আজ রমজানুল মোবারকের বিশ তারিখ। ইসলামের ইতিহাসে অত্যন্ত তাৎপর্যবহ একটি ঘটনার সাক্ষী রমজানের বিশ তারিখ। শুধু ইসলামের ইতিহাসে নয়, বিশ্ব সভ্যতার ইতিহাসে অনন্য সাধারণ বৈশিষ্ট্য ও মর্যাদার অধিকারী এ ঘটনাটি হলো মক্কা বিজয়। ইসলামের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হিজরতের অষ্টম বছরে ১০ হাজার মুসলিম সৈন্যের এক বাহিনী নিয়ে মক্কা নগরী জয় করেছিলেন এদিনে। এ ঘটনা ছিল মুসলমানদের জন্য অত্যন্ত গৌরবের, সাফল্যের ও সন্তুষ্টির।
নবুওয়াতের ১৩তম বছরে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম মক্কা ছেড়ে ইয়াছরিবে হিজরত করেন। ইয়াছরিবের নাম হয়ে যায় মদিনাতুন নবী বা সংক্ষেপে মদীনা। এখান থেকে ইসলামের প্রসার ঘটে অভাবনীয় গতিতে। মক্কায় কোরাইশ গোত্র আরবে সবচেয়ে প্রভাবশালী ও মর্যাদাপূর্ণ হওয়ায় তাদের বিরোধিতা ছিল ইসলামের প্রসারে একটি বড় অন্তরায়। তা ছাড়া তারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র তৎপরতাও চালায়। বদর, উহুদ,আহযাব ইত্যাদি যুদ্ধে কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছে মুসলমানদের। তবে এর মধ্যে আল্লাহর মদদের কারিশমাও প্রত্যক্ষ করেছে তারা। এরই ধারাবাহিকতায় আসে মক্কা বিজয়ের পালা।
তবে মক্কা জয়ের জন্য মহানবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের অভিযান পরিচালনার পেছনে কাজ করেছে হুদায়বিয়ার সন্ধি। হিজরী ষষ্ঠ বছরে সম্পাদিত এ চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করেছিল মক্কার কুরাইশরা। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রতিকার চেয়েছিলেন নইলে সন্ধির সমাপ্তি হয়েছে মনে করার ঘোষণা দিয়েছিলেন। কুুরাইশরা কোনো সাড়া না দেয়ায় তিনি অভিযান পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেন।
হুদায়বিয়ার সন্ধির পর এ সন্ধি অনুযায়ী আরবের ‘বনু খুজায়া’ গ্রোত্র মহানবী (সা.)-এর সাথে এবং ‘বনু বকর’ গোত্র কুরাইশদের সাথে মৈত্রী চুক্তি করে। এ দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে পূর্বশত্রুতা ছিল। বনু বকর কুরাইশদের প্ররোচনায় বনু খুজায়া গোত্রের আবাসভূমি ‘ওয়াতির’-এর নিভৃত পল্লিতে রাতের অন্ধকারে অতর্কিত হামলা করে অসহায় নারী, শিশুসহ নির্বিচারে হত্যা ও লুণ্ঠন করে। প্রাণের ভয়ে কাবায় আশ্রয় নেওয়া নিরীহ মানুষকেও তারা হত্যা করে। এ ঘটনার প্রতিকারের জন্য খুজায়া গোত্র মহানবী (সা.) এর নিকট আসে। মহানবী সা. প্রতিকারের জন্য দূত মারফত মক্কার কুরাইশ নেতাদের জানালেন, তোমরা বন খুজায়া গোত্রকে উপযুক্ত আর্থিক ক্ষতিপূরণ দাও; নয়তো বনু বকর গোত্রের সঙ্গে মৈত্রী চুক্তি বাতিল করো, না হলে হুদায়বিয়ার সন্ধির শর্ত লঙ্ঘন হয়েছে বলে এ চুক্তি বাতিল হয়েছে বলে পরিগণিত হবে। কুরাইশ নেতারা তৃতীয় পন্থাই গ্রহণ করলেন।
মহানবী সা. এর দূত মক্কা থেকে মদিনায় ফিরে এসে জানালেন, কুরাইশরা তৃতীয় প্রস্তাবটি গ্রহণ করেছেন। এর ফলে মহানবী সা. বহু আকাক্সিক্ষত মক্কা অভিযানের সব প্রস্তুতি গ্রহণ করলেন। তিনি উপলব্ধি করেন যে, মক্কা বিজয় ব্যতীত আরবে ইসলাম সুদৃঢ়রূপে প্রতিষ্ঠিত হবে না। ইত্যবসরে মক্কাবাসীদের বিভেদ ও বৈষম্যের কথা উপলব্ধি করে আবু সুফিয়ান স্বয়ং মদিনায় গমন করে শান্তি প্রস্তাব করলে হযরত মুহাম্মদ সা. তা প্রত্যাখ্যান করেন এবং ১০ হাজার সৈন্যের এক বিশাল বাহিনী নিয়ে ৬৩০ খ্রিষ্টাব্দের ৬ জানুয়ারি মোতাবেক ১০ই রমজান, অষ্টম হিজরি মক্কা বিজয়ের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন।
২০ রমজান মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কায় প্রবেশ করেন। প্রায় রক্তপাতহীন সে অভিযানে ইসলামের নবীর পতাকা সেখানে সমুন্নত হয়। আর সত্য ধর্মের গৌরব প্রতিষ্ঠিত হয় আরবের সবচেয়ে সমৃদ্ধ নগরীতে। হযরত ইবরাহিম খলিল আলাইহিস সালাম একক প্রভুর ইবাদতের জন্য যে বায়তুল্লাহ নির্মাণ করেছিলেন, তা ভরে ফেলা হয়েছিল মূর্তি ও বিগ্রহে। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর ঘর থেকে ৩৬০টি মূর্তি অপাসরণ করেন। আর এতদিন যারা ইসলামের শত্রুতায় সদাপ্রস্তুত ছিল, তাদের জন্য ঘোষণা করেন সাধারণ ক্ষমা। শান্তি ও মানবতার অনন্য নজির স্থাপন করলেন ইসলামের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। তাই মক্কা বিজয়ের ঘটনা বিশ্ব মানবতার ইতিহাসে এক অনন্য সাধারণ ঘটনা। আর সে কারণেই ২০ রমজান মুসলমানদের জন্য বিপুল গৌরবের স্মারক।
Leave a Reply