ব্রাসেলসে এক বৈঠকের পর গাজায় জরুরী ভিত্তিতে ত্রাণ পৌঁছানোর জন্য ‘মানবিক করিডর এবং যুদ্ধ বিরতির‘ আহ্বান জানাতে সম্মত হয়েছেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতারা।
জাতিসঙ্ঘের মানবিক সহায়তাবিষয়ক প্রধান সতর্ক করে বলেন, গাজায় ত্রাণ খুবই স্বল্প পরিমাণে পৌঁছাচ্ছে। সর্বশেষ গাজায় ত্রাণ সহায়তা নিয়ে আরো ১২টি ট্রাক ঢুকেছে। কিন্তু সেখানে এখনো কোনো জ্বালানি পৌঁছায়নি।
হামাস বলেছে, গাজা উপত্যকায় ইসরাইলের বোমা নিক্ষেপের কারণে হামাসের হাতে আটক কমপক্ষে ৫০ জন জিম্মি নিহত হয়েছে। ৭ অক্টোবর (শনিবার) হামলার জের ধরে তাদের জিম্মি করা হয়েছিল।
হামাসের পরিচালিত স্বাস্থ্য-মন্ত্রণালয় বলেছে, ৭ অক্টোবর (শনিবার) যুদ্ধ শুরুর পর থেকে এখনো পর্যন্ত গাজায় সাত হাজার মানুষ মারা গেছে।
ইসরাইলের যুদ্ধকালীন মন্ত্রীসভার সদস্য বেনি গ্যানটজ বলেন, গাজায় যুদ্ধের পরিকল্পনা নিয়ে ইসরাইল নিজেদের স্বার্থের কথা মাথায় রেখে নিজেরাই সিদ্ধান্ত নেবে এবং সতর্ক করে বলেছে, ইসরাইলের দক্ষিণাঞ্চলে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কয়েক বছর সময় লাগবে।
তেল আবিবে গাজায় হামাসের হাতে আটক জিম্মিদের স্বজনেরা বিক্ষোভ করেছেন। সে সময় তারা জিম্মিদের উদ্ধারে সরকারকে আরো বেশি পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানায়।
জাতিসঙ্ঘে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রদূত রিয়াদ মানসুর ‘বোমা হামলা’ রুখতে এগিয়ে আসতে সব বিশ্ব নেতাদের আহ্বান জানিয়েছেন। অন্যদিকে, জাতিসঙ্ঘের নিযুক্ত ইসরাইলের রাষ্ট্রদূত গিলাদ এরদান বলেন, ইসরাইল ‘শুধুমাত্র হামাসের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত।’
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যেব এরদোগান গাজায় ইসরাইলি হামলা রুখতে না পারার জন্য পশ্চিমাদের অভিযুক্ত করে বলেন, এর কারণ হচ্ছে, যাদের রক্ত ঝরছে তারা মুসলিম।
যুদ্ধে বিরতির আহ্বান
গাজায় বেসামরিক নাগরিকদের কাছে ত্রাণ পৌঁছানোর জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতারা ‘মানবিক করিডর এবং যুদ্ধে বিরতি’ দেয়ার আহ্বান জানিয়েছে।
ব্রাসেলসে এক বৈঠকের পর এক ঘোষণাপত্রে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত ২৭টি দেশের নেতারা ‘গাজায়ক্রমে খারাপ হতে থাকা মানবিক পরিস্থিতি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন।’
তারা ‘গাজায় বিরতিহীন, দ্রুত, নিরাপদ এবং বাধাহীন মানবিক প্রবেশাধিকার চায় এবং অভাবীদের কাছে ত্রাণ পৌঁছানোর জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ যেমন মানবিক করিডর এবং মানবিক প্রয়োজনীয়তা মেটাতে সাময়িক বিরতি চান।’
এই ঘোষণাপত্রে ইউরোপীয় কাউন্সিল, ‘ইসরাইল জুড়ে হামাসের নৃশংস এবং নির্বিচার সন্ত্রাসী হামলার শক্ত ভাষায় আবারো নিন্দা জানায়।’
এতে আরো বলা হয়, ‘সাধারণ মানুষকে হামাসের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করাটা শোচনীয় ও নৃশংস বিষয়।’
সীমান্তে আটকে আছে ত্রাণ
সিনডি ম্যাককেইন ‘মাথা খারাপ করা আমলাতন্ত্র’ বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেন, জাতিসঙ্ঘের খাদ্য কর্মসূচির প্রধান বলেন, মিশর থেকে গাজায় ঢোকার মুখে রাফা সীমান্ত পারাপারে অতিরিক্ত কঠোর তল্লাশির কারণে ত্রাণ সরবরাহ ধীর হয়ে পড়েছে।
তিনি আরো বলেন, তিনি বোঝেন যে অস্ত্র যাতে ঢুকতে না পারে তার জন্য তল্লাশিটা গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু খাদ্যপণ্য প্রবেশ করাটা আরো সহজ হওয়া উচিত।
বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির নির্বাহী পরিচালক বলেন, ‘আমরা মাত্র হাতে গোনা কয়েকটা ট্রাক প্রবেশ করাতে পেরেছি। আমাদের আরো বেশি পরিমাণে ট্রাক প্রবেশ করানো দরকার। গাজায় আমাদের নিরাপদ, অবাধ প্রবেশাধিকার দরকার যাতে আমরা মানুষের মুখে খাবার তুলে দিতে পারি এবং ক্ষুধায় যাতে কেউ মারা না যায় তা নিশ্চিত করতে পারি। কারণ এটাই হচ্ছে।’
কর্মকর্তাদের সাথে সাক্ষাৎ করতে মিশর সফরের সময় ম্যাককেইন বলেন, প্রতিটি ট্রাককে চেকপয়েন্টে তল্লাশির জন্য তাদের মালামাল নামাতে হয়, তল্লাশির পর সেগুলো আবার তুলতে হয়।
সংস্থাটির তথ্য অনুযায়ী, শনিবার ৬০ টন খাদ্যসহ বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির ট্রাকগুলো গাজায় প্রবেশ করেছে। এটি একদিনে প্রায় দুই লাখ মানুষের খাবার সরবরাহ করার জন্য যথেষ্ট।
ইসরাইল সীমান্তে বিস্ফোরণ
মিশরের সংবাদ মাধ্যম ‘আল-কাহেরা’ নিউজ তাদের এক প্রতিবেদনে বলেছে, ইসরাইলের সাথে সীমান্তের পূর্বাঞ্চলে তাবা এলাকায় একটি চিকিৎসা স্থাপনায় একটি বিস্ফোরণ ঘটেছে।
আল-কাহেরা বলছে, একটি ক্ষেপণাস্ত্র হামলার কারণে এই বিস্ফোরণটি ঘটেছে। কিন্তু এটি কারা ছুড়েছে সে বিষয়ে কিছু জানানো হয়নি। এ ঘটনায় ছয়জন আহত হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করে এক সূত্রের বরাত দিয়ে এই সংবাদ মাধ্যমটি দাবি করছে, এই বিস্ফোরণ গাজায় চলমান ইসরায়েল এবং হামাসের যুদ্ধের সাথে সম্পর্কিত। তাবা গাজা থেকে প্রায় আড়াই শ’ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এটি ইসরাইলের সাথে মিশরের দক্ষিণ সীমান্তের কাছে অবস্থিত।
অন্যদিকে, এক প্রত্যক্ষদর্শীর বরাত দিয়ে সংবাদ সংস্থা এএফপি বলেছে, একটি হাসপাতালে রকেট হামলা চালানো হয়েছে।
ইসরাইলের প্রতিরক্ষা বাহিনীর এক মুখপাত্র বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেন, তারা ওই এলাকায় নিরাপত্তা-বিষয়ক ঘটনার কথা শুনছেন এবং সেটা তাদের ‘সীমান্তের বাইরে থেকে’ ঘটেছে।
সিনিয়র হামাস নেতাকে হত্যার দাবি
ইসরাইলি সামরিক বাহিনী দাবি করেছে যে সাত অক্টোবরের হামলার পরিকল্পনাকারীদের মধ্যে জ্যেষ্ঠ এক হামাস নেতাকে হত্যা করা হয়েছে।
ইসরাইলের প্রতিরক্ষা বাহিনী-আইডিএফ বলেছে, ‘সুনির্দিষ্ট তথ্যের‘ ভিত্তিতে তারা শাদি বারুদ এলাকায় হামাসের গোয়েন্দা সশস্ত্র শাখার উপ-প্রধানকে লক্ষ্য করে বিমান হামলা চালানো হয়েছে।
যে বিমান হামলায় তিনি নিহত হয়েছেন বলে দাবি করা হচ্ছে সেটির ভিডিও প্রকাশ করে আইডিএফ বলছে, তিনি ‘ইয়াহিয়া সিনওয়ারের সাথে মিলে অক্টোবরের সাত তারিখে বর্বর হামলার পরিকল্পনা করেছিল।’ ইয়াহিয়া সিনওয়ার গাজা উপত্যকায় হামাস প্রধান।
বিবিসি যুদ্ধক্ষেত্রে এই নিহত হওয়ার খবর এককভাবে যাচাই করতে পারেনি। এ বিষয়ে হামাস এখনো কোনো মন্তব্য করেনি।
হামাসের প্রতিনিধিদল মস্কোতে
রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, যে হামাসের একটি প্রতিনিধিদল আলোচনার জন্য মস্কোতে পৌঁছেছে। রাশিয়া বলেছে, তারা ‘এই সঙ্কট দ্রুত সমাধানে… গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের‘ সাথে আলোচনা করছে তারা।
যুক্তরাজ্যসহ অন্যান্য দেশের মতো রাশিয়া হামাসকে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী বলে না। হামাসের সদস্যরা নিয়মিত মস্কোতে যাতায়াত করে। কিন্তু ৭ অক্টোবর ইসরাইলের দক্ষিণাঞ্চলে হামলার পর থেকে এটি প্রথম সফর।
রাশিয়ার সংবাদ মাধ্যম আরআইএ নভোস্টি জানিয়েছে, এই প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন হামাসের জ্যেষ্ঠ নেতা মুসা আবু মারজুক যিনি কাতারের দোহায় বাস করেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশিত একটি ছবিতে দেখা যায় তিনি রাশিয়ার উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিখাইল বগডানভের সাথে সাক্ষাৎ করছেন।
কিন্তু ইসরাইল বলছে, হামাসের জ্যেষ্ঠ নেতাদের হাত ‘এক হাজার ৪০০ ইসরাইলির রক্তে রাঙানো‘ এবং রাশিয়াকে তারা এই প্রতিনিধিদলকে বহিষ্কার করার আহ্বান জানিয়েছে।
তবে এটি মস্কোর উপর কোনো প্রভাব ফেলেনি অবশ্য। রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে যে ইরানের উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রীও মস্কোতে রয়েছেন। ইরান-ইসরাইলের প্রধান শত্রু এবং হামাসের দীর্ঘ দিনের সমর্থক। কিন্তু এই গোষ্ঠীটি রাশিয়ার সাথেও গভীর সম্পর্ক গড়ে তুলেছে।
এই যুদ্ধে রাশিয়ারও অংশ আছে। কারণ হামাসের হামলায় কমপক্ষে ১৯ জন রাশিয়ার বংশোদ্ভূত ইসরাইলি নিহত হয়েছে এবং আরো অনেকে হামাসের হাতে বন্দি বা নিখোঁজ রয়েছে।
ক্রেমলিন আরো বলেছে, ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের সফরও আসন্ন।
সূত্র : বিবিসি
Leave a Reply