দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের নৌকা মার্কার প্রার্থী ও আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-বিবাদ, সঙ্ঘাত ও সংঘর্ষ মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। দীর্ঘদিন জিইয়ে থাকা অভ্যন্তরীণ কোন্দল প্রকাশ্য রূপ নেয়ায় নির্বাচনী প্রচারণার প্রথম দিন থেকেই কোনো না কোনো আসনে দলীয় প্রার্থী ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর নেতাকর্মীদের মধ্যে মারামারি হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে। ভোটের মাঠে প্রার্থীদের শক্ত অবস্থান জানান দেয়া এবং আগের অবস্থান ধরে রাখা- এ দু’টি বিষয়কে কেন্দ্র করেই মূলত তৃণমূল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী বিভক্ত হয়ে পড়েছে। তৃণমূলে এখন আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগই। এভাবে দ্বন্দ্ব সঙ্ঘাত চলতে থাকলে আগামী ৭ জানুয়ারি বিএনপি-জামায়াতবিহীন জাতীয় সংসদ নির্বাচনও সুষ্ঠু হওয়া নিয়ে বড় ধরনের আশঙ্কা করছেন অনেকেই।
গত এক সপ্তাহে গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও সংশ্লিষ্ট সূত্র বিশ্লেষণ করে জানা গেছে, নির্বাচনী প্রচারণা শুরুর দিন থেকে গতকাল পর্যন্ত অর্ধশতাধিক জায়গায় হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে এবং একজন নিহত হয়েছেন। গেল সোমবার গাজীপুর-১ আসনে বোয়ালি ইউনিয়নের গাছবাড়ি এলাকায় স্বতন্ত্র প্রার্থী রেজাউল করিমের নির্বাচনী পথসভায় আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থীর কর্মীদের বিরুদ্ধে হামলার অভিযোগ পাওয়া গেছে। একই দিনে শরীয়তপুর-২ আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী পানিসম্পদ উপমন্ত্রী এনামুল হক শামীম ও স্বতন্ত্র প্রার্থী যুবলীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য খালেদ শওকত আলীর সমর্থকদের মধ্যে হামলা, সংঘর্ষ ও নির্বাচনী ক্যাম্প ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় আওয়ামী লীগের নৌকা মার্কার প্রার্থীর সমর্থক উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি আসাদুজ্জামান বিপ্লব গতকাল মঙ্গলবার নড়িয়া থানায় একটি মামলাটি করেন। মাদারীপুর-৩ আসনে গেল শনিবার সংরক্ষিত নারী আসনের এমপি ও কালকিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি তাহমিনা বেগমের কর্মী এসকেন্দার খাঁকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে হত্যার অভিযোগ উঠেছে সরকারদলীয় এমপির সমর্থকদের বিরুদ্ধে। স্বতন্ত্র এই প্রার্থীর কর্মীদের মিছিলে গত বৃহস্পতিবার হাতবোমা হামলা হয়েছিল।
গত শুক্রবার মুন্সীগঞ্জ-৩ আসনে সদর উপজেলার মোল্লাকান্দি ইউনিয়নের আনন্দপুর গ্রামে রাতে স্বতন্ত্র প্রার্থী মোহাম্মদ ফয়সালের সমর্থক হেবা মোল্লা নামের এক ব্যক্তির বাড়িতে গুলি করার ঘটনা ঘটে। ওই দিন রাতে গোপালপুর ইউনিয়নের বিরেন সাহার মোড়ে ফরিদপুর-৩ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী এ কে আজাদের সমর্থকদের ওপর এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। হামলায় এ কে আজাদের পাঁচ সমর্থক আহত হন। নেত্রকোনা-১ আসনে শনিবার সংবাদ সম্মেলন করে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মোশতাক আহমেদ ও তার সমর্থকদের বিরুদ্ধে প্রচারে বাধা, পোস্টার ছেঁড়া, হামলাসহ কয়েকটি অভিযোগ করেন স্বতন্ত্র প্রার্থী জান্নাতুল ফেরদৌস আরা। নাটোর-১ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী শহিদুল ইসলামের কর্মী কুদরত ই খুদা ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থী আবুল কালামের সমর্থক লিমন ও তার বাবাকে বাবাকে মারধর করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। গত ১৯ ডিসেম্বর মঙ্গলবার পৃথকভাবে পৃথক সময়ে জামালপুরের সরিষাবাড়ী, ময়মনসিংহের নান্দাইল ও যশোরের বেনাপোলে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর সমর্থক ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। প্রতীক বরাদ্দের পর ১৮ডিসেম্বর মুন্সীগঞ্জ-৩, ঝিনাইদহ-২ ও নাটোর-১ আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী ও দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্যে মারামারি, হামলা ও সংঘর্ষ হয়েছে। এ ছাড়াও কুমিল্লা-১১ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থীর প্রচারণায় বাধা দেয়াসহ কর্মীকে মারধর ও অবৈধ অস্ত্র দিয়ে হুমকি দেয়ার অভিযোগ উঠেছে। লালমনিরহাট-১ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকদের ওপর হামলা ও নির্বাচনী অফিস ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। লক্ষ্মীপুর-২ আসনের এক স্বতন্ত্র প্রার্থীর প্রচারণায় মাইক ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। গত রোববার টাঙ্গাইল-৫ আসনে নৌকার মিছিলে স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকের গুলিতে যুবলীগ নেতাসহ তিনজন আহত হন। এ ছাড়াও কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, পটুয়াখালীসহ প্রায় প্রত্যেক আসনেই অভ্যন্তরীণ কোন্দল প্রকাশ্য রূপ নিয়েছে।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, এমনিতেই নির্বাচন হচ্ছে মাঠের প্রধানবিরোধী দল বিএনপিবিহীন। তবুও আসন ভাগাভাগির নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা বিভক্ত হয়ে দ্বন্দ্ব বিবাদে জড়িয়ে পড়ছে। হামলা মামলার ঘটনা বিএনপিবিহীন নির্বাচনেও সুষ্ঠু নির্বাচনে অনেকাংশে বাধা। এ দিকে আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, বিএনপি ভোটে অংশগ্রহণ করলে রাজনৈতিকভাবে ঐক্যবদ্ধ থাকত আওয়ামী লীগ। দলীয় প্রার্থীকে জিতিয়ে আনতে সবাই সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালাত। কিন্তু এবারের প্রেক্ষাপট একটু ভিন্ন। বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করায় আন্তর্জাতিক বিশ্বকে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দেখাতে গিয়ে দলের মনোনয়ন বঞ্চিত প্রার্থীদের স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করার সুযোগ করে দেয়া হয়েছে। এ জন্য তারা অবাধে নির্বাচনী প্রচারণা চালাচ্ছে। একপর্যায়ে দলীয় প্রার্থীরা তাদের অবস্থান ধরে রাখার জন্য এবং মনোনয়ন বঞ্চিত স্বতন্ত্র প্রার্থীরা তাদের শক্তি প্রদর্শন করতে গিয়ে দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাতে জড়িয়ে পড়ছে।
এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের অন্যতম সদস্য ও প্রবীণ রাজনীতিক অ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন গতকাল নয়া দিগন্তকে বলেন, অতীতের চেয়ে এবার দলের অভ্যন্তরীণ সঙ্ঘাত সংঘর্ষ বেশি হচ্ছে। দীর্ঘদিন পর দলের মনোনয়ন বঞ্চিতরা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করার সুযোগ পেয়েছে। স্বাভাবিকভাবে তারা বেশি বেশি করে নির্বাচনী প্রচারণা চালানোর চেষ্টা করছে। এভাবে ভোটের মাঠে শক্তি প্রদর্শন করতে গিয়ে মূলত এক ধরনের অনাকাক্সিক্ষত ও অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটছে। তিনি বলেন, এটা বেশি দিন হয়তো থাকবে না। শেষ পর্যন্ত ঠিক হয়ে যাবে। আগামী দুই-চার দিন পর অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষ, হামলা ও সঙ্ঘাত কমে আসবে।
এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট রাজনীতি বিশ্লেষক গোলাম মাওলা রনি নয়া দিগন্তকে বলেন, আওয়ামী লীগ আসলে রাজনৈতিকভাবে দেউলিয়া হয়ে গেছে। বিএনপিকে কোণঠাসা করতে গিয়ে শুধু প্রতিপক্ষ নয়, নিজেরা নিজেদের ক্ষতিগ্রস্ত করছে। তিনি বলেন, বিএনপি ভোটের মাঠে থাকলেও আওয়ামী লীগের মধ্যে এ ধরনের মারামারি, হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটত, তবে সেটা ভিন্নরূপে ভিন্ন মাত্রায় হতো। আর বিএনপি মাঠে না থাকায় এটা প্রকাশ্য রূপ নিয়েছে, ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। অন্য কোনো দল শক্তভাবে না থাকায় এখন মাঠে আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগই।
Leave a Reply