ঢাকার বেইলি রোডের আগুনে মারা যাওয়া নারী সাংবাদিকের আসল পরিচয় জানা গেছে। তার নাম বৃষ্টি খাতুন। জন্ম কুষ্টিয়ায়। বাবা সাবরুল আলম সবুজ ও মা বিউটি খানম এখন অপেক্ষায় আছেন মেয়ের লাশ নিয়ে বাড়ি ফেরার। কিন্তু কবে লাশ পাবেন তা জানেন না।
রোববার রাতে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) জানিয়েছে, ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে প্রায় দুই সপ্তাহ পর সাংবাদিক মহলে অভিশ্রতি শাস্ত্রী হিসেবে পরিচিত ওই নারী সাংবাদিকের প্রকৃত নাম বৃষ্টি খাতুন।
গত ২৯ ফেব্রুয়ারি বেইলি রোডের অগ্নিদুর্ঘটনায় নিহত হওয়ার পর তার পরিচয় নিয়ে অস্পষ্টতা তৈরি হয়।
‘অভিশ্রুতি শাস্ত্রী’ নামে পরিচিত সাংবাদিক কাজ করতেন ‘দ্যা রিপোর্ট ডট লাইভ’ নামের একটি নিউজ পোর্টালে। ঢাকায় তিনি সনাতন ধর্মের রীতি-নীতি অনুসরণ করতেন বলে পরিচিতরা জানিয়েছেন।
অন্যদিকে লাশ শনাক্তের পর গত ১ মার্চ কুষ্টিয়ার সবুজ শেখ নিজেকে ওই নারী সাংবাদিকের বাবা দাবি করেন। ফিঙ্গারপ্রিন্টের মাধ্যমে তার নাম বৃষ্টি খাতুন বলে দেখতে পেয়ে লাশ হস্তান্তরের উদ্যোগ নিয়েছিল পুলিশ।
এমন প্রেক্ষাপটে আসল পরিচয় শনাক্ত না করে তার লাশ হস্তান্তর না করার অনুরোধ করে রমনা কালী মন্দিরের কর্তৃপক্ষ। এরপরে পুলিশ ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে পরিচয় শনাক্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়।
সিআইডির ফরেনসিক বিভাগের প্রধান ডিআইজি নাহিদুল ইসলাম বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘ডিএনএ টেস্টের রিপোর্টে বাবা-মায়ের দেয়া নমুনার সাথে মিল পাওয়া গেছে।’
তবে বৃষ্টি খাতুনের বাবা বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, ‘রিপোর্ট কী আসবে সেটা তো অজানা কিছু না। আমরা সবাই মেয়ের লাশ নেয়ার জন্য ঢাকায় অপেক্ষা করছি।’
সিআইডি ডিএনএ টেস্টের এই রিপোর্টের কথা গণমাধ্যমকে জানালেও পুলিশ বলছে তাদের হাতে এখনো এই রিপোর্ট আসেনি ।
রমনা থানার ওসি উৎপল বড়ুয়া বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘রিপোর্টের কাগজ হাতে না পেলে আমরা কোনো ধরনের ব্যবস্থা নিতে পারব না।’
সন্তানের লাশ কবে পাবে পরিবার?
পরিচয় জটিলতার কারণে ডিএনএ টেস্টের মাধ্যমে পরিবারের কাছে লাশ হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত নেয়া হয় গত ১ মার্চ শুক্রবার রাতে। পরদিন শনিবার ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের মর্গ থেকে নমুনা নেয়া হয় অভিশ্রুতি নামধারী সাংবাদিক বৃষ্টি খাতুনের।
পরদিন রোববার বাবা সাবরুল আলম সবুজ ও মা বিউটি খাতুনের শরীর থেকে নমুনা সংগ্রহ করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডি।
ডিএনএ’র নমুনা দেয়ার পর তখন ঢাকা মেডিক্যালের ফরেনসিক বিভাগ বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছিলেন, এই ধরনের পরীক্ষায় কমপক্ষে এক থেকে দুই সপ্তাহ সময় লাগে।
রোববার রাতে ডিএনএ নমুনার এই ফলাফল সিআইডির হাতে আসে। সিআইডির ফরেনসিক বিভাগের প্রধান ডিআইজি নাহিদুল ইসলাম বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘ওর বাবা-মা দু’জনেরই আমরা নমুনা নিয়েছিলাম। ওই নারী সাংবাদিকের ডিএনএ তার বাবা-মায়ের ডিএনএর সাথে মিলছে।’
নাহিদুল ইসলাম জানান, এই রিপোর্টের বিষয়টি মামলার তদন্ত কর্মকর্তাকে জানানো হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘রেজাল্ট কাগজে কলমে যেতে সময় লাগে। আমরা সাধারণত সেনসেটিভ কেসগুলোতে রেজাল্ট দ্রুত জানিয়ে দেই। তবে এই রিপোর্ট কাগজে কলমে আরো এক দুই দিন পরে যেতে পারে।’
বৃষ্টি খাতুনের বাবা বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘আমরা সবাই ঢাকায় আছি। আমরা রিপোর্ট না পাওয়া পর্যন্ত বলতে পারব না কবে মেয়েকে নিজেদের হাতে পাবো।’
অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাটি ঘটে রাজধানীর বেইলি রোডে। তাই বিষয়টি তদন্তের দায়িত্ব পড়ে রমনা থানার ওপর। রোববার রাতে রমনা থানার ওসির সাথে কথা বলে বিবিসি বাংলা।
সিআইডি এই রিপোর্ট পুলিশের কাছে দেয়ার কথা বললেও পুলিশ বলছে এখনো তারা কোনো রিপোর্ট হাতে পায়নি।
রমনা থানার ওসি উৎপল বড়ুয়া বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘হিসেব অনুযায়ী ওসির কাছে কাগজ পাঠানোর কথা। আমার কাছে কাগজ এখনো আসে নাই। আর কাগজ না পেলে তো আমরা পরবর্তী প্রক্রিয়া শুরু করতে পারি না।’
‘রিপোর্ট কাগজে-কলমে হয়তো প্রস্তুত হচ্ছে। আমাদের কাছে সাবমিট করার আগ পর্যন্ত বলতে পারব না আসলে কবে কিংবা কিভাবে লাশ হস্তান্তর করা হবে,’ তিনি বলেন।
‘অজ্ঞাত পরিচয়ে’ ১১ দিন মর্গে
গত ২৯ ফেব্রুয়ারি লাশ শনাক্ত হওয়ার পর থেকে একদিন লাশটি ছিলও শেখ হাসিনা বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইন্সটিটিউটে। ডিএনএর নমুনা সংগ্রহের জন্য পরদিন লাশ নেয়া হয় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গে।
বেইলি রোডের ওই অগ্নি দুর্ঘটনায় মোট ৪৬ জন মারা গেছে। এর পরদিন শেখ হাসিনা বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইন্সটিটিউট থেকে মোট ৪৪ জনের লাশ হস্তান্তর করা হয়।
লাশ শনাক্ত হলেও তখন নাম ও ধর্ম পরিচয় নিয়ে জটিলতা তৈরি হলে বৃষ্টি খাতুনের লাশ নিতে পারেনি পুলিশ।
ওই দুর্ঘটনায় মারা যায় ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী নাজমুল ইসলামও। বৃষ্টির লাশ শনাক্ত হলেও ওই সময় শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি নাজমুলের মরদেহটি।
রোববারের ডিএনএ রিপোর্টে বৃষ্টি খাতুনের পরিচয়ের পাশাপাশি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের নাজমুলের পরিচয়ও শনাক্ত হয়।
ডিএনএ টেস্টের রিপোর্ট অনুযায়ী নাজমুল নজরুল ইন্ডাস্ট্রিজের মালিক নজরুল ইসলামের ছেলে। চার সন্তানের মধ্যে নাজমুল ছিলও দ্বিতীয়।
সিআইডির ফরেনসিক বিভাগের ডিআইজি নাহিদুল ইসলাম বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘শিগগিরই রিপোর্টের ফাইল তৈরি হলে আমরা তা হস্তান্তর করব পুলিশের কাছে। কিন্তু সেনসেটিভ ঘটনা হওয়ায় দু’টি লাশের পরিচয়ের কথা আমরা পুলিশকে জানিয়েছি।’
পরিচয় নিয়ে সঙ্কট যে কারণে
ওই নারী সাংবাদিক গত আট মাস ধরে নির্বাচন কমিশন বিটের সংবাদ সংগ্রহ করতেন। দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের পর ফেব্রুয়ারিতে তিনি ওই প্রতিষ্ঠানের চাকরি ছেড়ে দেন। তার যোগ দেয়ার কথা ছিলও আরেকটি সংবাদ মাধ্যমে।
তার সহকর্মীরা জানান, গত বৃহস্পতিবার রাতে রাজধানীর বেইলি রোডে গ্রিন কোজিতে অগ্নিকাণ্ডের সময় তিনি তার বন্ধু তুষার হালদারসহ ছিলেন ওই ভবনে। রাতের পর থেকে তার আর কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না।
শুক্রবার সকালে রাজধানীর শেখ হাসিনা বার্ন ইন্সটিটিউটের মর্গে পাওয়া যায় তার বন্ধু তুষার হালদারের লাশ। এর কিছুক্ষণ পর সহকর্মীরা ওই নারী সাংবাদিকের লাশ শনাক্ত করেন শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ইন্সটিটিউটে।
লাশ শনাক্তের পর তার পরিবারের সদস্যদের সাথে তাৎক্ষণিক যোগাযোগের চেষ্টা করে সহকর্মীরা। তার বায়োডাটায় দেয়া ঠিকানা অনুযায়ী যোগাযোগের চেষ্টা করেন সহকর্মীরা। কিন্তু সেখানে কেউ তার কোনো ঠিকানা দিতে পারেনি।’
পরবর্তীতে তার গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়ার খোকসা থানার বনগ্রামে যোগাযোগ করা হয়। কয়েক দফার চেষ্টার পর দুপুরের দিকে তার বাবার নম্বর পেয়ে সহকর্মীরা যোগাযোগ করে। দুপুরের পর শেখ হাসিনা বার্ন ইন্সটিটিউটে ছুটে আসেন এক ব্যক্তি।
তখন ওই ব্যক্তি জানান তার নাম সাবরুল আলম সবুজ। তিনি নিহত ওই তরুণীর লাশ দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন। শনাক্ত করেন লাশটি তার মেয়ের।
তিনি তখন জানান, ‘ওর নাম অভিশ্রুতি না বৃষ্টি খাতুন। গ্রামে নাম বৃষ্টি, স্কুলে নাম বৃষ্টি, কুষ্টিয়া গভর্নমেন্ট মহিলা কলেজে যখন পড়েছে তখনো নাম বৃষ্টি, ইডেনে ভর্তিও হয়েছিল একই নামে।’
তখন তার নাম বৃষ্টি খাতুন বলার পর বিষয়টি নিয়ে একটা ধোঁয়াশা তৈরি হয়। তখন সাবরুল আলম সবুজ তার নিজের ও মেয়ের জাতীয় পরিচয়পত্রসহ অন্যান্য তথ্যও দেখান পুলিশ ও উপস্থিত সহকর্মীদের।
নাম নিয়ে বিভ্রান্তির কারণ কী?
সাংবাদিকতা পেশায় ওই নারী সাংবাদিককে সবাই অভিশ্রুতি শাস্ত্রী নামেই চিনতেন। সেই নামেই খবর লিখতেন। তার ফেসবুক নামও বাংলায় আছে ‘অভিশ্রুতি শাস্ত্রী’ নামে।
ওই নারী সাংবাদিকের জন্ম নিবন্ধন সনদ, জাতীয় পরিচয়পত্র, ইডেন কলেজের তথ্য এবং চাকরির জন্মবৃত্তান্তে বাবা-মায়ের নামে বিভিন্ন রকম তথ্য পাওয়া গেছে। তবে স্থায়ী ঠিকানা সব জায়গায় একই।
বৃষ্টি খাতুনের জাতীয় পরিচয়পত্র থেকে দেখা যায়, ২০২১ সালের জুলাই মাসে নির্বাচন কমিশন থেকে তার যে জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি হয়েছে সেখানে তার নাম রয়েছে বৃষ্টি খাতুন। আর বাবার নাম সাবরুল আলম আর মায়ের নাম বিউটি বেগম।
মেয়ে মারা যাওয়ার পরদিন সাবরুল আলম সবুজ বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘অভিশ্রুতি ওর নিজের দেয়া নাম। ওটা সাজানো নাম। গ্রাম, স্কুল কলেজ সব জায়গায় ওকে বৃষ্টি নামেই চেনে।’
নির্বাচন কমিশনের তথ্যে দেখা যায়, ২০২৩ সালে নির্বাচন কমিশনে তার পুরনো জাতীয় পরিচয়পত্র বা এনআইডি সংশোধনের আবেদন করেন।
সেখানে তিনি তার ‘বৃষ্টি খাতুন’ নাম সংশোধন করে ‘অভিশ্রুতি শাস্ত্রী’ করার আবেদন করেন। একইসাথে জন্ম নিবন্ধন অনুযায়ী বয়সও দুই বছর কমানোর আবেদন করেন।’
নাম সংশোধন করতে গিয়ে তিনি একটি জন্ম নিবন্ধন সনদ জমা দেন নির্বাচন কমিশনে। যেখানে দেখা যায় তার নাম অভিশ্রুতি শাস্ত্রী, বাবার নাম সাবরুল আলম আর মায়ের নাম বিউটি বেগম। এই সনদে তার জন্ম তারিখ ২৫ ডিসেম্বর ২০০০ সাল।
তবে ওই জন্ম নিবন্ধন সনদটির সত্যতা যাচাই করে দেখা গেছে, সেটি কুষ্টিয়ার আফরোজা খাতুন নামের আরেক নারীর জন্ম সনদ। যার জন্ম তারিখ ২৫ ডিসেম্বর ২০০০ সাল।
ওই জন্ম নিবন্ধন সনদ দিয়ে ‘বৃষ্টি খাতুন’ নাম সংশোধনের আবেদন করলেও নির্বাচন কমিশন থেকে পাওয়া তথ্য খুঁজে দেখা যাচ্ছে, তার এনআইডি সংশোধনের আবেদন এপ্রুভড হয়নি।
ধর্মীয় পরিচয় নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব
বৃষ্টি খাতুন চাকরির জন্য যে জীবন বৃত্তান্ত বা বায়োডাটা প্রস্তুত করেছিলেন, সেখানে তার নাম অভিশ্রুতি শাস্ত্রী এবং বাবা অভিরূপ শাস্ত্রী ও মাতা অর্পণা শাস্ত্রী লেখা রয়েছে। যাতে তার ধর্ম পরিচয়ের জায়গায় লেখা রয়েছে ‘সনাতন’।
তার বন্ধু ও সহকর্মীরা জানান, হিন্দু ধর্ম মেনে পূজা করা কিংবা অন্য ধর্মীয় আচার-রীতি পালনের ছবি ফেসবুক পোস্টে সে প্রচার করতেন।
বেইলি রোডের অগ্নিকাণ্ডের পরদিন সকালে ওই নারী সাংবাদিকদের লাশ শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইন্সটিটিউটে শনাক্তের পর দুপুরের দিকে সেখানে যান রমনা কালি মন্দিরের সভাপতি উৎপল সাহা। সেখানে ওই নারী সাংবাদিকের বাবা ও পরিবারের সদস্যরা তাকে মুসলিম দাবি করলে তখন সনাতন ধর্মাবলম্বীরা বিষয়টি নিয়ে ক্ষুব্ধ হন। তখন সাবরুল আলম সবুজকে পুলিশ আটকও করে পরে আবার ছেড়ে দেয়।
তখন রমনা কালি মন্দিরের সভাপতি উৎপল সাহা বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘মেয়েটা আমাদের মন্দিরে আসতো, পূজা দিতো। সব সময় তুলশী মালা পড়তো। আমাদের ঠাকুর কর্তা তাকে পূজা দেয়াতো।’
এ কারণেই সেদিন রাতে মূলত রমনা কালি মন্দির কর্তৃপক্ষ থানায় একটি লিখিত আবেদনে করে জানায়, ওই নারী সাংবাদিক হিন্দু ধর্মে বিশ্বাসী। কিন্তু তার পরিবার তাকে মুসলিম দাবি করার কারণেই তারা পরিচয় শনাক্ত না করে হস্তান্তরে আপত্তি জানিয়েছে।
দু’দিন পরে গত ৩ মার্চ রমনা কালি মন্দিরের সভাপতি উৎপল সাহা বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘এটা এখন আমাদের কাছে অনেকটাই স্পষ্ট যে সে আসলে কে। আমরা চাই তার বাবার কাছে তাকে ফিরিয়ে দেয়া হোক। আমরা জানতাম না বলেই সেখানে গিয়েছিলাম।’
সূত্র : বিবিসি
Leave a Reply