একটি সুখী পারিবারিক জীবন গড়ার মাধ্যম হলো বিয়ে। শান্তিময় পরিবার গঠন, মানসিক প্রশান্তি লাভের মাধ্যম হচ্ছে বিয়ে। আর বিয়ের অন্যতম শর্ত হলো দেনমোহর।
কোনো নারী তার সাথে বিয়েবন্ধনের কারণে সে তার স্বামীর ওপর যে মালের হকদার হয়, তাই দেনমোহর। দেনমোহর ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ ফরজ। কিন্তু এ বিষয়ে আমাদের সমাজে চরম অজ্ঞতা ও শৈথিল্য বিরাজমান।
ইসলামী আইনে বিয়ে বৈধ হওয়ার জন্য দেনমোহর আদায় করা অন্যতম শর্ত। মোহর পুরুষের জন্য একটি ফরজ বিধান যাতে ফাঁকি দেয়ার কোনো সুযোগ নেই এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি লেনদেন। দেনমোহর একটি ঋণ বিশেষ। এটি পরিশোধ করা অত্যন্ত জরুরি। অন্যান্য ওয়াজিব ঋণ যেমন সন্তুষ্টচিত্তে পরিশোধ করা হয়, স্ত্রীর মোহরের ঋণও তেমনি সন্তুষ্টচিত্তে, উদার মনে জরিমানা মনে না করে পরিশোধ করা কর্তব্য।
আল্লাহ তায়ালা বলেন-‘আর তোমরা তোমাদের স্ত্রীদের মোহর দিয়ে দাও খুশি মনে। তারা যদি খুশি হয়ে তা থেকে অংশ ছেড়ে দেয়, তবে তা তোমরা স্বাচ্ছন্দ্যে ভোগ করো।’ (সূরা আন নিসা, আয়াত-৪)
দেনমোহর নারীর প্রাপ্য অধিকার। তার স্বতঃস্ফূর্ত সম্মতি ছাড়া অন্য কারো তাতে হস্তক্ষেপের সুযোগ নেই। স্বামী স্ত্রীকে দেনমোহর থেকে বঞ্চিত করতে কিংবা পরিশোধ করার পর ফেরত নিতে পারে না।
রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘সাবধান! জুলুম করো না। মনে রেখো, কারো পক্ষে অন্যের সম্পদ তার আন্তরিক তুষ্টি ব্যতীত গ্রহণ করা হালাল হবে না।’ (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস-২০২৫৯)
দেনমোহরের পরিমাণ : দেনমোহরের সর্বোচ্চ কোনো পরিমাণ শরিয়তে নির্ধারিত নেই। পুরুষ তার সামর্থ্যানুযায়ী যত খুশি দেনমোহর নির্ধারণ করতে পারবে। দুই পক্ষের আলাপের ভিত্তিতে দেনমোহরের পরিমাণ নির্ধারণ করা উত্তম। বরের সামর্থ্যরে দিক বিবেচনায় রেখে ঠিক করা জরুরি।
আর মোহরে ফাতেমি হলো হজরত ফাতেমা রা:-এর বিয়ের সময় যে মোহর নির্ধারিত হয়েছিল। যার পরিমাণ ছিল পাঁচশত দিরহাম। (তবকাতে কুবরা-৮/২২)
যা বর্তমান ওজন অনুপাতে ১৩১.২৫ তোলা বা ১.৫৩০৯ কিলোগ্রাম রুপা। এক দিরহামের ওজন হলো ৩.০৬১৮ গ্রাম, বর্তমানে প্রতি তোলা রুপার মূল্য এক হাজার ২০০ টাকা হলে মোহরে ফাতেমির মূল্য হয় এক লাখ ৫৭ হাজার ৫০০ টাকা।
মোহরে ফাতেমি শরিয়ত নির্ধারিত কোনো পরিমাণ নয় যে এর চেয়ে কমবেশি করা শরিয়তে অপছন্দনীয়। স্বামী যদি মোহরে ফাতেমির চেয়ে বেশি দেনমোহর দেয়ার সামর্থ্য রাখে, তাহলে মোহরে ফাতেমি নির্ধারণের দ্বারা স্ত্রীকে ঠকানো হয়।
আর স্বামী যদি মোহরে ফাতেমি দেয়ার সামর্থ্য না রাখে তাহলে অভিভাবকদের জোরপূর্বক মোহরে ফাতেমি নির্ধারণ করাটা স্বামীর ওপর জুলুম। তবে উভয়পক্ষ যদি পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে নির্ধারণ করে এবং মনে করে যে রাসূল সা:-এর নির্ধারিত পরিমাণটি বরকতপূর্ণ তাই তা গ্রহণ করা ভালো। তাহলে তা প্রশংসনীয়।
আমাদের সমাজে দেনমোহরের বহুবিধ কুপ্রথা প্রচলিত আছে যার ফিরিস্তি অনেক লম্বা। অনেক সময় তো মোহর শুধু নামমাত্র কাবিননামায় উল্লেখ থাকে, তা আদায়ের কোনো নিয়তই থাকে না।
রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘যে বিয়ে করল এবং দেনমোহর শুধু ধার্য করল কিন্তু তার অন্তরে দেনমোহর আদায় করার নিয়ত নেই, তাহলে আল্লাহর দরবারে তাকে জিনাকারী হিসেবে গণ্য করা হবে।’ (মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক-৬/১৮৫)
দেনমোহরের সর্বনিম্ন পরিমাণ : হানাফি মাজহাবে দেনমোহরের সর্বনিম্ন পরিমাণ হলো ১০ দিরহাম, যা বর্তমান ওজন অনুপাতে দুই তোলা সাড়ে সাত মাশা বা ৩০.৬১৮ গ্রাম রুপা।
বর্তমানে প্রতি তোলা রুপার মূল্য দেড় হাজার টাকা হলে ১০ দিরহামের মূল্য দাঁড়ায় তিন হাজার ৯৩৮ টাকা। সর্বনিম্ন পরিমাণ দেনমোহর নির্ধারিত থাকার উদ্দেশ্য এই নয় যে, সর্বনিম্ন পরিমাণ মোহর নির্ধারণ করা শরিয়তে প্রশংসনীয়; বরং এর উদ্দেশ্য হলো যে এর চেয়ে কমে স্ত্রী রাজি হলেও জায়েজ।
সর্বনিম্ন পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়েছে সমাজের নিঃস্ব ব্যক্তিরাও যাতে বিয়ে করতে পারে। কিন্তু আমাদের সমাজের সামর্থ্যবান কিছু মানুষের মধ্যেও এই প্রবণতা বিদ্যমান যে, দেনমোহর কম দিয়ে নারীকে যত ঠকানো যায়। শরিয়তে এটি প্রশংসনীয় নয়। সমাজে এমন মন-মানসিকতার লোক ভূরি ভূরি। দেনমোহর নারীর জন্য সম্মান ও মর্যাদার প্রতীক। প্রত্যেক স্বামীরই উচিত তার আর্থিক সামর্থ্যানুযায়ী স্ত্রীকে যথাযথ সম্মান দেখানো।
মোহর নিয়ে বাড়াবাড়ি যেমন ঠিক নয়, তেমনি ছাড়াছাড়িও ঠিক নয়। আমাদের সবার উচিত উভয়পক্ষের আলাপের ভিত্তিতে এ পরিমাণ মোহর ধার্য করা, যাতে স্ত্রী না ঠকে এবং স্বামীর আদায় করতেও কষ্ট না হয়।
লেখক :
শিক্ষক, জামিয়া মিফতাহুল উলুম, নেত্রকোনা
Leave a Reply