আন্তর্জাতিক জোট ব্রিকস সদস্যপদের জন্য ৪০টি দেশ আবেদন করলেও সৌদি আরব, ইরান ও ইথিওপিয়াসহ ছয়টি দেশকে নতুন সদস্য হিসেবে বেছে নেয়ার পর প্রশ্ন উঠেছে যে কিসের ভিত্তিতে ও কোন প্রক্রিয়ায় এ দেশগুলোকে বাছাই করা হলো।
সদস্যপদ পাওয়া অন্য দেশগুলো হলো সংযুক্ত আরব আমিরাত, আর্জেন্টিনা ও মিসর। বিশ্লেষকদের ধারণা, নতুন সদস্য করার ক্ষেত্রে দুটি বিষয় কাজ করতে পারে।
প্রথমত বৈশ্বিক রাজনীতির পাশাপাশি অর্থনৈতিক কিছু সূচককে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে নতুন সদস্যপদ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে।
দ্বিতীয়ত আঞ্চলিক বর্ধিষ্ণু অর্থনীতিগুলোকেও এই সংস্থায় আনার একটি প্রচেষ্টার প্রকাশ ঘটেছে এবারের সিদ্ধান্তে।
যদিও জানা যাচ্ছে যে ব্রিকসের এই সম্প্রসারণ কিভাবে হবে তা নিয়ে কয়েক ধাপে আলোচনা হয়েছে সদস্য দেশগুলোর মধ্যে।
সেখানে এটি আদৌ সম্প্রসারণ করা যাবে কি-না তা নিয়েও আলোচনা হয়েছে। তবে ওই আলোচনায় কোনো চাপ ছিল কি-না কিংবা কোনো দেশের দিক থেকে বেশি আগ্রহ ছিল কি-না তা পরিষ্কার নয়।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, ‘দুই তিন ধাপে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সেখানে হয়ত কারো কারো চাপ ছিল বা আগ্রহ ছিল যে সম্প্রসারণ করব। কিন্তু এ বিষয়ে সবাই যে একমত হয়েই সব করেছে তাও হয়ত হয়নি।’
তিনি আরো বলেন, ‘তবে আলোচনা করেই কিছু সূচকের ভিত্তিতেই হয়ত তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’
ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকা নিয়ে গঠিত জোটই হলো ব্রিকস। প্রথমে ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত ও চীনকে নিয়ে ব্রিকের প্রথম সম্মেলন হয়েছিল ২০০৯ সালে।
পরে ওই সম্মেলনের সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে দক্ষিণ আফ্রিকাকে এ জোটে অন্তর্ভুক্ত করা হলে এর নাম হয় ব্রিকস। পরে এই জোট ২০১৫ সালে নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করে।
এবার দক্ষিণ আফ্রিকাতেই এর শীর্ষ সম্মেলন হলো এবং ওই সম্মেলন থেকেই নতুন ছয়টি দেশকে সদস্যপদ দেয়ার ঘোষণা দেয়া হলো।
দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসা জানিয়েছেন, নতুন দেশগুলোর সদস্যপদ ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে কার্যকর হবে।
দ্যা ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল বলছে, ব্রিকসের সম্প্রসারণ মূলত রাশিয়া ও চীনের জয়। কারণ তারা পশ্চিমা বিরোধী জোট হিসেবে এটিকে শক্তিশালী করতে চায়।
ছয়টি দেশ কিসের ভিত্তিতে?
দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউনে চলতি বছরের জুনে ব্রিকস জোটের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সম্মেলনে সিদ্ধান্ত হয়েছিল যে আগস্টে শীর্ষ সম্মেলন থেকেই নতুন সদস্যপদ দেয়ার ঘোষণা দেয়া হবে।
ওই সম্মেলন থেকে পাশ্চাত্যের দেশগুলোর বাইরে বিশ্বব্যবস্থার এক নতুন ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার ডাক দেয়া হয়েছিল। এ কারণেই বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের বড় অর্থনীতি বা অত্যন্ত বর্ধিষ্ণু অর্থনীতির দেশগুলো সদস্যপদ পাওয়ার ক্ষেত্রে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলছেন, ‘প্রথমে আলোচনা হয়েছে জোটটি সম্প্রসারণ করা হবে কি-না। এ বিষয়ে সিদ্ধান্তের পর আলোচনায় এসেছে কিসের ভিত্তিতে গ্রহণ করা হবে। সেখানে ইথিওপিয়া ছাড়া অন্য দেশগুলোর ক্ষেত্রে অর্থনীতির আকার কিংবা মাথাপিছু আয়ের মতো বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।’
যদিও এর বাইরেও বৈশ্বিক রাজনীতির বিষয়টিও এক্ষেত্রে কাজ করতে পারে বলে অনেকে মনে করেন।
বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হচ্ছে, নতুন সদস্যপদ দেয়ার ক্ষেত্রে ভেনেজুয়েলার মতো মার্কিন নিষেধাজ্ঞার আওতায় থাকা দেশগুলোকে সদস্যপদ না দেয়ার পক্ষে ছিল ভারত।
যদিও শেষ পর্যন্ত ইরানকে যে সদস্যপদ দেয়া হলো তাতে অর্থনীতির চেয়ে রাজনীতিই বেশি প্রাধান্য পেয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘জোটের সদস্যদের মধ্যে যে আলোচনা হয়েছে তাতে তারা এটিকে ঠিক মার্কিন বিরোধী জোট হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাননি। ভারত মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় থাকা দেশগুলোকে নিতে চায়নি। কিন্তু ইরানকে সদস্যপদ দেয়া হয়েছে। তাই বলা যায় একটি মাপকাঠি করা হলেও তাতেও সম্ভবত সব দেশ একমত হতে পারেনি।’
তবে ব্রিকস নেতারা যেটি দেখাতে চাইছেন তা হলো বিশ্ব বাণিজ্য ও উৎপাদনের বড় অংশই তাদের করায়ত্ত এবং এ কারণেই তুলনামূলক বর্ধিষ্ণু অর্থনীতির দেশগুলোকে এবার প্রাধান্য দেয়া হয়েছে।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, ‘তারা বৈশ্বিক বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও জিডিপি- ২৫ শতাংশ থেকে ৪০ শতাংশে নেয়ার চেষ্টা করছে। বিকল্প অর্থব্যবস্থা করতে হলে এটি গুরুত্বপূর্ণ। আর বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে জ্বালানি অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলো।’
সৌদি আরব কেন?
যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যম সিএনএনের বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, ব্রিকসের নতুন ঘোষণার মাধ্যমে বিশ্বের সবচেয়ে বড় তেল রফতানিকারক দেশ সৌদি আরব বিশ্বের সবচেয়ে বড় তেল আমদানিকারক দেশ চীনের সাথে একই অর্থনৈতিক জোটে যোগ দিলো।
এর আরেকটি অর্থ হচ্ছে, তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোর জোট ওপেকের সদস্য রাশিয়া ও সৌদি আরব একে অপরের সাথে আরো একটি নতুন অর্থনৈতিক ব্লকে অংশ নিতে যাচ্ছে।
এই দুটি দেশ প্রায়ই তেল উৎপাদন কার্যক্রম নিয়ে নিজেদের মধ্যে সমন্বয় করে, যা নিয়ে অতীতে অনেক সময় সৌদি আরবকে তার আরেক মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বিব্রতও হতে হয়েছে।
আরব আমিরাত
অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের মতে, বর্ধিষ্ণু বড় অর্থনীতি আর জ্বালানি অর্থনীতি- এ দুটি বিষয়ের বিবেচনা থেকেই আরব আমিরাতকে সদস্যপদ দিচ্ছে ব্রিকস।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশটির অর্থনীতি ব্যাপকভাবে বিকশিত হচ্ছে এবং দেশটি এখন বিশ্বে বিনিয়োগের আকর্ষণীয় জায়গাগুলোর একটিতে পরিণত হয়েছে।
ইরান
মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে ইরানকে সদস্যপদ দেয়া হবে কি-না এ নিয়ে ব্রিকস সদস্যদের মধ্যে মতভেদ ছিল। বিশেষ করে ভারত চেয়েছিল সরাসরি নিষেধাজ্ঞায় থাকা দেশগুলোকে আপাতত নেয়া হোক।
কিন্তু ইরানের বিষয়ে চীনের চাপ ছিল এবং আগ্রহ ছিল রাশিয়ারও। এ কারণেই শেষ পর্যন্ত নমনীয় হতে হয়েছে ভারতকে।
এছাড়া জ্বালানি অর্থনীতির দৃষ্টিভঙ্গিও ইরানের সদস্যপদ প্রাপ্তির পক্ষেই কাজ করেছে। বলা হয় মধ্যপ্রাচ্যের তেলের এক চতুর্থাংশই এ দেশটিতে সংরক্ষিত আছে।
আর্জেন্টিনা
অনেক দিন ধরেই দক্ষিণ আমেরিকার দেশ আর্জেন্টিনা ব্রিকসের সদস্য হওয়ার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করে আসছিল।
যুক্তরাষ্ট্রের উইলসন সেন্টারের ব্লগে বস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর জর্জ হেইনে লিখেছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সাথে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক আছে আর্জেন্টিনার। ব্রিকসের সদস্যপদ লাভের মধ্য দিয়ে নিজেকে একধাপ এগিয়ে নিল দেশটি।
আর্জেন্টিনা দক্ষিণ আমেরিকার দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ। দেশটি নিজে থেকেই ব্রিকসে যোগ দিতে আগ্রহী ছিল। দেশটি অর্থনৈতিক ও সার্বভৌম ঋণ সঙ্কটের মধ্যে আছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও তলানিতে।
তবে ব্রিকস সদস্যপদ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে এর অর্থনীতির আকারকেই বিবেচনায় নেয়া হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
মিসর ও ইথিওপিয়া কেন?
এ দুটি দেশকে কোন বিবেচনায় ব্রিকসের সদস্যপদের জন্য মনোনীত করা হয়েছে তার ঠিক সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি।
যদিও ইথিওপিয়া আফ্রিকার দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির একটি। মাথাপিছু আয় অনেক কম হলেও দেশটির অর্থনীতির আকার ও সম্ভাবনা বিবেচনা নিয়েই সদস্য পদ দেয়ার সিদ্ধান্তটি নেয়া হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন।
অন্যদিকে মিশর আগেই ব্রিকসের নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকে যোগ দিয়েছিল। দেশটি আঞ্চলিক রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ এবং অর্থনীতিও শক্তিশালী।
তবে ব্রিকসের সদস্যপদ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে দেশটির অর্থনীতির পাশাপাশি আন্তর্জাতিক রাজনীতিও হয়ত ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করা হচ্ছে।
সূত্র : বিবিসি
Leave a Reply