আমাদের উচিত ছিল পৃথিবীতে নানাবিধ কাজের মাধ্যমে পরকালে মুক্তি লাভের সব উপকরণ অর্জনকে নিশ্চিত করা। সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেলেও আমাদের সৃষ্টির মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তাবায়ন করা অতীব জরুরি। যা অর্জিত ও বাস্তবায়িত হলে শুধু দুনিয়ার ৭০-৮০ বছর ভালো থাকা নয়; বরং যে জীবনের শুরু আছে শেষ নেই এমন জীবনে সর্বোচ্চ ভালো থাকা যাবে। তখন এক মুহূর্তের জন্যও আমাদের কোনো কিছুরই অভাববোধ হবে না। সেখানে প্রত্যেকের জন্য পৃথিবীর আয়তনের কমপক্ষে দশগুণ সমপরিমাণ সাম্র্রাজ্য বরাদ্দ থাকবে।
মুখে যা চাওয়া যাবে কোনো ধরনের বিলম্ব ছাড়াই তা অর্জিত হবে। এমনকি মনে মনে কল্পনার বিষয়গুলোও তাৎক্ষণিকভাবে বাস্তবে পাওয়া যাবে। সেখানে মন খারাপের কোনো কিছুর অস্তিত্ব থাকবে না। সেখানে কোনো প্রাণের মৃত্যু থাকবে না। আমাদের সৃষ্টি এবং পৃথিবীতে অবস্থানের একমাত্র উদ্দেশ্য হলো আল্লাহ তায়ালার দাসত্ব করা। সূরা আল জারিয়াতের ৫৬ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘আমি জিন ও মানব জাতিকে একমাত্র এই জন্য সৃষ্টি করেছি যে, তারা আমার ইবাদত করবে।’ আল্লাহর ইবাদত করা তথা আমাদের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত আল্লাহ তায়ালার সব বিধিবিধান মেনে চলে তাঁর সন্তুষ্টি অর্জন করা। মোটাদাগে বলতে গেলে, এটিই আমাদেরকে সৃষ্টির একমাত্র কারণ বা আমাদের একমাত্র লক্ষ্য। আমরা যেগুলোকে একেবারেই নিরেট দুনিয়াদারি হিসেবে চিহ্নিত করি সেগুলোও আল্লাহ তায়ালাকে স্মরণে রেখে তাঁর বিধান অনুযায়ী সম্পাদন করে দ্বীনদারিতে পরিণত করতে হবে। পৃথিবীর ৮০০ কোটি মানুষ প্রতিদিন তাদের সামনে শত শত মানুষকে বিভিন্নভাবে মৃত্যুবরণ করতে দেখে। সবাই নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস করে অন্যদের মতো একদিন তাকেও মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। কিন্তু এর পরে কী হবে বা পরের অংশের জন্য এ জীবনে কী করা উচিত এ ব্যাপারে আমাদের অধিকাংশই বেখবর হয়ে দিনাতিপাত করে যাচ্ছেন। পরের জীবনে দুনিয়ার জীবনের কাজের জবাবদিহিতা, দুনিয়ার জীবনের সব আমলের পুরস্কার অথবা তিরস্কারের নিশ্চিত ও অফুরন্ত বিষয়টি আমরা ক্ষণে ক্ষণে বা একেবারেই ভুলে যাই। আল্লাহর দাসত্বের পরিবর্তে আমরা তাঁর অবাধ্য হয়ে যাই। সীমাহীন পাপাচারে লিপ্ত হয়ে পড়ি।
আমরা ফিরে না এলে আল্লাহ তায়ালা আমাদের জন্য রোগ-শোক ও বিপদাপদ পাঠান। জলে ও স্থলে নানা রকমের বিপর্যয় পাঠান। রাজনৈতিক অস্থিরতা, অত্যাচারী শাসক, দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি, চুরি-ডাকাতি, ছিনতাই, মারামারি, হত্যাকাণ্ড, ভয়াবহ বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, সাইক্লোন, ভূমিকম্প, ভূমিধস, অগ্নিকাণ্ড, অতিবৃষ্টি-অনাবৃষ্টি, দুর্ভিক্ষ, বিভিন্ন মহামারী ইত্যাদি নানামুখী প্রাকৃতিক বিপর্যয় পাঠান। সূরা আর রুমের ৪১ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন- ‘স্থলে ও জলে বিপর্যয় প্রকাশিত হয় যা মানুষ নিজেরা অর্জন করেছে। এর দ্বারা আল্লাহ তাদের কৃতকর্মের জন্য প্রাপ্য শাস্তির কিছু অংশ তাদেরকে আস্বাদন করাতে চান। আশা করা যায় তারা ইবাদতের পথে ফিরে আসবে।’ উল্লিøখিত বিভিন্ন বিপর্যয়ে অসংখ্য মানুষের বিনাশ সাধিত হয়ে থাকে। এর উদ্দেশ্য থাকে সাধারণত তিনটি। প্রথমত, আল্লাহ তায়ালা তাদের জন্য পৃথিবীতে যে সময়টুকু বরাদ্দ করেছিলেন তা শেষ হয়ে গেছে। ফলে তিনি তাদের দুনিয়ার সফরের সমাপ্তি টেনেছেন। দ্বিতীয়ত, তাদের অনবরত পাপাচারের জন্য উপযুক্ত শাস্তির কিছুটা তিনি দুনিয়াতেই দিয়ে নিচ্ছেন। বাকি অংশ পরকালে অবশ্যই তাদের জন্য অনিবার্য আকারে থাকবে। তৃতীয়ত, কয়েক হাজার বা কয়েক লাখকে ধ্বংস করে বাকি শত শত কোটি মানুষকে তাদের মূল উদ্দেশ্য ইবাদতের কর্মসূচিতে ফিরে আসার জন্য সুযোগ করে দেন। শুধু একা ভালো থাকা বা একা ইবাদত করে মুক্তি লাভ করা সম্ভব নয়। নিজের সাধ্যের মধ্যে মানুষকে পাপাচার থেকে ফিরিয়ে আনতে হবে। অন্যথায় আল্লাহর তায়ালার আজাব অবাধ্যদের সাথে ভালো মানুষকেও সমানভাবে ভোগ করতে হবে। আল্লাহ তায়ালা সূরা আল আনফালের ২৭ নম্বর আয়াতে ইরশাদ করেন- ‘তোমরা সেসব বিপর্যয়ের ব্যাপারে সতর্ক হও যা শুধু যারা অবিচার করেছে বিশেষভাবে তাদেরকে উদ্দেশ্য করে আপতিত হয় না। তোমরা জেনে রাখো, নিশ্চয়ই আল্লাহ শাস্তি প্রদানে অত্যন্ত কঠোর।’ হজরত হুজাইফা ইবনুল ইয়ামান রা: থেকে বর্ণিত- রাসূল সা: ইরশাদ করেছেন, ‘সেই সত্তার শপথ করে বলছি যার হাতে আমার প্রাণ! অবশ্যই অবশ্যই তোমাদেরকে সৎ কাজের আদেশ এবং অসৎ কাজে নিষেধ বা বাধা দিতে হবে। অন্যথায় অচিরেই আল্লাহ তায়ালা তাঁর পক্ষ থেকে তোমাদের জন্য ভয়াবহ শাস্তি পাঠাবেন। যা থেকে বাঁচার জন্য তোমরা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতে থাকবে; কিন্তু আল্লাহ তায়ালা তা কবুল করবেন না।’ (জামে তিরমিজি)
গত সেপ্টেম্বর মাসেই প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডব ও সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসের কারণে লিবিয়ার ডেরনা শহর রক্ষা বাঁধ ভেঙে যায়। শুরু হয় আকস্মিক ভয়াবহ বন্যা। সেখানে প্রায় ১০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। ১০ হাজার মানুষ নিখোঁজ হয়েছিলেন এবং ৩০ হাজার মানুষ বাস্তুহারা হয়ে পড়েছেন। এ মাসেই মরক্কোর মারাকেশ সাফি অঞ্চলে ৬.৮ মাত্রার অত্যন্ত শক্তিশালী ভূমিকম্প হয়েছে। এতে অন্তত তিন হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন এবং আহত হয়েছেন অন্তত ছয় হাজার মানুষ। গত ফেব্রুয়ারি মাসে তুরস্কে ৭.৮ মাত্রার অসম্ভব শক্তিশালী একটি ভূমিকম্প সংঘটিত হয়। এতে প্রায় ৫১ হাজার মানুষ মারা যান। আহত হয়েছেন প্রায় এক লাখ সাত হাজার মানুষ। এমনকি এতে প্রতিবেশী দেশ সিরিয়ায় মারা গেছেন প্রায় ৯ হাজার মানুষ। আহত হয়েছেন প্রায় ১৫ হাজার মানুষ। গত বছরের জুন মাসে পাকিস্তানে ভয়াবহ বন্যা সংঘটিত হয়। এতে মারা যান অন্তত এক হাজার ৩০০ মানুষ। করোনাভাইরাসের কথা আমাদের সবার জানা। পৃথিবীজুড়ে প্রায় সোয়া এক কোটি মানুষ করোনাভাইসের গ্রাসে পরিণত হয়েছিল। ইবাদতের মূল লক্ষ্যকে বাদ দিয়ে আল্লাহর অবাধ্য হলে আমাদেরকে অচিরেই নিশ্চিত ধ্বংসের মুখোমুখি হতে হবে। আল্লাহ তায়ালা আমাদের হিফাজত করুন। আমিন!
লেখক :
অধ্যক্ষ, কামারগাঁও আল আমিন ইসলামিয়া আলিম মাদরাসা, শ্রীনগর, মুন্সীগঞ্জ
Leave a Reply