নির্দলীয় সরকারের অধীনে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিকে কেন্দ্র করে সরকারি দল ও বিএনপিসহ সমমনা রাজনৈতিক দলগুলো এখন মুখোমুখি অবস্থানে। হরতাল-অবরোধের মতো চূড়ান্ত পর্যায়ের কর্মসূচিতে রয়েছে বিরোধী দলগুলো। ইতোমধ্যেই রাজনীতি সঙ্ঘাতে গড়িয়েছে। ঘটেছে হতাহতের ঘটনা। সরকারের পক্ষ থেকে অসংখ্য মামলা দায়ের করা হয়েছে। বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে গ্রেফতার অভিযান চলছে। অন্যদিকে বিরোধী দলগুলো নতুন করে একের পর এক কঠোর কর্মসূচি পালন করছে। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মহল থেকে শর্তহীন সংলাপের ওপর গুরুত্বারোপ করা হলেও সরকারি দলের পক্ষ থেকে সংলাপের বিষয় নাকচ করে দেয়া হয়েছে। বিরোধী দলও এক দফা দাবির ওপর কেবল সংলাপে রাজি থাকার শর্ত দিয়ে আসছে। এই অবস্থায় দেশের রাজনৈতিক সঙ্কট আরো ঘনীভূত হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। দুই পক্ষের অনড় অবস্থানে সাধারণ মানুষের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বাড়ছে। পরিস্থিতির আরো অবনতি ও জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, জনদুর্ভোগ লাঘবে সঙ্কট নিরসনে সংলাপের জন্য সরকারি দলকেই উদ্যোগ নিতে হবে। নিবর্তনমূলক কর্মকাণ্ড থেকে সরকারকে সরে আসতে হবে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, সংলাপের পথ যদি রুদ্ধ হয়ে যায় তাহলে সমাধানের কোনো পথ দেখছি না। জনদুর্ভোগ কমাতে সংলাপের জন্য সরকারকেই উদ্যোগ নিতে হবে। নিবর্তনমূলক কর্মকাণ্ড থেকে সরকারকে সরে আসতে হবে।
গত ২৮ অক্টোবর রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির মহাসমাবেশের সময় সংঘর্ষের ঘটনার পর একদিনের হরতাল পালন এবং অবরোধ কর্মসূচিতে রয়েছে বিএনপি-জামায়াত ও অন্যান্য সমমনা দল। আগামীকাল রোববার থেকে তাদের ডাকা দ্বিতীয় দফায় ৪৮ ঘণ্টার অবরোধের কর্মসূচি শুরু হচ্ছে। রাজনৈতিক কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে সঙ্ঘাত-সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। ইতোমধ্যেই একজন পুলিশসহ বেশ কয়েকজন নিহত হয়েছেন। সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য বিরোধী দলগুলো যে দাবি জানিয়ে আসছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ তা নাকচ করে সরকারি দলের অধীনেই নির্বাচন অনুষ্ঠানের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে। সরকার বিরোধী দলের দাবি উপেক্ষার পাশাপাশি কঠোর মনোভাব দেখাচ্ছে। বিরোধী দলের আন্দোলন ও সংঘর্ষকে কেন্দ্র করে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, শীর্ষ নেতা মির্জা আব্বাস, আমীর খসরু মাহমুদসহ বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। রাজধানীসহ সারা দেশে গ্রেফতার করা হয়েছে অসংখ্য নেতাকর্মীকে।
এর মধ্যেও দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়ে কর্মসূচিতে রয়েছে বিরোধী দলগুলো। একদিন হরতালের পর তিন দিনের অবরোধ কর্মসূচিতে সারা দেশে নেতাকর্মীরা বিক্ষোভ মিছিল পিকেটিংয়ে অংশ নিয়েছেন। টানা তিন দিন রাজধানী থেকে সারা দেশ প্রায় বিচ্ছিন্ন ছিল। খোদ রাজধানীতেও রাস্তাঘাট অনেকটাই ফাঁকা ছিল। বিরোধী দলের পাশাপাশি সরকারি দলও রাজপথে সমাবেশ করে যাচ্ছে। ফলে কোথাও কোথাও ত্রিমুখী সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে।
যুক্তরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক মহল শর্তহীন সংলাপের মাধ্যমে সঙ্কট নিরসনের আহবান জানিয়ে আসছে। কিন্তু সরকারি দল আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সংলাপের আহ্বান নাকচ করে দেয়া হয়েছে। এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিএনপির সাথে সংলাপের সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী বৃহস্পতিবার সংসদ অধিবেশনের সমাপনী বক্তব্যেও একই ধরনের মনোভাব ব্যক্ত করেছেন। অন্যদিকে বিরোধী দলও এবার একতরফাভাবে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে দেয়া হবে না বলে হুঁশিয়ারি দিয়ে আসছে।
দুই পক্ষের এই মুুখোমুখি অবস্থানে দেশের রাজনৈতিক সঙ্কট আরো ঘনীভূত হওয়ার আশঙ্কা করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, দুই দলের এই অনড় ও মুখোমুখি অবস্থানে ভোগান্তির শিকার হবে দেশের সাধারণ মানুষ। ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশের অর্থনীতি। দেশ ও মানুষের স্বার্থেই উভয়পক্ষকে সংলাপে বসে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করতে হবে। এক্ষেত্রে সরকারি দলকেই উদ্যোগী ভূমিকা পালন করতে হবে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার নয়া দিগন্তকে বলেন, যেকোনো সঙ্কট সমাধানের একমাত্র উপায় হচ্ছে আলোচনা বা সংলাপ। কিন্তু দুই দলের অনড় অবস্থানে আপাতত মনে হচ্ছে না আলোচনার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে সঙ্কটের সমাধান হবে। সংলাপের পথ যদি রুদ্ধ হয়ে যায় তাহলে তো সমাধানের কোনো পথ দেখছি না। জনদুর্ভোগ কমাতে সংলাপের জন্য সরকারকেই উদ্যোগ নিতে হবে। নিবর্তনমূলক কর্মকাণ্ড থেকে সরকারকে সরে আসতে হবে।
রাজনৈতিক দলগুলোর চলমান কর্মসূচির বিষয়ে তিনি বলেন, নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য রাজপথে নেমেছে কয়েকটি রাজনৈতিক দল। রাজপথে নামা দলগুলোকে মোকাবেলার ঘোষণা দিয়েছে সরকারি দল। এতে সামনের দিনে সঙ্কট আরো ঘনীভূত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। কারণ সহিংসতা সহিংসতাই সৃষ্টি করে। তাতে সাধারণ মানুষের মধ্যেও উৎকণ্ঠা বাড়ছে ।
জানতে চাইলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের প্রফেসর ড. আব্দুল লতিফ মাসুম নয়া দিগন্তকে বলেন, শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে সরকার দেশের মানুষকে অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এই সঙ্কটের সমাধান শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে সম্ভব নয়। সমাধানে সরকারই উদ্যোগ নিতে পারে।
সঙ্কট সমাধানের উপায় উল্লেখ করে তিনি বলেন, সংসদ এখন কার্যকর আছে। সরকার চাইলে চলমান সংসদে রাজনৈতিক দলগুলো থেকে দু’জন করে নিয়ে একটি নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করতে পারে। এক্ষেত্রে বিএনপি থেকে টেকনোক্র্যাট কোটায় নির্বাচনকালীন সরকারে নিতে পারে। এ ছাড়া সংবিধানের ১৫তম সংশোধনী কোর্টের মাধ্যমে বাতিল করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহাল করতে পারে। যদি শান্তিপূর্ণ সমাধান না হয় তাহলে দেশ গৃহযুদ্ধের দিকে ধাবিত হতে পারে।
Leave a Reply