মক্কায় দীর্ঘদিন প্রতিকূল পরিস্থিতিতে ইসলাম প্রচারের পর অবশেষে আল্লাহ তায়ালার নির্দেশে এবং মদিনাবাসীর আমন্ত্রণে রাসূল সা: ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে মক্কা ছেড়ে মদিনায় হিজরত করেন। মদিনায় এসে তিনি ধর্ম প্রচারকের পাশাপাশি প্রথমবারের মতো একজন রাষ্ট্রনায়কের মর্যাদা লাভ করেন। রাষ্ট্রীয় ধর্ম হিসেবে ইসলাম আত্মপ্রকাশ করে। ইসলামী আদর্শ আরবের সীমানা পেরিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও জাতির মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। রাসূল সা: বিশ্ব মানবতার কাছে একটি চিরন্তন কালজয়ী জীবনব্যবস্থা উপহার দেন।
অসাম্প্রদায়িক পররাষ্ট্রনীতি : মদিনায় হিজরতের পর রাসূল সা: সেখানে একটি ইসলামী প্রজাতন্ত্র স্থাপন করার পরিকল্পনা করেন। একজন অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রনেতা হিসেবে প্রথমে তিনি সেখানে বসবাসরত ইহুদি ও খ্রিষ্টানদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে সোচ্চার হোন। সে অনুযায়ী মদিনার সংহতির চিন্তা করে সেখানকার অধিবাসীদের নিয়ে তথা পৌত্তলিক, ইহুদি, খ্রিষ্টান ও মুসলমানদের মধ্যে এক লিখিত সনদ বা চুক্তি স্বাক্ষর করেন। ইসলামের ইতিহাসে তৎকালীন এই মদিনা সনদ হালের ‘লীগ বা নেশন্স’, ‘জাতিসঙ্ঘ’, ‘চার্টার অব হিউম্যান’ বা ‘জেনেভা কনভেনশন’ এর চেয়েও অনেক বেশি তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। ৫২ ধারা বিশিষ্ট এ সনদ ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম লিখিত শাসনতন্ত্র। এর মাধ্যমে রাসূল সা:-এর রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও প্রজ্ঞার পরিচয় মেলে। ধর্ম ও রাষ্ট্রের সহাবস্থানে ইসলাম একটি সর্বজনীন জীবনব্যবস্থায় পরিণত হয়।
আন্তর্জাতিক সন্ধি : আল্লাহর পক্ষ থেকে যুদ্ধের নির্দেশ নাজিল হওয়ার পর তাওহিদের বাণী প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মুসলমানরা কাফেরদের সাথে অনেক যুদ্ধে অবতীর্ণ হোন। রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে এ সব যুদ্ধে রাসূল সা: সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে মুসলমানদের রাজনৈতিক ক্ষমতার সুদৃঢ় ভিত্তি স্থাপন করেন। বদর, উহুদ, খন্দক যুদ্ধের পর হুদায়বিয়ার সন্ধির মাধ্যমে ‘মদিনা’ প্রথমবারের মতো কুরাইশদের নিকট রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি পায়। আপাতদৃষ্টিতে তাৎক্ষণিকভাবে এই সন্ধিচুক্তি মুসলমানদের জন্য অপমানজনক মনে হয়েছিল। কিন্তু দূরদর্শী রাষ্ট্রনায়ক মুহাম্মদ বিন আব্দুল্লাহ সা: এই চুক্তিকে মুসলমানদের অনুকূল বুঝতে পেরে বিনা বাক্য ব্যয়ে এতে সম্মত হন। এর আগে মদিনায় ইসলামী প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলেও তা কোনো দিনই কুরাইশদের নিকট স্বীকৃতি পায়নি। কিন্তু হুদায়বিয়ার সন্ধির ফলে তারা মুসলমানদের একটি স্বাধীন রাষ্ট্রশক্তি হিসেবে লিখিতভাবে মেনে নেয় এবং রাসূল সা:কে মদিনা প্রজাতন্ত্রের সার্বভৌম নেতা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়। হুদায়বিয়ার সন্ধি ছিল রাসূল সা:-এর প্রথম বৈদেশিক সন্ধি। একজন দক্ষ পররাষ্ট্র নীতিবিদ হিসেবে এ ক্ষেত্রে তিনি যে দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন, তার পরিপ্রেক্ষিতেই মক্কা বিজয়ের পটভূমি রচিত হয়।
রাজা-বাদশাহদের পত্র প্রেরণ : হুদায়বিয়া থেকে প্রত্যাবর্তনের পর রাসূল সা: আন্তর্জাতিকভাবে ইসলামের বাণী ছড়িয়ে দেয়ার লক্ষ্যে এবার বিভিন্ন বাদশাহ এবং সমাজপতিদের নিকট পত্র প্রেরণের সিদ্ধান্ত নেন। সে সময় প্রতিবেশী অধিকাংশ রাজা-বাদশাহ ছিলেন খ্রিষ্টান। তাই তিনি যেসব পত্র খ্রিষ্টান বাদশাহদের নিকট লিখতেন, তাতে ওইসব আয়াত উল্লেখ করতেন যেগুলোতে আহলে কিতাবদের এক আল্লাহ তায়ালার ইবাদতের প্রতি আহ্বান করা হয়েছে।
এ পরিপ্রেক্ষিতেই তিনি ষষ্ঠ হিজরির শেষ অথবা সপ্তম হিজরির প্রথম ভাগে হাবশার সম্রাট নাজাশীর নিকট পত্র প্রেরণ করেন। রাসূল সা: উক্ত পত্রে অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী ভাষায় আল্লাহর একত্ববাদের আলোচনা করেন। পাশাপাশি নাজাশী এবং তার অধীনস্থদেরকে ইসলামের ছায়ায় আত্মসমর্পণের আহ্বান জানান। নাজাশী রাসূল সা:-এর পত্র পেয়েই তৎক্ষণাৎ সাহাবি জাফর ইবনে আবী তালিবের নিকট ইসলাম গ্রহণ করেন। এবং রাসূল সা:-এর সম্মানার্থে উক্ত পত্রের প্রতিউত্তর লিখেন।
তিনি যে একজন বিচক্ষণ-দূরদর্শী রাষ্ট্রনায়ক ছিলেন, এই ঘটনা তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। অস্ত্র-যুদ্ধ-সৈন্য-সামন্ত ছাড়া শুধু একটা চিঠি লিখে শান্তিপূর্ণভাবে একজন সম্রাটকে তিনি ইসলামের ছায়াতলে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছেন।
বিভিন্ন অঞ্চলের প্রধানদের নিকট পত্র প্রেরণের ধারাবাহিকতায় রাসূল সা: মিসরের সম্রাট মুকাওকিসের নিকটও পত্র প্রেরণ করেন। পত্র হাতে পেয়ে মুকাওকিস তা সাদরে গ্রহণ করেন এবং পত্রবাহক ও রাসূল সা: এর প্রতি যথেষ্ট সম্মান প্রদর্শন করেন। কিন্তু তিনি ইসলাম ধর্মে আত্মসমর্পণ করেননি।
এভাবে পরবর্তীতে তিনি পারস্যের সম্রাট খসরু পারভেজ এবং রোমের সম্রাট হিরাক্লিয়াসের নিকটও পত্র প্রেরণ করেন। পত্র পেয়ে খসরু পারভেজ ঔদ্ধত্য আচরণ করেন এবং তা ছিঁড়ে ফেলেন। রাসূল সা: তার এই দাম্ভিকতা সম্পর্কে অবগত হলে বললেন, ‘তার সাম্রাজ্যও আল্লাহ এমনি টুকরো টুকরো করবেন।’ আর পরবর্তীতে রাসূলের এই কথাটাই কার্যকর হয়েছিল। ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর রা: এর শাসনামলে পারস্য সাম্রাজ্য নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।
অন্যদিকে রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াস পত্র পেয়ে রাসূল সা: সম্পর্কে যথেষ্ট তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা করেন। মুসলিম প্রতিনিধিদের নিকট থেকে প্রাপ্ত তথ্য এবং রাসূল সা:-এর পত্র পাঠ করে হিরাক্লিয়াস ইসলামের প্রতি সু-ধারণা পোষণ করতেন। কিন্তু প্রজাদের জন্য বা বিভিন্ন পারিপার্শ্বিক অজুহাতে তিনি ঈমান আনয়ন করেননি।
ধারাবাহিকভাবে পত্রের মাধ্যমে রাসূল সা: ইসলামের অধিকাংশ রাজা-বাদশাহর নিকট ইসলামের দাওয়াত পৌঁছে দিয়েছিলেন। এ প্রেক্ষাপটে কেউ কেউ ইসলামের দাওয়াত গ্রহণ করেছিলেন, কেউ কেউ অস্বীকারও করেছিলেন। কিন্তু এভাবে পত্র আদান-প্রদানের ফলে মোটা দাগে যে ফায়দাটা হলো, রাসূল সা: এবং আল্লাহর মনোনীত ইসলাম ধর্ম আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিচিতি লাভ করেছিল।
সর্বোপরি বলা যায়, মদিনা রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে রাসূল সা: যে অবিস্মরণীয় রাজনৈতিক বিপ্লব সাধন করেছিলেন তা পৃথিবীর ইতিহাসে চিরভাস্বর হয়ে থাকবে। ‘যুদ্ধ নয় শান্তি’ এটাই ছিল তাঁর পররাষ্ট্রনীতি। একজন দূরদর্শী দক্ষ রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে তিনি অত্যন্ত সুনিপুণভাবে পররাষ্ট্রীয় সম্পর্ক দৃঢ় করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
লেখক :
শিক্ষার্থী
Leave a Reply