বছরের শুরুর দিকে সরকারবিরোধীদের সভা-সমাবেশ পালনে কিছুটা নমনীয় নীতি দেখালেও বিএনপির সরকার পতনের এক দফা আন্দোলন ঘোষণার পরই নড়েচড়ে বসেছে সরকার। বিএনপি ও তার মিত্রদের সরকার পতনের ঘোষণাকে আন্দোলনের চূড়ান্ত ধাপ মনে করা হচ্ছে। এ জন্য আন্দোলন দমনে ফের হার্ডলাইনে গেছে সরকার। সরকারবিরোধীদের এক দফা আন্দোলন ও হুমকি অস্তিত্বের লড়াই হিসেবেও দেখছে সরকারের নীতিনির্ধারণী মহল। বিভিন্ন সভা-সমাবেশে দল ও সরকারের শীর্ষ নেতাদের বক্তব্যেও তা উঠে আসছে।
সূত্র বলছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতির পর থেকে বিএনপি ও তার মিত্রদের সভা-সমাবেশ পালনে উদারতা দেখালেও সরকারের পদত্যাগ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহালের দাবিতে কোনোভাবেই বড় ধরনের আন্দোলন গড়ে তুলতে দিতে রাজি নয় আওয়ামী লীগ সরকারের শীর্ষ পর্যায়। এ জন্য বিএনপি ও তার মিত্রদের নেতাকর্মীদের নামে পুলিশের দেয়া আগের মামলাগুলো জোরালোভাবে সচল করা হয়েছে। আবার চলমান সভা-সমাবেশ পালনকালে জ্বালাও-পোড়াও ও সহিংসতার অভিযোগে নতুন নতুন মামলা দিয়ে নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করে আন্দোলন দমন করার কৌশল নেয়া হচ্ছে। গত শনিবার দেশের বিভিন্ন স্থানে বিএনপির পদযাত্রা কর্মসূচি পালনকালে হামলা, সংঘর্ষ ও পুলিশের গুলির ঘটনা ঘটেছে। কেন্দ্রীয়ভাবে কর্মসূচি পালনের পর রাতে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সদস্যসচিব তানভীর আহমেদ রবিনসহ বেশ কয়েকজন নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এর আগে ২৯ জুলাই রাজধানীর প্রবেশপথে বিএনপি অবস্থান কর্মসূচি পালন করতে চাইলে আইনশৃঙ্খলাবাহিনী তাদের মাঠে দাঁড়াতে দেয়নি। এর পর থেকেই বিরোধীদের দমনে ব্যাপক হারে ধরপাকড় ও অভিযান শুরু হয়েছে। সূত্র আরো বলছে, জামায়াতের শীর্ষ নেতা মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মৃত্যুর পর দলটি জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে নামাজে জানাজার অনুষ্ঠান করতে চাইলে পুলিশ অনুমতি না দিয়ে পিরোজপুর পাঠিয়ে দেয়।
এর আগে গত বছরের ১০ ডিসেম্বর বিএনপি নয়াপল্টনে সমাবেশ করতে চাইলে সরকার কঠোর অবস্থানে চলে যায়। সমাবেশের আগের দিন বিএনপি মহাসচিব আগে মির্জা ফখরুল আলমগীরসহ শীর্ষ নেতাদের কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে গ্রেফতার করলে আন্দোলনের গতি অনেকটা থমকে যায়। যদিও দলটি শেষমেশ পুলিশের অনুমতি নিয়ে রাজধানীর গোলাপবাগ মাঠে সমাবেশ করে।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতার সাথে আলাপকালে জানা গেছে, দীর্ঘ দিন ধরেই বিএনপি সরকার পতন আন্দোলনের কথা বলে আসছে। এখন তারা সরকার পতনের এক দফা নিয়ে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে সভা-সমাবেশ করছে। দাবি আদায়ে ঢাকায় একটা অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করে সরকারকে বেকায়দায় ফেলার পরিকল্পনা বিএনপির রয়েছে। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার দেয়া তথ্যের মাধ্যমে সরকার সেটি জানতে পেরেছে। সে জন্য সরকারি দল হিসেবে আওয়ামী লীগের তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত সতর্ক বার্তা দেয়া হয়েছে। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের যেকোনো জায়গায় বিএনপিকে বড় ধরনের কোনো আন্দোলন আওয়ামী লীগ কোনোভাবেই চাঙ্গা হতে দেবে না। এর আগেও বিএনপির রাজপথ দখলের ঘোষণা দেয়ার পরই রাজধানীতে বড় ধরনের সমাবেশ করে শক্তি প্রদর্শন করা হয়েছে। সাম্প্রতিক রাজপথে বড় বড় সমাবেশ করেও বিএনপিকে একটি বার্তা দেয়া হয়েছে তা হলো- আওয়ামী লীগ রাজপথ ছাড়েনি। যেকোনো পরিস্থিতিতে নেতাকর্মীরা রাজপথ দখলে রাখবে। তবে আওয়ামী লীগ চায়, বিএনপি তাদের দাবি আদায়ে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করুক এবং সেই আন্দোলন শুধু বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয় নয়াপল্টনে সীমাবদ্ধ থাকুক। তবে সেটিও হতে হবে ছুটির দিনে, যাতে জনগণের দুর্ভোগ না হয়। বিএনপি শান্তিপূর্ণভাবে কর্মসূচি পালন করলে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীও নমনীয় নীতি দেখাবে।
সরকারের হার্ডলাইনে থাকা প্রসঙ্গে বিশিষ্ট সংবিধান ও রাজনীতি বিশেষজ্ঞ ইকতেদার আহমেদ গতকাল নয়া দিগন্তকে বলেন, বিএনপি ও তার জোটসঙ্গীরা যাতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহালের দাবিতে কোনো ধরনের আন্দোলন গড়ে তুলতে না পারে সে জন্য সরকার আইনশৃঙ্খলাবাহিনী দিয়ে তাদের ওপর দমন-পীড়ন চালাচ্ছে। এটা সরকারের একটা কৌশল। সরকার ভালো করে জানে, বিএনপিকে আন্দোলনের সুযোগ করে দিলে তারা তাদের দাবি আদায় করতে সক্ষম হবে। আর নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে ওই নির্বাচনে জনগণ সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে ভোট দিতে পারলে আওয়ামী লীগ নিশ্চিত পরাজিত হবে। এটা জেনেই আইনশৃঙ্খলাবাহিনীকে দলীয় ক্যাডার হিসেবে সরকার ব্যবহার করছে। তিনি আরো বলেন, এভাবে দমন-পীড়নের মাধ্যমে সরকার চায়, অতীতের দু’টি নির্বাচনের মতো আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক। দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত ওই নির্বাচনে বিএনপিও অংশগ্রহণ করুক। জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে সরকার এ ধরনের নানা অপকৌশলের আশ্রয় নিচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের প্রবীণ রাজনীতিক অ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন নয়া দিগন্তকে বলেন, এখন বিএনপির ওপর যা হচ্ছে তার থেকে কয়েকগুণ বেশি হয়েছিল আওয়ামী লীগের ওপর। এখন তো বিএনপি কিছুটা হলেও সভা-সমাবেশ পালন করতে পারছে; কিন্তু আওয়ামী লীগ সেটি পারেনি। যেভাবে নির্যাতন-নিপীড়ন চালানো হয়েছিল তা নজিরবিহীন। যদিও এটা একটা রাজনৈতিক কালচার হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি বলেন, এই কালচার থেকে বেরিয়ে আসতে হলে সব রাজনৈতিক দলকে গণতন্ত্র ও অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে হবে। রাজনীতিবিদদের একে অপরের প্রতিও শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। কিন্তু অদূর অবিষ্যতে সেটি হবে কি না জানি না।
Leave a Reply