পৃথিবীতে যখন ফেতনা-ফাসাদ, অন্যায়-অবিচার চরম আকার ধারণ করেছিল, পুরো পৃথিবী তখন আইয়ামে জাহেলিয়াতের মধ্যে নিমজ্জিত ছিল। কোথাও সুবিচার ছিল না, কোথাও শান্তি ছিল না। মানবজাতি ছিল পথহারা, দিশেহারা। হেদায়েতের সব পথ সম্পর্কে অজ্ঞ। অশ্লীলতা, আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা ও চরিত্রহীনতায় নিমগ্ন ছিল। শিরিক ও কুফরের বেড়াজালে আবদ্ধ ছিল। জাতির এমন চরম দুর্দিনে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন মুহাম্মাদ রাসূলুল্লাহ সা:কে হেদায়েতের বাণী দিয়ে পুরো পৃথিবীর রহমত বানিয়ে পাঠান। পবিত্র কুরআনুল কারিমে মহানবী সা:কে উদ্দেশ করে ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি আপনাকে পুরো বিশ্বের জন্য রহমতস্বরূপ প্রেরণ করেছি।’ (সূরা আম্বিয়া : ১০৭)
এই অস্থায়ী পৃথিবীতে কেউ কাউকে অকারণে ভালোবাসে না। যদি কোনো লোকের মধ্যে ভালোবাসার মতো গুণ, বৈশিষ্ট্য, বিশেষত্ব বিদ্যমান থাকে, তাহলেই কেবল তাকে ভালোবাসে। হজরত মুহাম্মাদ সা:-এর মধ্যে ভালোবাসার মতো সমুদয় স্বভাব, নৈপুণ্য, দক্ষতা, পূর্ণতা ও যোগ্যতা বিদ্যমান ছিল। পৃথিবীতে যত সুন্দর গুণ রয়েছে সব গুণের সমাহার তার মাঝে ছিল। মহানবী সা: তাঁর উম্মতকে হৃদয় দিয়ে ভালোবাসতেন। তিনি সবসময় নিজের উম্মতের কল্যাণ কামনা করতেন। নবীজী সা: দুনিয়াতে দু’হাত তুলে কেঁদে কেঁদে উম্মতের জন্য দোয়া করছেন। আখেরাতেও উম্মতের জন্য মহান আল্লাহর কাছে সিজদায় লুটিয়ে পড়ে সুপারিশ করবেন। উম্মতের হেদায়েত লাভে তাঁর দরদ ও আত্মত্যাগ বুঝবার জন্য কুরআনের এই একটি আয়াতই যথেষ্ট। মহান আল্লাহ বলেন : ‘এরা এই বাণী বিশ্বাস না করলে সম্ভবত এদের পেছনে ঘুরে তুমি দুঃখে আত্মবিনাশী হয়ে পড়বে। (সূরা কাহাফ : ৬)
এটা থেকেও নবীজীর নিঃস্বার্থ দরদ সুস্পষ্টভাবে বোঝা যায় যে, নবীজী উম্মতের প্রতি পিতার মতো দরদি ছিলেন; কিন্তু তাদের সম্পদের ওয়ারিশ না। রাসূলুল্লাহ সা: বলেন : আমি তোমাদের জন্য পিতৃতুল্য। (সহিহ ইবনে খুযাইমা : ৮০)
জান্নাতে আল্লাহর রাসূল সা:-এর সাথে থাকার অন্যতম উপায় হলো তাকে ভালোবাসা। কেননা যে ব্যক্তি যাকে ভালোবাসে তার সাথেই তার হাশর হবে। রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, যে যাকে ভালোবাসে পরকালে সে তার সাথেই থাকবে। (সহিহ মুসলিম : ৬৬১১)
রাসূলুল্লাহ সা:-কে ভালোবাসা ঈমানের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। প্রত্যেক ঈমানদার ব্যক্তির ওপর তাঁকে ভালোবাসা অত্যাবশ্যক। মু’মিনের জীবনে রাসূলুল্লাহ সা:-র প্রতি মহব্বতের গুরুত্ব অপরিসীম। রাসূলুল্লাহ সা:-এর মহব্বত মু’মিনের জীবনের অন্যতম লক্ষ্য। এই মহব্বত ছাড়া ঈমানের পূর্ণতা আসে না।
রাসূল সা: এরশাদ করেন, তোমাদের কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত ঈমানদার হতে পারবে না যতক্ষণ তার কাছে আমি তার পিতা-মাতার চেয়ে, সন্তানাদির চেয়ে এবং সব মানুষের চেয়ে প্রিয় না হবো। (বুখারি : ১৫)
এই হাদিসের ব্যাখ্যায় কাজী আয়াজ রহ: বলেন : ‘নবী সা:-কে ভালোবাসা ঈমান বিশুদ্ধ হওয়ার শর্ত।’ (ফাতহুল বারি : ১/৫৯)
কুরআন ও হাদিসে নবী করিম সা:-এর প্রতি ভালোবাসা অনুসরণ করার প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। সাহাবায়ে কেরাম রা: নবী কারিম সা:-কে তাদের জীবনের চেয়ে বেশি ভালোবাসতেন। নবীজীর সুখে তারা সুখী হতেন নবীজীর ব্যথায় তারা ব্যথিত হতেন।
প্রিয় নবী সা:-এর প্রতি ভালোবাসা প্রকাশের পথ হলো- তার দেখানো রাস্তা ও রেখে যাওয়া আদর্শের অনুসরণ, অনুকরণ ও আনুগত্য। আর এর মাধ্যমেই মু’মিন বান্দার জন্য দুনিয়া ও পরকালের সফলতা লাভ করা। কুরআনুল কারিমে আল্লাহ তায়ালা এ ভালোবাসার কথাই তুলে ধরেছেন।
আল্লাহ তায়ালা বলেন (হে নবী! মানুষকে) বলে দাও, তোমরা যদি আল্লাহকে ভালোবেসে থাকো, তবে আমার অনুসরণ করো, তাহলে আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন এবং তোমাদের পাপরাশি ক্ষমা করবেন। আল্লাহ অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। (সূরা আলে-ইমরান : ৩১)
তাই রাসূলুল্লাহ সা:কে ভালোবেসে তার আদর্শ বাস্তবায়ন করাই হবে মু’মিনের জীবনে সফলতা। নবীজীর জন্ম মাসে মু’মিন মুসলমানকে এ চেতনায় উদ্বুদ্ধ হতে হবে যে, তার আদর্শ বাস্তবায়নে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হতে হবে। দুনিয়াতে ইসলামের শান্তি ও সৌন্দর্য তুলে ধরতে হবে। মহান আল্লাহ মুসলিম উম্মাহকে নবীজীকে সা: ভালোবেসে তার আদর্শ বাস্তবায়ন করার তাওফিক দান করুন। আমিন!
লেখক :
শিক্ষক, জামিয়া মিফতাহুল উলূম নেত্রকোনা
Leave a Reply