নবুয়তের প্রথম যুগ। নবীজী সা:-এর মক্কী জীবন। হাতেগোনা কয়েকজন সাহাবিকে সাথে নিয়ে নবীজী সা:-এর দাওয়াতি কার্যক্রম চলমান। হজরত খাদিজা রা: ও আবু বকর রা: তো শুরুতে-ই ইসলাম কবুল করে নিয়েছিলেন। তাদের পর ইসলামের আলো গিয়ে পৌঁছে হজরত হামজা ও ওমর রা:-এর কাছেও। এ-দু’জন সিংহের ইসলাম গ্রহণের পর সত্যধর্মের ভিত আরো মজবুত হয়। ফলে কাফেরদের মনে ইসলাম-ভীতি আরো প্রবলভাবে হরকত শুরু করে। তারা নবীজী সা:-এর প্রতি আরো হিংস্র হয়ে ওঠে। একপর্যায়ে তারা নবীজী সা:-এর চাচা আবু তালিবের কাছে হাজির হয়ে সোজাসাপটা বলে দেয়, ‘আপনি মুহাম্মদকে আমাদের হাতে তুলে দিন, নয়তো আমরা আপনাদের সবাইকে বয়কট করব।’ এ দিকে চাচা আবু তালিব ভালোভাবেই জানতেন, কুরাইশরা মুহাম্মদ সা:-এর রক্তপিপাসু। যেকোনো মূল্যে তারা মুহাম্মদ সা:কে হত্যা করতে চায়। তাই তিনি তাদের প্রস্তাবকে ফিরিয়ে দেন। কুরাইশ কাফেররা তাদের উদ্দেশ্য পূরণে ব্যর্থ হয়ে নতুন চক্রান্তের বৃত্ত আঁকে। সাহাবায়ে কেরাম, বনু হাশেম ও বনু মুত্তালিবের যারাই নবীজী সা:-এর সমর্থক বলে তাদের জানা ছিল, তাদের সবার বিরুদ্ধে বয়কটের ষড়যন্ত্র করে। এ ব্যাপারে তারা সব মুশরিকের সম্মিলিত উদ্যোগে একটি অবরোধনামা লিখে। সে অবরোধনামায় থাকে চারটি ধারা। ধারাগুলো নিম্নরূপ-
১. তাদের সাথে বিয়ে-শাদি ও সবরকম সম্পর্ক স্থাপন নিষেধ।
২. তাদের সাথে সব প্রকার লেনদেন নিষেধ।
৩. তাদের ক্ষুধা-পিপাসায় খাবার-পানির ব্যবস্থা করা বা ব্যবস্থায় সহযোগিতা করা নিষেধ।
৪. তাদের সাথে যেকোনো সন্ধি চুক্তি, সুসম্পর্ক বজায় রাখা ও তাদের সাথে নম্র আচরণ বা নমনীয়তা প্রদর্শন করা সম্পূর্ণ নিষেধ (ফিকহুস সিরাহ-১/১৮৪)।
লেখা শেষে তারা অবরোধনামাটি কাবার দেয়ালে ঝুলিয়ে দেয়। শুরু হয় বয়কট কার্যক্রম। সাহাবায়ে কেরাম, বনু হাশেম ও বনু মুত্তালিব কুরাইশের এই অবরোধের মুখে পড়ে পাহাড়ি গিরিপথে অবরুদ্ধ জীবনযাপন শুরু করেন। নবুয়তের সপ্তম বছর থেকে দশম বছর পর্যন্ত টানা তিন বছর এই বয়কট চলমান থাকে। এ সময়ে তাদের কাছে সব ধরনের খাদ্য সরবরাহ বন্ধ ছিল। না ছিল পানি আর না ছিল কোনো প্রকার শুকনো খাবার। খাদ্যের অভাবে সবাই অসহায় হয়ে পড়েছিলেন। শিশুদের কান্নার শব্দ যেন আকাশকেও ব্যথিত করছিল। সে সময় নবীজী সা: ও তাঁর সাথীরা গাছের পাতা ও ছাল-বাকল খেয়ে জীবন ধারণ করেছিলেন। অবশ্য কেউ কেউ লুকিয়ে লুকিয়ে সামান্য খাবার সরবরাহ করতেন কিন্তু তা কি আর প্রয়োজন মেটায়? মক্কার অনেক মানবিক মানুষ এই হীন কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ জানান এবং এ অমানবিক চুক্তি ভঙ্গ করার আহ্বান জানান। এ দিকে আল্লাহ তায়ালা চুক্তিপত্রকে উইপোকার খাদ্যে রূপান্তর করেন। ফলে সেগুলো চুক্তিনামাকে এমনভাবে খেয়ে নেয় যে, সেখানে আল্লাহর নাম ব্যতীত আর কোনো কথাই বাকি থাকেনি (সিরাত বিশ্বকোষ-৩/৪৩৩)।
এর ফলে দীর্ঘ এই জুলুম-অত্যাচারের অবসান ঘটে। অবরোধ বাতিল করার উদ্যোগ নেয়া হয়। এই উদ্যোগের প্রধান ছিলেন, কুরাইশ গোত্রেরই এক নেতা হিশাম ইবনে আমের। তিনি নিজের সাথে আরো পাঁচ নেতাকে একমত করেন- জুুহাইর ইবনে উমাইয়া, মুতয়িম ইবনে আদি, আবুল বুখতারি ও জামআহ ইবনে আসওয়াদ। জুহায়ের ইবনে উমাইয়া বয়কট ভঙ্গের প্রকাশ্য ঘোষণা দেন। জনসম্মুখে ঘোষণা দিয়ে বলেন, ‘হে মক্কাবাসী, আমরা কি আহার গ্রহণ করি না? আমরা কি বস্ত্র পরিধান করি না? দেখো, বনু হাশেম ও বনু মুত্তালিব আজ না খেয়ে মৃত্যুর মুখে পতিত হয়েছে। খোদার কসম, এই জুলুম-নির্যাতন ও পাশবিক আচরণের মূলে যে চুক্তিনামা ছিল, তা আমি টুকরো টুকরো করে ফেলব ও বয়কট উঠিয়ে নেবো।’ এরপর একে একে অন্য নেতারাও অনুরূপ বক্তব্য রাখেন এবং চুক্তিনামার অবশিষ্টাংশ ছিঁড়ে ফেলেন। এভাবে তাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এই অবরোধ ভঙ্গ হয় (সিরাতে মোস্তফা-১/২৩২)।
Leave a Reply