খারাপ কিছু হতে যাচ্ছে, এমন সম্ভাবনার প্রকাশ পায় সাধারণত কুকুরে ডাক-চিৎকার থেকে। আর এটা ছিল রাত প্রায় আড়াইটা এবং বাইরে অন্ধকার। লিবিয়ার পূর্বাঞ্চলীয় শহর দারনার ৩১ বছর বয়সী হিসাবরক্ষক হুসাম আব্দেলগাউই জেগে ওঠেন ও ঘুম চোখেই নিচে নামেন। নেমে দেখেন তার পায়ের নিচে পানি।
একই ঘরের এক অংশে হুসাম এবং অন্য অংশে তার ছোট ভাই ইব্রাহিম থাকেন। তিনি সামনের ঘরের দরজা খোলা মাত্রই হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকে পড়ে বন্যার পানি।
দু’ভাই দৌড়ে ঘরের পেছনের দিকে যান। সেখানে গিয়ে তারা অবিশ্বাস্য পরিস্থিতির সম্মুখীন হন, যা তাদের কাছে ছিল ‘মৃত্যুর চেয়েও ভয়াবহ’।
আল কুব্বাহ শহর থেকে ফোনে এভাবেই পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়েছেন তিনি।
তিনি বলেছেন, ‘শিশু ও নারীরা আমাদের পাশ দিয়ে ভেসে যাচ্ছিল। গাড়ি এবং পুরো ঘর বিদ্যুতায়িত হয়ে পড়েছিল। কিছু লাশ পানিতে ভাসতে ভাসতে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ছিল।’
হুসাম ও ইব্রাহিম পানির তোড়ে ভেসে যান। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে তারা প্রায় ১৫০ মিটার দূরে চলে যান।
২৮ বছর বয়সী ইব্রাহিম বিদ্যুতের ভাসমান তার ধরে একটি খাম্বার কাছে দাঁড়াতে সক্ষম হন, যেখানে তার ভাইও আটকা পড়েছিল। ওই তারকে রশির মতো ব্যবহার করে তারা পাশের একটি ভবনের দিকে আগাতে থাকেন এবং তৃতীয় তলার জানালা দিয়ে ঢুকে পড়েন। এরপর পাঁচতলার ছাদে গিয়ে আশ্রয় নেন।
তিনি বলেছেন, ‘আমরা যেখানে ছিলাম সেটি শহরের অন্য এলাকাগুলোর চেয়ে উঁচু এলাকা। নিচু এলাকাগুলোতে আমার মনে হয় না পাঁচ-ছয়তলা পর্যন্ত কেউ বেঁচে ছিল। মনে হয় সবাই মারা গেছে। আল্লাহ তাদের ক্ষমা করুন।’
মৃতের সংখ্যা নিয়ে বিভিন্ন তথ্য
জাতিসঙ্ঘে লিবিয়ার দূত জানিয়েছেন, কমপক্ষে ছয় হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে এবং নিখোঁজ আছে আরো কয়েক হাজার।
লিবিয়ায় রেড ক্রিসেন্টের এক কর্মকর্তা বলেছেন, মৃত্যু হয়েছে প্রায় ১০ হাজারের মতো মানুষ। অন্যদিকে দারনার মেয়র দাবি করেছেন, সম্ভবত ২০ হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছে।
দারনার বাইরের অংশে দুই বাঁধ ধ্বসে বন্যার পানি শহরে ঢুকে পড়ায় এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
১৮ বছর বয়সী শিক্ষার্থী রাহমা বেন খায়াল একটি ভবনের ছাদে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তিনি বলেছেন, ‘দারনা দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল এবং মাঝের সবকিছু বিলীন হয়ে গেছে। মাঝে যত মানুষ ছিল সবাই মারা গেছে।’
যে স্রোতে সব ভেসে গেছে তার সূচনা হয়েছিল দিনের শুরুতে হালকা বৃষ্টির মাধ্যমে।
শুরুতে এটা কোনো ভয়ের বিষয় ছিল না বলে জানিয়েছেন ২৩ বছর বয়সী মেডিক্যাল শিক্ষার্থী আমনা আল আমিন। তিনি ছোট তিন ভাই-বোনের অভিভাবক। কারণ তাদের মা-বাবার আগেই মৃত্যু হয়েছে।
বাইরে যখন বৃষ্টি হচ্ছিল, চার ভাই-বোন একটি সাততলা ভবনের দ্বিতীয় তলায় ছিলেন। তারা গেমস খেলছিলেন কিংবা ফোন নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। তারা তাদের ছোট ভাইকে একটি লাইফ ভেস্ট পড়িয়ে হাস্যরস করছিলেন।
কিন্তু রোববার রাত নাগাদ ভারী বৃষ্টিপাত শুরু হলো। সাইরেন বাজছিল। তারা আর ঘুমাতে পারছিলেন না।
ফোনে দেয়া সাক্ষাৎকারে দেয়া তিনি জানিয়েছেন, ‘এটা শুরু হলো রাত আড়াইটা নাগাদ। হৈ চৈ শুরু হলো। আমার ভাই বলল, সে রাস্তায় পানি দেখতে পাচ্ছে।’
ভূমিকম্পের মতো মনে হচ্ছিল
পানি যখন বাড়ছিল, তখন প্রতিবেশীরা ওপরের দিকে উঠে আসছিল। বিড়াল, পাসপোর্টসহ দরকারি কিছু জিনিসপত্র নিয়ে তারাও ভবনের তৃতীয় তলায় উঠে আসে। এক পর্যায়ে পানি তৃতীয় তলা পর্যন্ত চলে আসে।
তিনি বলেন, ‘এরপর সবাই চিৎকার শুরু করল। আমরা পাঁচতলায় উঠে আসলাম। শেষ পর্যন্ত আশ্রয় নিতে হলো সপ্তম তলায়। সবার মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হলো। আমি কয়েক মিনিটের জন্য ছোট ভাইকে হারিয়ে ফেলি। পরে অবশ্য খুঁজে পাই। মনে হচ্ছিল সাততলাতেও থাকতে পারব না। ছাদে যেতে হবে।’
সেখান থেকেই পাশের একটি তিনতলা ভবন দেখতে পাচ্ছিলেন তারা। ওই ভবনের ছাদ থেকে টর্চ মেরে দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছিল একটি পরিবার। কয়েক মিনিটের মধ্যেই পুরো ভবনটি পানিতে ধ্বসে যায়।
আমনা বলেছেন, ‘এটা ভূমিকম্পের মতো মনে হচ্ছিল। পরিবারটিকে এখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি। তাদের ছেলে সন্ধান করছে। আমরা তাকে বলেছি যে আমরা তাদের ভবনটি চোখের সামনে ধ্বসে যেতে দেখেছি।’
আমনার নিজের পরিবারেরও কয়েকজন এখনো নিখোঁজ। তার চাচার পরিবার তিন সন্তানসহ যে ভবনে বাস করত সেটি ধ্বসে পড়েছে।
তিনি বলেছেন, ‘রাত ৯টার দিকে আমাদের শেষবারের মতো কথা হয়েছে। তিনি কল দিয়ে নিশ্চিত হতে চেয়েছিলেন যে আমরা ঠিক আছি। এরপর থেকে তার কাছ থেকে আর কিছু আমরা শুনিনি।’
সব শেষ হয়ে গেল
বন্যার পানি কমে এলে আমনা তিন ভাইকে নিয়ে ওই ভবন থেকে সরে আসতে সক্ষম হন। তাদের পুরো রাস্তা বিলীন হয়ে গেছে।
তিনি বলেছেন, ‘মনে হচ্ছিল পৃথিবী ভাগ হয়ে গেছে। থেকে গেছে একটি অতল গহ্বর।’
তার পরিচিত একজন প্রতিবেশী পা পিছলে পানিতে পড়েছিলেন। এরপর তাকে আর পাওয়া যায়নি। তার স্বামী ও সন্তানরা তাকে বাঁচাতে পারেনি।
পরে উঁচু এলাকায় যেতে আমনা ও তার ভাইদের কয়েক ঘণ্টা হাঁটতে হয়েছে। পথে দেখেছেন অনেক লাশ। মৃতের সংখ্যা বেড়ে গেছে ব্যাপকভাবে।
হুসাম আব্দেলগাউই বলেছেন, তার অন্তত ৩০ বন্ধু এবং পরিচিত আরো অন্তত ২০০ জনের মৃত্যু হয়েছে।
তিনি বলেছেন, ‘আমি যে বেঁচে আছি এটাই বিস্ময়কর।’
দারনা শহরের যে ক্ষতি হয়েছে তাও ভয়াবহ। পুরো এলাকাটি ধ্বংস হয়ে গেছে।
ত্রিপলিতে লিবিয়ার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় স্বীকৃত সরকারের পক্ষে মোহাম্মেদ আল মেনফি বলেছেন, তারা অ্যাটর্নি জেনারেলকে বিষয়টি তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন যে বাঁধ ধ্বংসের জন্য কাদের দায় আছে।
বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা বলেছে, অনেক মানুষকে বাঁচানো যেত যদি লিবিয়ার আবহাওয়া দফতর কার্যকর থাকত।
সংস্থাটির প্রধান পেট্টেরি তালাশে বলেছেন, ‘তারা সতর্কতা ইস্যু করতে পারতেন। জরুরি ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ লোকজনকে সরিয়ে আনার চেষ্টা করতে পারত। ফলে অনেক প্রাণহানি এড়ানো যেত।
যারা বেঁচে আছে তারা এখন হন্যে হয়ে স্বজনদের খুঁজছে। মৃত স্বজন ও দারনা শহরের জন্য তারা শোকাহত।
আমনা বলেছেন, ‘আমার মনে হয় না আর সেখানে ফিরে যেতে পারব। ওই রাস্তাঘাট ছিল আমার সারাটা জীবন। শহরের প্রতিটি অলিগলি আমরা চিনতাম। সব শেষ হয়ে গেল।’
সূত্র : বিবিসি
Leave a Reply