প্রতিটি জীবনের উত্থান-পতন আছে। সুদিন-দুর্দিন আছে। আছে তার সুখ-দুঃখের বিবরণ। আজ ভালো তো কাল মন্দ। এখন হাসি তো পরে কান্না। এভাবেই জোয়ার-ভাটার সমাহারে চলছে জীবনের নদী। এটিই সৃষ্টিকর্তার অমোঘ নীতি। ইরশাদ হয়েছে- ‘নিশ্চয় কষ্টের সাথে আছে স্বস্তি, দুঃখের সাথে আছে সুখ’ (সূরা ইনশিরাহ : ৫-৬)। হাদিস শরিফে এসেছে, ‘বিপদের সাথে আছে মুক্তি, আর কষ্টের সাথে আছে স্বস্তি’ (মুসনাদে আহমাদ-১/৩০৭)।
এ কথা ব্যক্তি প্রসঙ্গে যেমন সত্য, তেমন জাতিগোষ্ঠী কিংবা সংস্থা-সংগঠনের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। আজ যাদের জয়জয়কার, কাল তারা পরাজয়ের শিকার। এখন যারা শক্তিমত্তায় বেপরোয়া, পরে তারা পতনের গ্লানিতে দিশেহারা। যতটুকু দুঃখ-কষ্ট মানুষকে তাড়া দেয় ততটুকু বা তার চেয়ে বেশিটুকু তারা প্রাপ্ত হয়। ফলাফল কি দাঁড়ায়- ‘যেমন কর্ম তেমন ফল! ইট মারলে পাটকেল খেতে হয়!’ সুদিন বা কর্তৃত্বের সময়ে যে বা যারা এই ধ্রুব সত্যকে ভুলে গিয়ে মানুষ ও মানবতার ক্ষতি করে, তাদের অধিকার হরণ করে, তাদের ওপর খড়গহস্ত হয়- সে বা তারা পরাজয়ের মুহূর্তে অসহায় হয়ে পড়ে। তাদের পাশে কেউ দাঁড়ায় না। তাদের দুরবস্থা দেখে মানুষ মজা পায়। ক্ষেত্রবিশেষে প্রতিশোধপ্রবণ হয়ে ওঠে।
জীবনের আকাশে তখন দেখা দেয় সন্ধ্যা। নেমে আসে ঘনকালো অন্ধকার। পৃথিবীতে এমন দৃষ্টান্তের অভাব নেই। নমরুদ প্রায় ৪০০ বছর ( ইরাক ও তৎপার্শ্ববর্তী অঞ্চলের) ক্ষমতার মসনদে অধিষ্ঠিত ছিল। ক্ষমতার দাপটে সে কারো মতবাদ বা সমালোচনা সহ্য করতে পারত না। নিজেকে রাষ্ট্র ও জনগণের মালিক ভাবত। প্রভু দাবি করে তার উপাসনা করার জন্য মানুষকে বাধ্য করত। আল্লাহর নবী হজরত ইবরাহিম আ: তার প্রতিবাদ করলে তাঁকে নানাভাবে অসম্মান ও নির্যাতন করত। এমনকি শেষ পর্যন্ত আগুনে নিক্ষেপ করে হত্যা করারও চেষ্টা করে। আল্লাহর সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করে আকাশে তীর ছুড়ে। কিন্তু এক সময় তার পতন নেমে আসে। আল্লাহর অতি ছোট্ট মাখলুক মশার কাছে শোচনীয়ভাবে পরাস্ত হয়। ফেরাউনও দীর্ঘকাল মিসরের ক্ষমতায় থেকে নিজেকে ‘শ্রেষ্ঠ রব’ দাবি করেছিল। বনি ইসরাইলের ওপর অকথ্য নির্যাতন করেছিল। হত্যা, লুণ্ঠন, জনগণের স্বাধীনতা হরণসহ নানা অন্যায়-অপারাধে আকাশ-বাতাস ভারী করে তুলেছিল। আল্লাহর নবী মূসা ও হারুন আ:-এর সাথে বেয়াদবি করেছিল। এক সময় তারও পতন হলো। আজও সে মিসরের জাদুঘরে পৃথিবীর জালেম শাসকদের জন্য নিকৃষ্টতম দৃষ্টান্ত হয়ে পড়ে রয়েছে। এ তো গেল দুনিয়ার শাস্তি। পরকালে তাদের জন্য অনন্তকালের লাঞ্ছনা অপেক্ষা করছে।
পক্ষান্তরে যে বা যারা সুসময়ে, ক্ষমতার মসনদে থেকে ভবিষ্যতের কথা ভেবে, মানুষ ও মানবতার কল্যাণে কাজ করে, তাদের সুখে-দুঃখে পাশে থেকে সাহায্যের হাত বাড়ায়- সে বা তারা দুর্দিনে জাতিকে কাছে দেখতে পায়। জাতির সমর্থন পায়। প্রয়োজনে জাতি তাদের রক্ষা করতে জীবন বিলাতে প্রস্তুত থাকে। পৃথিবীতে তারা যেমন স্মরণীয় বরণীয়, তেমন পরকালেও হবেন সম্মানের অধিকারী।
কথায় আছে, ‘এক মাঘে শীত যায় না’। মানে বিপদ একবার আসে না। এটি আবর্তিত। মানুষকে আল্লাহ সবসময় এক হালতে রাখেন না। এমন যদি হতো, যাকে তিনি সুখ দেবেন সে জীবনভর সুখেই থাকবে তাহলে দুঃখের অনুভূতিশূন্য মানুষগুলো নির্দয় ও পাষাণ হয়ে যেত। দুঃখীদের দুুঃখ বোঝা বা লাঘব করার কেউ থাকত না। আবার যাকে ক্ষমতা দেবেন সে যদি সারাটা জীবন ক্ষমতাতেই থাকবে তাহলে পৃথিবীতে অন্যায়-অপরাধ বাড়তেই থাকবে। মানুষ শ্রেণিবৈষম্যের শিকার হবে। তাই সুখ-শান্তি বা ক্ষমতা আল্লাহ তায়ালা সবসময় একই ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর কাছে রাখেন না; বরং সময়ে সময়ে সেগুলোর পালাবদল করে পৃথিবীর ভারসাম্য রক্ষা করেন। অনেক সময় জালেমকে জালেম দ্বারা শায়েস্তা করেন। ইরশাদ হয়েছে- ‘আর আল্লাহ যদি মানবজাতির একদলকে অপর দল দ্বারা দমন না করতেন, তবে বিধস্ত হয়ে যেত খ্রিষ্টান সন্ন্যাসীদের আশ্রম, গির্জা, ইহুদিদের উপাসনালয় ও মসজিদসমূহ- যেখানে আল্লাহর নাম অধিক স্মরণ করা হয়’ (সূরা হজ- আয়াত : ৪০)। অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে- ‘আর এসব দিন আমি মানুষের মধ্যে পালাক্রমে আবর্তন করি’ (সূরা আল-ইমরান-১৪০)।
সুতরাং দিন পরিবর্তনশীল। দিনের পরিবর্তনে কেউ বাদশাহ থেকে ফকির হয়, কেউ ফকির থেকে বাদশাহ হয়। সুখী থেক কেউ দুঃখী হয় আবার দুঃখী থেকে কেউ সুখী হয়। সৃষ্টিকর্তার এ এক রীতি! তিনি যা চান তাই করতে পারেন। কিন্তু সৃষ্টি যা চায় তা তাঁর ইচ্ছা ছাড়া করতে পারে না।
লেখক :
কবি ও কলামিস্ট
Leave a Reply