আগামী নভেম্বর মাসে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করার কথা রয়েছে নির্বাচন কমিশনের। এর আগেই চলমান অক্টোবরে বিএনপির সরকার পতন আন্দোলনের চূড়ান্ত ধাপে পৌঁছানোর জোর আলোচনা আছে রাজনৈতিক অঙ্গনে। দলটির শীর্ষ নেতাদের কেউ কেউ এ বিষয়ে প্রচ্ছন্ন হুমকিও দিয়ে রেখেছেন। যদিও বিভিন্ন সভা-সমাবেশে বিএনপিকে অচল করার পাল্টা হুমকি-ধমকিও দিয়ে আসছেন শাসকদলের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ। তবে মাঠের প্রধান বিরোধী দল বিএনপির সরকার পতনের চূড়ান্ত ধাপের আন্দোলন নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। অতীতে বিএনপি ও তার মিত্রদের আন্দোলন মোকাবেলায় আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর ওপর ভর করে সফলতা পেলেও বর্তমান প্রেক্ষাপট একটু ভিন্ন হওয়ায় আওয়ামী লীগকে নতুন করে ভাবতে হচ্ছে। বিএনপি ও তার মিত্রদের আন্দোলন কিভাবে মোকাবেলা করা যায় শাসকদল ভেতরে ভেতরে কৌশল নির্ধারণ করছে বলে দলটির শীর্ষপর্যায় সূত্রে জানা গেছে।
২০১১ সালের ১০ মে সুপ্রিম কোর্টের এক রায়ের মাধ্যমে সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল হয়েছে। এর পর থেকেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহালের দাবিতে বিএনপি ও তার মিত্ররা আন্দোলন করে আসছে। এরপর সংশোধিত সংবিধানের আলোকে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ ও ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। বিএনপি ও তার মিত্ররা দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়নি। আওয়ামী লীগের একাধিক নেতাদের সাথে আলাপকালে বলেন, বিএনপি ও তার মিত্ররা তাদের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহালের দাবি আদায়ে অনড় অবস্থানে থাকায় নির্বাচনে অংশ না নিয়ে তুমুল আন্দোলন গড়ে তোলে। নির্বাচনের দিন তারা বিভিন্ন জায়গায় বাধা দেয়ার চেষ্টা করে, নির্বাচন বানচালের চেষ্টা করে। কিন্তু আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর দৃঢ়তায় তারা সফল হয়নি। গত বছরের ১০ ডিসেম্বর তারা সরকারের পতন ঘটানোর জন্য রাজধানীর নয়াপল্টনে বড় সমাবেশ করতে চেয়েছিল- সরকারের কাছে এমন তথ্য ছিল। যার কারণে সমাবেশ অনুষ্ঠানের আগেই তাদের শীর্ষ নেতাদের গ্রেফতার করা হয় এবং তখনই তাদের আন্দোলন দুর্বল হয়ে পড়ে। শেষমেশ বিএনপি রাজধানীর গোলাপবাগের গরুর হাটে গিয়ে নামমাত্র সমাবেশ করে মুখ রক্ষা করে। সমাবেশটিও গুরুত্ব হারায়। ওই সময়ও আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর দৃঢ় ভূমিকার কারণে বিএনপি সফল হতে পারেনি। গত ২৭ জুলাই রাজধানীতে বড় সমাবেশ করার পর ২৮ জুলাই ঢাকা প্রবেশমুখে অবস্থান কর্মসূচি দেয় বিএনপি। কিন্তু সেখানেও আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর কঠোর অবস্থানের কারণে রাজপথে দাঁড়াতে পারেনি বিএনপির নেতাকর্মীরা। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের ভিসানীতি বাস্তবায়নের কারণে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর ঊর্ধ্বতনরা চাপের মধ্যে আছে। তারপরও বিএনপির আন্দোলন দমনে তারা অতীতের মতো শক্ত ভূমিকা পালন করবে এটা আশা করা হচ্ছে। এর পাশাপাশি দলীয় নেতাকর্মীদেরও প্রস্তুত রাখা হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের অন্যতম যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম নয়া দিগন্তকে বলেন, অতীতে বিএনপি অনেক দফাই দিয়েছে, কঠোর আন্দোলনের হুমকি দিয়েছে আমরাও সেটি শুনে আসছি। তারা কোনোবারই আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি, ব্যর্থ হয়েছে। আমরা অতীতের মতো ওইভাবেই দেখছি। তিনি বলেন, নির্বাচনের দিন ঘনিয়ে আসছে। সংবিধান অনুযায়ী যথাসময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আমরা নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করছি। আমরা জানি, বিএনপি নির্বাচন ভণ্ডুুল করার জন্য অতীতের মতো অপচেষ্টা চালাচ্ছে। সেই অপচেষ্টা কখনো সফল হবে না। আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট আফজাল হোসেন এ বিষয়ে নয়া দিগন্তকে বলেন, বিএনপির চূড়ান্ত আন্দোলন বলে কিছু নেই। তাই এটা নিয়ে চিন্তিত হওয়ার মতো কোনো কারণই নেই। বিএনপি একটি ব্যর্থ দল, তারা আন্দোলনেও ব্যর্থ, নির্বাচনেও ব্যর্থ। বিএনপি মাঝে মাঝে ঈদের পরে বর্ষার পরে পরীক্ষার পরে শীতের পরে আন্দোলন করবে এমনটা বলে তাদের নেতাকর্মীদের একটু আশা দিয়ে রাখে। তারা কোনোদিনও আন্দোলন গড়ে তুলতে পারবে না, তারা সফলও হবে না। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিএনপি যদি আবারো রাজপথে আন্দোলনে নামে, জ্বালাও পোড়াও করে তাহলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল মনে করে, অতীতে বিএনপির সব আন্দোলন আইনশৃঙ্খলাবাহিনী কঠোরভাবে দমন করেছে। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের তেমন বেগ পেতে হয়নি। তখন সরকারের ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক মহলের তেমন কোনো চাপও ছিল না। কিন্তু এখন প্রেক্ষাপট একটু ভিন্ন। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠানের জন্য সরকারের তরফ থেকে জোরালো আশ্বাস দেয়ার পরও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের ভিসানীতি আরোপ ও বাস্তবায়ন শুরু করেছে। এর আগে র্যাব-পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার নামে স্যাংশন দিয়েছে। সামনে আরো স্যাংশন আসতে পারে- এমন আশঙ্কাও করা হচ্ছে, সেই আলোচনাও আছে। মার্কিন ভিসানীতি আরোপ ও বাস্তবায়নের পর থেকে বিএনপি ও তার মিত্ররা কিছুটা হলেও উজ্জীবিত হয়েছে এবং অবাধে সভা-সমাবেশ করছে। গত ১২ জুলাই থেকে বিএনপি সরকার পতনের এক দফার আন্দোলন ঘোষণা করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিদেশী কিছু রাষ্ট্র ও সংস্থার চাপের মধ্যে বিএনপির সরকার পতনের চূড়ান্ত ধাপের আন্দোলনের সময় আইনশৃঙ্খলাবাহিনী আগের মতো ভূমিকা পালন করবে কি না তা নিয়ে কিছুটা হলেও সংশয় রয়েছে। সরকারের তরফ থেকেও ভবিষ্যতের জন্য তাদের স্পষ্ট বার্তা দেয়া হয়েছে, আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় না থাকলে কী হতে পারে? আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর নিরপেক্ষ ভূমিকা না থাকলে বিদেশী রাষ্ট্রগুলো মনে হয় না ভালোভাবে নিবে।
বিএনপির চূড়ান্ত ধাপের আন্দোলন প্রসঙ্গে বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষক গোলাম মাওলা রনি নয়া দিগন্তকে বলেন, বিএনপির আন্দোলন আওয়ামী লীগ কাউন্ট করছে। তার কারণ হলো অনেক সময় ছোট আন্দোলন ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে। আবার অনেক সময় বড় আন্দোলন ব্যর্থ হয়। সেই ক্ষেত্রে বিএনপির যেকোনো আন্দোলন তারা কাউন্ট করছে এবং বিষয়টি নিয়ে তারা চিন্তিত। তবে ঝামেলা এড়িয়ে আওয়ামী লীগ নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যেতে চাইছে। ঝামেলা এড়িয়ে যেতে চাইছে তার মানে বিএনপিকে ছাড় দেবে এমনটা নয়। বিএনপির সকল কর্মসূচির পাল্টা কর্মসূচিতো আওয়ামী লীগ দিচ্ছে এবং রাজপথে মোকাবেলার জন্য শক্তি বৃদ্ধি করছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মার্কিন ভিসানীতি ও স্যাংশনের কারণে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আরো কঠোরতা দেখাবে। তার কারণ, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা মনে করছে, এটা তাদের লাস্ট স্টেজ। তালিকায়তো তাদের নাম উঠে গেছে, ফলে এখন আর পেছন ফিরে তাকানোর সুযোগ নেই, ভবিষ্যতে যা হয় হোক, বিএনপি ঠেকাও। সরকারের তরফ থেকেও আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের এমন বার্তা দেয়া হয়েছে। ফলে বিএনপির আন্দোলন দমনে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্যরা আরো কঠোরতা দেখাবে।
বিএনপির চূড়ান্ত ধাপের আন্দোলন প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের প্রবীণ রাজনীতিক ও উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য অ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন নয়া দিগন্তকে বলেন, আমার জানা মতে, এ দেশে গণ-অভ্যুত্থান করার মতো বিএনপির কোনো সাংগঠনিক শক্তি নাই। তারা মনে করছে, আমেরিকার তাদের পেছনে আছে। সেই শক্তি নিয়ে তারা কাজ করছে। সেখান থেকে যদি কিছু হয় এই আশায় তারা তাকিয়ে আছে। এটাও কতটুকু সম্ভব সেটা সময়ই বলে দেবে। তার কারণ ভারততো এখনো কিছু বলেনি। ভারত এখনো চুপচাপ রয়েছে।
Leave a Reply