অবতরণের দিক থেকে পবিত্র কুরআনুল কারিমের প্রথম পূর্ণাঙ্গ সূরা হচ্ছে সূরা ফাতিহা। অবশ্য এর আগে সূরা ইকরা, সূরা মুজাম্মিল ও সূরা মুদ্দাসসিরের কয়েকটি আয়াত অবতীর্ণ হলেও পরিপূর্ণ সূরা রূপে এর আগে কোনো সূরা নাজিল হয়নি। আর এ জন্যই এ সূরার নাম রাখা হয়েছে- ফাতিহাতুল কিতাব বা কুরআনের উপক্রমণিকা।
এ ছাড়াও হাদিস শরিফে সূরা ফাতিহাকে উম্মুল কুরআন, উম্মুল কিতাব, কুরআনে আজিম, সূরায়ে শেফাসহ অসংখ্য বিশেষণে বিশেষায়িত করা হয়েছে।
সূরা ফাতিহার আয়াতগুলো এমনভাবে বিন্যাস করা হয়েছে যেখানে আল্লাহর প্রশংসা করার পাশাপাশি মানুষের পক্ষ থেকে আল্লাহর কাছ থেকে কোনো কিছু চেয়ে নেয়ার বিষয়টিও ধারাবাহিকভাবে উঠে এসেছে।
হাদিসে কুদসিতে এসেছে, হজরত আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত- রাসূল সা: ইরশাদ করেছেন, আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘সালাত (অর্থাৎ সূরা ফাতিহা) আমার এবং আমার বান্দাদের মধ্যে দু’ভাগে বিভক্ত। অর্ধেক আমার জন্য আর অর্ধেক আমার বান্দাদের জন্য। আমার বান্দারা যা চায়, তা তাদেরকে দেয়া হবে।’
অতঃপর রাসূল সা: বলেন, ‘যখন বান্দারা বলে- আলহামদুলিল্লাহ তখন আল্লাহ বলেন, আমার বান্দারা আমার প্রশংসা করল। আর যখন বলে- আর রাহমানির রাহিম তখন তিনি বলেন, আমার বান্দা আমার গুণগান করল। আর যখন বলে মালিকি ইয়াওমিদ্দিন তখন তিনি বলেন, আমার বান্দা আমার মর্যাদা বর্ণনা করল। আর যখন বলে- ‘ইয়্যাকানাবুদু ওয়া ইয়্যাকানাসতায়িন তখন তিনি বলেন- এ আয়াতটি আমার এবং আমার বান্দাদের মধ্যে সংযুক্ত। কেননা, এর এক অংশে আমার প্রশংসা এবং অন্য অংশে বান্দাদের দোয়া ও আরজ রয়েছে এবং বান্দার জন্য তা-ই রয়েছে যা সে চাইবে।
অতঃপর বান্দারা যখন ইহদিনাস সিরতাল মুসতাকিম থেকে শেষ পর্যন্ত তিলাওয়াত করে তখন আল্লাহ তায়ালা বলেন- এসবই আমার বান্দাদের জন্য এবং তারা যা চাইবে তা পাবে।’ (মুসলিম)
একটি সমীকরণ ভাবলেই নির্মল আনন্দে মন উদ্বেলিত হওয়া উচিত, শুধু ফরজ সালাতগুলো হিসাব করলেও প্রতিদিন কমপক্ষে ১৭ বার আপনি জমিনে বসে সূরা ফাতিহা পাঠ করে আপনার রবের প্রশংসা করছেন, তাঁর দরবারে আপনার চাওয়াগুলো পেশ করছেন; আর তিনি সরাসরি আসমান থেকে তার জবাব দিচ্ছেন!
সাত আয়াতের এই সূরায় আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা মধ্যের আয়াতে এমন কিছু বলেছেন যেটি সূরা ফাতিহার প্রথম অংশ ও পরের অংশ, দুই অংশেরই প্রতিনিধিত্ব করে। অর্থাৎ সূরা ফাতিহার প্রথম তিন আয়াতের দিকে যদি লক্ষ করি তাহলে দেখা যায়, এখানে প্রথমেই সব সৃষ্টিজগতের পালনকর্তা আল্লাহ তায়ালার প্রশংসার কথা বলা হয়েছে।
শুধু তাই নয়, এই আয়াতের আলহামদু শব্দটির শুরুতে আলিফ-লাম আসার কারণে সর্ববিধ প্রশংসা একমাত্র আল্লাহর জন্য খাস তথা নির্দিষ্ট হয়ে গেছে। অন্য কেউই প্রশংসা পাওয়ার দাবি রাখে না।
তারপরের আয়াতে আল্লাহর দয়ার অসাধারণত্ব ও পূর্ণতার কথা বোঝাতে রহমান ও রাহিম-এ দু’টি গুণবাচক নাম উল্লেখ করা হয়েছে। প্রখ্যাত তাফসিরবিদ সাহাবি আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা: বলেন, এ গুণবাচক নাম দু’টি অতি সূক্ষ্ম। তন্মধ্যে একটি অপরটির চেয়ে অধিকতর সূক্ষ্ম অর্থাৎ অধিক রহমতসম্পন্ন।
আর তৃতীয় আয়াত অর্থাৎ মালিকি ইয়াওমিদ্দিন দ্বারা শেষ দিবসে আল্লাহর একচ্ছত্র মালিকানার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। যদিও এই আয়াতে সেই বিচারদিন কেমন হবে তার প্রকৃত রূপ সম্পর্কে বলা হয়নি; কিন্তু পবিত্র কুরআনের সূরা ইনফিতারের ১৭-১৯ নম্বর আয়াতের মাধ্যমে সেই দিনের পারিপার্শ্বিক গুরুগম্ভীর পরিস্থিতি সম্পর্কে বিস্তারিত অবগত হওয়া যায়। আর অবশ্যই সেই দিনটি হবে, নেককারদের পুরস্কার এবং গুনাহগারদের শাস্তি প্রদানের দিন। এ প্রসঙ্গে সূরা নূরের ২৫ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আজকের দিনে আল্লাহ লোকদের প্রকৃত কর্মফল পূর্ণ করে দেবেন।’
অর্থাৎ সূরা ফাতিহার প্রথম অংশে আল্লাহ তায়ালার তারিফ ও প্রশংসার সাথে সাথে ঈমানের মৌলিক নীতি এবং আল্লাহর একত্ববাদের বর্ণনা ধ্বনিত হয়েছে।
এবার যদি চতুর্থ আয়াত অর্থাৎ ইয়্যাকানাবুদু ওয়া ইয়্যাকানাসতায়িন-এর দিকে লক্ষ করি, সেখানে বলা হয়েছে- আমরা তোমারই ইবাদত করি এবং তোমার কাছেই সাহায্য প্রার্থনা করি।
অর্থাৎ প্রথম অংশ আমরা তোমারই ইবাদত করি দিয়ে একজন বান্দা নিঃশর্তভাবে আল্লাহর বন্দিগি স্বীকার করেছে। আল্লাহকে একমাত্র মাবুদ হিসেবে মেনে নিয়ে মানুষ সৃষ্টির মূল উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে আত্মনিয়োগ করেছে।
তাই বলা যায় চতুর্থ আয়াতের এই প্রথম অংশটুকু মূলত প্রথম তিন আয়াতেরই প্রতিনিধিত্ব করে।
আর দ্বিতীয় অংশ আমরা তোমার কাছেই সাহায্য প্রার্থনা করি দিয়ে শিরকের সব পথ রুদ্ধ করে দেয়া হয়েছে। একমাত্র আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো বন্দিগি করা যেমন জায়েজ নয়, তেমনি তিনি ছাড়া অন্য কারো কাছে সাহায্য প্রার্থনা করাও আত্মসমর্পণকারী মুসলমানের জন্য বৈধ নয়।
আমাদের সমাজে এ রকম অনেকেই আছেন, যারা পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করেন, সময়মতো সাহরি-ইফতার করে ঠিকঠাক রোজাও রাখেন; কিন্তু বিপদে পড়লে সবার আগে মাজারে দৌড়ান! মুসিবত থেকে মুক্তির জন্য পীর-ফকিরের কাছে সমাধান চান। সূরা ফাতিহার চতুর্থ আয়াতে এসব কিছু নাকচ করে দিয়ে একমাত্র সাহায্যকারী হিসেবে আল্লাহ তায়ালাকে নির্দিষ্ট করা হয়েছে।
এবার পরের অংশ অর্থাৎ শেষ তিন আয়াতের দিকে লক্ষ করলে দেখা যায়, এই আয়াতগুলোতে মানুষকে দোয়া ও আবেদনের এক বিশেষ পদ্ধতি শিক্ষা দেয়া হয়েছে। এখানে সিরাতুল মুস্তাকিম তথা সরল সঠিক পথ প্রাপ্তির জন্য আল্লাহর কাছে সাহায্য চাওয়া হয়েছে।
এখন যদি প্রশ্ন আসে, সরল পথ কোনটি? এর উত্তরে তাফসিরে মাআরেফুল কুরআনে বলা হয়েছে- শরিয়তের সে রাস্তা যাতে ইফরাত বা তফরিতের কোনো সুযোগ নেই। ইফরাত অর্থ- সীমা অতিক্রম করা, তফরিত অর্থ- নিজের মর্জিমতো কাটছাঁট করে নেয়া। সূরা ফাতিহার সর্বশেষ দুই আয়াতে আল্লাহ তায়ালা সরল সঠিক পথের স্পষ্ট ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন- ‘আল্লাহর অভিসম্পাতগ্রস্ত ও পথহারাদের পথ নয়; বরং আল্লাহর অনুগ্রহপ্রাপ্তদের পথ।’
অতএব, সূরা ফাতিহার শেষ তিন আয়াতে এমন পন্থা অবলম্বনের ব্যাপারে নির্দেশনা এসেছে, যে পথে অবিচল থাকলে, মূর্খতা ও অজ্ঞতার দরুণ ধর্মে অতিরঞ্জন ও বাড়াবাড়ি করার পথ রুদ্ধ হয়ে যাবে। পাশাপাশি নফসের গোলামি করে মন্দকাজের অনুগামী হওয়ারও কোনো সুযোগ থাকবে না।
মাত্র সাত আয়াতের ছোট্ট সূরা সূরা ফাতিহার প্রত্যেকটি আয়াত এত নিগূঢ় অর্থ বহন করে যে, এর একেকটি আয়াতের ওপর আলাদা আলাদাভাবে একেকটি রিসার্চ পেপার লেখা সম্ভব। এর প্রথম অংশে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতায়ালা তাঁর প্রশংসা-মাহাত্ম্য এবং দ্বিতীয় অংশে তাঁর কাছে সরল সঠিক পথ অন্বেষণ করার পন্থা অত্যন্ত নিখুঁতভাবে উপস্থাপন করেছেন।
লেখক :
Leave a Reply