১. সবার প্রথমে সালাম দিতেন : রাসূল সা:-এর ব্যক্তিজীবনে কুশল বিনিময়ের অসাধারণ বৈশিষ্ট্য ছিল- তিনি সবার প্রথমে সালাম দিতেন ও মুসাফাহা করতেন। তিনি কারো সাথে সাক্ষাৎ হলে রাসূল সা: প্রথমে সালাম দিতেন। অতঃপর তিনি কথা বলতেন। এ প্রসঙ্গে হাদিসে হজরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ রা: থেকে বর্ণিত- রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘আগে সালাম তারপরে কথা’ (সুনানে তিরমিজি-২৮৪২)।
নবী করিম সা: ছোট-বড় সবাইকে সালাম দিতেন এবং প্রথমে সালাম দিতেন। আনাস রা: থেকে বর্ণিত- তিনি রাসূল সা:-এর সাথে পথ চলছিলেন। তখন রাসূল সা: কয়েকটি শিশুকে অতিক্রম করছিলেন। তিনি তাদেরকে সালাম দিলেন’ (মুসলিম-৫৭৯৩)।
শুধু তাই নয়, রাসূল সা: সালাম দেয়াকে একটি উত্তম কাজ হিসেবেও সাহাবিদের নসিহত করতেন (বুখারি : ১২, ২৮, মুসলিম-১/১৪, হা.-৪২)। সালাম প্রদান সম্যক গুরুত্বপূর্ণ বলেই রাসূল সা: অনেক সময় তিন-তিনবার সালাম দিতেন (বুখারি : ৯৪, ৯৫, ইফা, হা.-৯৫)।
২. ব্যক্তিগত কথা গোপন রাখতেন : রাসূল সা: হলেন বিশ্ব মুসলিমদের জন্য শরিয়াহ প্রণেতা। নানান সময়ে সাহাবিরা নানা বিষয়ে পরামর্শ ও সিদ্ধান্ত নিতেন। উম্মতের জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ও শিক্ষণীয় না হলে তিনি ব্যক্তিগত বিষয় গোপন রাখতেন। রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘সব বৈঠক আমানতস্বরূপ’ (সুনানে আবু দাউদ-৪৮৬৯, বি.দ্র. অনেকে হাদিসটির সনদ জয়িফ বলেছেন)।
রাসূল সা: কারো গোপন বিষয় প্রকাশ করতেন না। এমনকি, এমন কোনো ব্যক্তিগত প্রশ্ন বা মাসয়ালা যদি কেউ জানতে চান যেটি অন্যদেরও প্রয়োজন রয়েছে তাহলে তিনি যখন সে বিষয় জানানোর সিদ্ধান্ত নিতেন তখন ওই ব্যক্তির নাম না নিয়ে কৌশলের আশ্রয় নিতেন।
আয়েশা রা: বলেন, নবীজী সা:-কে কোনো ব্যক্তির কোনো বিষয়ে জানানো হলে তিনি এভাবে বলতেন না, ‘তার কী হলো যে, সে এ কথা বলে?’ বরং বলতেন, ‘লোকজনের কী হলো যে, তারা এই এই বলে’ (সুনানে আবু দাউদ-৪৭৮৮)?
ইসলামী আইন ও বিচার ব্যবস্থার বিধান অনুসারে কারো ব্যক্তিগত তথ্য প্রকাশ করতে হবে যথাযথ কর্তৃপক্ষ বা সরাসরি বিষয়টির সাথে যারা জড়িত আছে তাদের কাছে। মহান আল্লাহ বলেন- ‘যখন শান্তি বা শঙ্কার কোনো সংবাদ তাদের কাছে আসে, তখন তারা তা প্রচার করে থাকে। যদি তারা তা রাসূল বা তাদের মধ্যে যারা ক্ষমতার অধিকারী তাদের গোচরে আনত, তবে তাদের মধ্যে যারা তথ্য অনুসন্ধান করে, তারা তার যথার্থতা নির্ণয় করতে পারত। তোমাদের প্রতি যদি আল্লাহর অনুগ্রহ ও দয়া না থাকত, তবে তোমাদের অল্পসংখ্যক ছাড়া সবাই শয়তানের অনুসরণ করত’ (সূরা নিসা, আয়াত-৮৩)। ৩. ক্ষমা করতেন : রাসূল সা: জীবনের অনুপম ম্যানার্স হলো তিনি ঘোরতর শত্রুকেও ক্ষমা করতে কুণ্ঠিত হতেন না। এমনকি, সাহাবিদেরও ক্ষমার দীক্ষা দিতেন প্রতিনিয়ত। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা: থেকে বর্ণিত- এক লোক এসে রাসূলুল্লাহ সা:-কে বলল, আমাদের গোলাম-কর্মচারীরা তো ভুলত্রুটি করে থাকে; তাদের আমরা কতবার ক্ষমা করব? উত্তরে রাসূল সা: কিছু না বলে চুপ রইলেন। লোকটি আবার প্রশ্ন করল। এবারো তিনি চুপ রইলেন। লোকটি যখন তৃতীয়বার প্রশ্ন করল- তখন রাসূল সা: বলেন, ‘প্রতিদিন তাকে ৭০ বার মাফ করে দেবে’ (মুসনাদে আহমাদ-৫৬৩৫)।
আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘(হে নবী) আপনি ক্ষমাশীলতা অবলম্বন করুন এবং মানুষকে ভালো বিষয়ের আদেশ করুন। আর মূর্খদের উপেক্ষা করুন’ (সূরা আরাফ, আয়াত-১৯৯)।
রাসূল সা: ইতিহাসে সাধারণ ‘ক্ষমা নীতি’র প্রবর্তন করেছেন। অষ্টম হিজরির দশম রমজানে রাসূল সা: মক্কাভিমুখী রওনা হন, সাথে ১০ হাজার মুজাহিদ সাহাবি। তিনি যথাসম্ভব রক্তপাত এড়িয়ে মক্কায় প্রবেশের কৌশল করেছিলেন। ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘কুরাইশদের মধ্যে যারা আবু সুফিয়ানের ঘরে আশ্রয় নেবে, নিজ নিজ ঘরে দরজা বন্ধ করে রাখবে তারা নিরাপদ।’ ক্ষমতা হাতে নিয়ে তিনি প্রতিশোধস্পৃহাকে দমিয়ে রেখে সব ঘোরতর শত্রুকে ‘সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা’ করলেন। যেসব কুরাইশ মুসলমানদের ক্ষতিসাধনে সামর্থ্যরে শেষ সময় পর্যন্ত অপচেষ্টা চালিয়েছিল তাদেরকে তিনি মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করার একচেটিয়া ক্ষমতা হাতে থাকা সত্ত্বেও পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম ‘সাধারণ ক্ষমা’ ঘোষণা করে এক বিরল দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করেছেন।
৪. অনাড়ম্বর জীবন যাপন করতেন : রাসূলুল্লাহ সা:-এর জীবন ছিল খুবই সাদাসিধে। দুনিয়ার জীবনকে তিনি মনে করতেন মুসাফিরখানা। এ কারণে পছন্দ করতেন মুসাফির কিংবা নিঃস্বের মতো জীবন যাপন করতে (মুসলিম-১৪৭৯) । তিনি সাধারণ পোশাক পরিধান করতেন এবং খেজুর পাতার চাটাইয়ে বিশ্রাম নিতেন। একদিন তাঁর শরীরে চাটাইয়ের দাগ দেখে উমর রা: কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘রোম ও ইরানের সম্রাটরা ভোগবিলাসে মত্ত, আর আপনার এ অবস্থা!’ রাসূল সা: জবাব দিয়েছিলেন, ‘উমর! তুমি কি এতে খুশি নও যে, তারা দুনিয়া নিয়ে থাকুক আর আমরা আখিরাত লাভ করি’ (বুখারি-৪৯১৩, মুসলিম-১৮/৫, হা.-১৪৭৯)?
রাসূল সা:-এর অতি সাধারণ জীবন যাপনের ব্যাপারে আমরা আরো জানতে পারি আয়েশা রা:-এর বর্ণনা থেকে, তিনি বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ সা:-এর বিছানা ছিল চামড়ার তৈরি এবং তার ভেতরে ছিল খেজুর গাছের ছাল’ (বুখারি-৬৪৫৬)।
অন্য বর্ণনায় এসেছে, ‘তাঁর ব্যবহৃত বালিশও ছিল চামড়ার তৈরি, যার ভেতরে ছিল খেজুর গাছের ছাল’ (সুনানে আবু দাউদ-৪১৪৬)।
৫. পরিচ্ছন্ন ও পরিপাটি চলাফেরা করতেন : পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ছিল রাসূল সা:-এর অন্যতম আকর্ষণ। তিনি পবিত্রতাকে এতটাই প্রাধান্য দিতেন যে, প্রত্যেক স্ত্রীদের কাছে গমন করে প্রতিবারই গোসল করেছেন মর্মে (আবু দাউদ-২১৯) এ বর্ণনা রয়েছে। তিনি পবিত্রতাকে ঈমানের অর্ধেক বলেও ঘোষণা দিয়েছেন (মুসলিম-৪২২)।
তাঁর প্রতিটি সকাল শুরু হতো মেসওয়াক ও অজুর মাধ্যমে এবং দিনের পরিসমাপ্তি ঘটত মেসওয়াক শেষে এশার সালাত আদায়ের মাধ্যমে, এমনকি মুখে দুর্গন্ধ হয় এমন খাবার খাওয়াকে অপছন্দ করতেন। রাসূল সা: নিয়মিত গোসল করতেন এবং প্রতি সপ্তাহে নখ-গোঁফ কাটতেন। নিয়মিত দাড়ি আঁচড়াতেন এবং চুলে তেল দিয়ে সুন্দর করে সিঁথি কেটে চুলের যতœ নিতেন। পরিষ্কার কাপড় পরিধানের পর সুগন্ধি ব্যবহার করতেন এবং সবসময় সুন্দর-পরিপাটি অবস্থায় থাকতে পছন্দ করতেন। তিনি বলেন, ‘আল্লাহ সুন্দর তিনি সৌন্দর্যকে পছন্দ করেন’ (মুসলিম-১১৬, তিরমিজি : ১৯৯৮, ১৯৯৯, আবু দাউদ-৪০৯১, ইবনে মাজাহ : ৫৯, ৪১৭৩, আহমাদ : ৩৭৭৯, ৩৯০৩)। (আগামী দিন সমাপ্য)
লেখক :
শিক্ষক, প্রাবন্ধিক ও গবেষক
Leave a Reply