রাজধানী ঢাকার ক্যান্টনমেন্ট রেলস্টেশনে অবৈধ মদের কারবারের সঙ্গে রেলওয়ের চার কর্মীর জড়িত থাকার প্রমাণ পেয়েছে রেলপথ মন্ত্রণালয় গঠিত তদন্ত কমিটি। এর ধারাবাহিকতায় স্টেশনটির বড় মাস্টারসহ চারজনকে সাময়িক বরখাস্ত এবং তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলার নির্দেশ দিয়েছে মন্ত্রণালয়। এ চারজনের বিরুদ্ধে স্টেশনের স্পর্শকাতর ও সংরক্ষিত স্থান রিলে রুমে অবৈধ মদের বোতল মজুদ রাখার অভিযোগ উঠেছিল। প্রসঙ্গত রিলে রুম হচ্ছে একটি স্টেশনের সিগন্যালিংসহ সার্বিক অপারেশনাল কাজের স্থান, যেখানে সাধারণ কর্মীদের প্রবেশাধিকারও নিষিদ্ধ।
গত ১২ মার্চ মন্ত্রণালয়ের পাঠানো এক চিঠির সূত্রে এই তথ্য জানা যায়। এতে বলা হয়, ক্যান্টনমেন্ট স্টেশনের বড় মাস্টার লিটন চন্দ্র দের মদের বোতল সংরক্ষণের সঙ্গে সম্পৃক্ততার প্রমাণ মিলেছে। এ কাজে তাকে সহযোগিতা করেন পয়েন্টসম্যান মাজেদুল ইসলাম এবং খালাসী কেশব চন্দ্র সরকার ও ছায়েদুল ইসলাম। ঘটনার সময় ছায়েদুল রিলে রুমের দায়িত্বে ছিলেন। কিন্তু রুম তালা দিয়ে স্টেশন থেকে বের হয়ে যান এবং কাস্টমস গোয়েন্দা অভিযান দলকে সহায়তা করেননি। গত বছরের ২৫ জুলাইয়ে সংঘটিত ওই ঘটনার পর দীর্ঘ তদন্ত শেষে অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে রেলওয়েকে এই চিঠি দেয় রেলপথ মন্ত্রণালয়। তদন্তে এসব কর্মচারীর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত এবং কাস্টমস গোয়েন্দা ও নিলাম শাখা থেকে পাঠানো চিঠিতেও এ ধরনের কার্যক্রমকে ফৌজদারি অপরাধ বলে অভিহিত করা হয়েছে। তাই সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলে মন্ত্রণালয়।
রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মো. হুমায়ুন কবীর গতকাল আমাদের সময়কে বলেন, ক্যান্টনমেন্ট স্টেশনের ওই ঘটনার সত্যতা পাওয়া গেছে তদন্তে। তাই জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ইতোমধ্যে বাংলাদেশ রেলওয়েকে টিঠি দিয়েছে মন্ত্রণালয়।
জানা গেছে, ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট রেলওয়ে স্টেশনের রিলে রুমের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারী ছাড়া সাধারণ মানুষ, কোনো যাত্রী এবং এমনকি সাধারণ রেলকর্মীরও প্রবেশাধিকারের সুযোগ নেই। তালাবদ্ধ ওই রুম থেকে একই দিন কাস্টমস গোয়েন্দা কর্মকর্তারা দুটি ব্যাগ থেকে ২৭ লিটার বিভিন্ন ব্র্যান্ডের বিদেশি মদ উদ্ধার করেন। মৈত্রী ট্রেনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সহযোগিতায় এসব মদ অবৈধভাবে দেশে আসে। সংশ্লিষ্টদের মতে, এ সব মদ ওই রুমের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীর প্রত্যক্ষ সহযোগিতা ছাড়া সেখানে রাখার সুযোগ নেই।
মৈত্রী এক্সপ্রেস কলকাতা থেকে ছাড়লে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট রেলওয়ে স্টেশন ছাড়া অন্য স্টেশনে যাত্রী ওঠানামার সুযোগ নেই। আর ছেড়ে আসার সময় ভারতীয় কাস্টমস কর্তৃপক্ষ তল্লাশি করে। এর পরও এই ট্রেনে করে আসছে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের বিদেশি মদ। ট্রেনের সিট আর ফলস সিলিংয়ের ভেতরে সুকৌশলে লুকিয়ে শুল্ককর ফাঁকি দিয়ে আনা হচ্ছে নানা ধরনের বিদেশি মদ। তবে ট্রেনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সহযোগিতা ছাড়া কোনো যাত্রীর পক্ষে এভাবে মদ আনা সম্ভব নয় বলে মনে করে কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। ২৫ জুলাই কাস্টমস গোয়েন্দা কর্মকর্তারা ক্যান্টনমেন্ট স্টেশনে মৈত্রী ট্রেনের দুটি কোচের সিল ও ফলস সিলিংয়ে লুকানো ১৬০ লিটার বিদেশি মদ উদ্ধার করেন।
চিঠির সূত্রে জানা যায়, গত বছরের ২৫ জুলাই মৈত্রী ট্রেনে কাস্টমস গোয়েন্দার একটি দল অভিযান পরিচালনা করেন। ওই দিন বিকাল ৪টা ১০ মিনিটে কলকাতা থেকে মৈত্রী এক্সপ্রেস ট্রেন ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট স্টেশনে এসে পৌঁছায়। যাত্রীরা নামার পর কাস্টমস গোয়েন্দারা ট্রেনের এইচ ৪ নম্বর কোচে অভিযান চালায়। এ সময় কোচের সিটের নিচ থেকে তিনটি ও ফলস সিলিং খুলে আটটি কালো রঙের ব্যাগ ও কাগজে মোড়ানো কিছু মদের বোতল উদ্ধার করে। একইভাবে এইচ ২ নম্বর কোচের সিটের নিচ থেকে দুটি ও ফলস সিলিং খুলে ছয়টি কালো রঙের ব্যাগ ও কাগজে মোড়ানো কিছু সংখ্যক মদের বোতল উদ্ধার করা হয়।
এর আগে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট স্টেশনের রিলে রুমের ভেতরে মাদকদ্রব্য রয়েছে বলে গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের কাছে তথ্য ছিল। এরই পরিপ্রেক্ষিতে কোচে অভিযান শেষ করে কর্তব্যরত স্টেশন মাস্টার লিটন চন্দ্র দেকে তালাবদ্ধ রিলে রুম খুলে দিতে অনুরোধ করেন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। তখন রিলে রুমের দায়িত্বে থাকা কর্মচারীদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং রুম খুলে দিতে বলেন মাস্টার। কিন্তু রুম খুলে দেওয়া হয়নি। পরে স্টেশন মাস্টারের সহায়তায় তালা ভেঙে ফেলা হয়। পরে জিআরপি ও বিভিন্ন সংস্থার উপস্থিতিতে রিলে রুম থেকে মদভর্তি দুটি ব্যাগ উদ্ধার করেন কাস্টমস গোয়েন্দা। ওই দিন দুটি কোচ থেকে ১৬২ ও রিলে রুম থেকে বিভিন্ন বিদেশি ব্র্যান্ডের ২৭ লিটার মদ উদ্ধার করা হয়।
Leave a Reply