নির্বাচন পরবর্তীতে আওয়ামী লীগের নৌকা এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্যকার সংঘাত-সহিংসতা মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। আসন ও এলাকাভেদে বিজয়ী প্রার্থীর লোকজন পরাজিত প্রার্থীর লোকজনের ওপর এবং তাদের বাড়িঘরে হামলা ও ভাঙচুরসহ নিষ্ঠুর সহিংসতা চালাচ্ছে। নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার এক সপ্তাহের বেশি সময় পার হলেও সংঘাত কোনোভাবেই থামছে না। এমনকি ওই সংঘাত-সহিংসতা থামাতে হিমশিম খাচ্ছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। কেন্দ্রীয় নির্দেশনা না মানায় বিএনপিবিহীন নির্বাচনেও প্রতিপক্ষকে ভোট দেয়ার জন্য অসংখ্য মানুষের এ ধরনের ভোগান্তি নিয়ে উদ্বেগ উৎকণ্ঠার পাশাপাশি বিব্রতবোধ করছে আওয়ামী লীগ। সহিংসতার মাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়ায় তৃণমূল আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে বড় ধরনের বিভাজনের আশঙ্কাও করছেন রাজনীতি বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ।
বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর ও সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, নির্বাচন পরবর্তী আওয়ামী লীগের প্রার্থী ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্যে ঝিনাইদহ সদর, কুষ্টিয়ার কুমারখালী, শরিয়তপুরের ভেদরগঞ্জ, মাদারীপুরের কালকিনী, জামালপুরের সরিষাবাড়ী, মেহেরপুর, টাঙ্গাইল, নেত্রকোনা, নোয়াখালী, মুন্সীগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, রাজশাহী, পিরোজপুর, খুলনাসহ বেশ কয়েকটি জেলায় শতাধিক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। আওয়ামী লীগ ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের কর্মী সমর্থকদের মধ্যকার এসব সহিংসতায় গতকাল পর্যন্ত তিনজন নিহত এবং দুইশতাধিক মানুষ আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এর মধ্যে মাদারীপুর-৩ আসনের কালকিনিতে নৌকার সমর্থক ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বাবুল বেপারীর বাড়িসহ বেদে সম্প্রদায়ের অন্তত ১৮টি ঘর ভাঙচুর ও লুটের অভিযোগ উঠেছে বিজয়ী স্বতন্ত্র প্রার্থী তাহমিনা বেগমের সমর্থকদের বিরুদ্ধে। গত ১৪ জানুয়ারি নোয়াখালী-২ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করা আতাউর রহমান ভূঁইয়ার একজন পোলিং এজেন্টকে হত্যা করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন ওই স্বতন্ত্র প্রার্থী। এর আগে ঝিনাইদহে একজন আওয়ামী লীগ কর্মীর নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। নিহত ব্যক্তি ঝিনাইদহ-২ আসনে পরাজিত নৌকার প্রার্থী তাহজীব আলম সিদ্দিকীর সমর্থক ছিলেন। ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে নেত্রকোনা-৩ আসনে পরাজিত হন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সংস্কৃতিবিষয়ক সম্পাদক অসীম কুমার উকিল। স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচনে জয়ী হয়ে ইফতিকার উদ্দিন তালুকদারের কর্মী সমর্থকরা মিছিল বের করলে তাতে অসীম কুমার উকিলের কর্মী সমর্থকদের বিরুদ্ধে হামলার অভিযোগ উঠে। হামলায় মারাত্মকভাবে আহত হয়ে পরদিন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে একজন মারা যান। অবশ্য ওই ঘটনার সাথে অসীম কুমার উকিলের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই বলে দাবি করেন। তিনি জানান, বিভিন্ন জায়গায় তারা তার কর্মী সমর্থকদের ওপর হামলা নির্যাতন করছে।
নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতার মধ্যে একটি জেলা মানিকগঞ্জ। মানিকগঞ্জ-২ আসনে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকের প্রার্থী কণ্ঠশিল্পী মমতাজ বেগমকে হারিয়ে নির্বাচনে জয়ী হন জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও স্বতন্ত্র প্রার্থী দেওয়ান জাহিদ আহমেদ। নির্বাচনে হারার পর প্রতিপক্ষ স্বতন্ত্র প্রার্থীর কর্মী সমর্থকরা মানিকগঞ্জের বিভিন্ন জায়গায় নৌকার সমর্থক নেতাকর্মীদের ওপর হামলা ও নির্যাতন চালাচ্ছে বলে গণমাধ্যমের কাছে অভিযোগ করেন পরাজিত প্রার্থী মমতাজ বেগম। তিনি বলেন, নৌকার পক্ষে যারা কাজ করেছে তারা কেউ বাড়ি ঘরে থাকতে পারছে না। মুন্সীগঞ্জ-৩ আসনে নৌকা মার্কার আরেক পরাজিত প্রার্থী ও কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের মুক্তিযোদ্ধাবিষয়ক সম্পাদক মৃণাল কান্তি দাস ভোটের পর থেকেই প্রতিপক্ষ স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকরা নৌকা প্রার্থীর সমর্থকদের ওপর হামলা নির্যাতন চালাচ্ছে বলে অভিযোগ করেন। তিনি বলেন, ভয়ে অনেকে ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, সারা দেশে দুইশ’রও বেশি আসনে স্বতন্ত্রভাবে প্রার্থী হয়েছিলেন আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা ও কেন্দ্রীয় কমিটির কেউ কেউ। এর মধ্যে ৬২টি আসনে নৌকার প্রার্থীদের হারিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জয় তুলে নেন। আওয়ামী লীগের যারা স্বতন্ত্র হিসেবে জয়ী হয়েছেন তারা স্থানীয় আওয়ামী লীগেরও বেশ প্রভাবশালী। আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র যারা জয়ী হয়েছেন তাদের সাথে আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের নির্বাচনের সময় তৈরি হওয়া বিভেদ নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতায় রূপ নিয়েছে। এ ছাড়াও যেসব আসনে নৌকা ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি প্রতিযোগিতা হয়েছে ওই সব আসনে সংঘাত সংঘর্ষের সংখ্যা বেশি বলে মনে করা হচ্ছে।
নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতার একটি চিত্র তুলে ধরেছে বেসরকারি সংস্থা হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি। তাদের হিসাব অনুযায়ী, নির্বাচনের পর গত সোমবার পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন জেলায় সংঘাত ও সংঘর্ষে অন্তত ৬ জন নিহত হয়েছেন। এসব ঘটনায় আহত হওয়ার সংখ্যা চার শ’ জনেরও বেশি। গুলিবিদ্ধ হয়েছেন অন্তত ৬০ জন। তাদের হিসাব মতে, অন্তত ১৮টি জেলায় সংঘাত-সহিংসতার ঘটনায় দুইশ’র বেশি বাড়ি ঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে।
এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের অন্যতম যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম মনে করেন, অতীতের নির্বাচনী ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে নির্বাচনে যে সংঘাত-সহিংসতা হয়, তার চেয়ে এবার অনেক কম হয়েছে। তিনি বলেন, নির্বাচনে জয় পরাজয় থাকবে। ভোটে জয় বা পরাজয়ের কারণে কোনো ধরনের উসকানিমূলক বা একজন আরেকজনের ওপর হামলা ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। নির্বাচনের পরে কোনো ধরনের সহিংসতা, মারামারি করা যাবে না, এ নিয়ে দলের স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। যারা এগুলো করছে অবশ্যই তাদের সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও প্রবীণ রাজনীতিক অ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন মনে করেন, নির্বাচন পরবর্তী যে সংঘাত-সহিংসতাগুলো হচ্ছে তা বেশিরভাগ আসনভিত্তিক ও অঞ্চলভেদে। এটা কোনোভাবেই কাম্য নয়। দলীয়ভাবে এদের চিহ্নিত করা প্রয়োজন এবং যারা এগুলো করছে তাদের শাস্তির আওতায় আনা উচিত। তিনি গতকাল নয়া দিগন্তকে আরো বলেন, পাঁচ বছর পরপর জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এখানে একজনকে দলীয় মনোনয়ন দেয়া হয়। তবে এবার বিএনপি অংশগ্রহণ না করায় দলের অন্যদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করার সুযোগ দেয়া হয়েছে। কিন্তু নির্বাচনে হেরে গিয়ে প্রতিহিংসাবশত অন্যের ওপর হামলা চালানো, বাড়ি-ঘর ভাঙচুর করা বা জয়ী হয়ে প্রতিশোধ গ্রহণ করা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
Leave a Reply