা। আসলে এটি ডাহা মিথ্যা কথা।’ (সূরা আস সাফফাত : ১৫১-১৫২)
চার. চার নং আয়াতে আল্লাহর পরিচয় হচ্ছে, তাঁর সমকক্ষ বা সমতুল্য কেউ নেই। আরবি ‘কুফ’ মানে হচ্ছে নজির, সদৃশ, সমান, সমমর্যাদাসম্পন্ন ও সমতুল্য। বিয়ের ব্যাপারে আমাদের দেশে কুফু শব্দের ব্যবহার আছে। এ ক্ষেত্রে এর অর্থ হয়, সামাজিক মর্যাদার দিক দিয়ে ছেলের ও মেয়ের সমান পর্যায়ে অবস্থান করা। কাজেই এখানে এ আয়াতের মানে হচ্ছে : সারা বিশ্ব জাহানে আল্লাহর সমকক্ষ অথবা তাঁর সমমর্যাদাসম্পন্ন কিংবা নিজের কর্ম ও ক্ষমতার ব্যাপারে তাঁর সমান পর্যায়ে উন্নীত হতে পারে এমন কেউ কোনো দিন ছিল না এবং কোনো দিন হতেও পারবে না।
লেখক :
প্রবন্ধকার
Leave a Reply