‘ইন্ট্রো’, ‘ইন্ট্রো’, ‘ইন্ট্রো’ – বুধবার রাতে কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ছাত্র স্বপ্নদীপ কুণ্ডুর মৃত্যুর পর থেকে যেন ওই একটা শব্দ বিভীষিকা হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিক্ষার্থীদের একাংশের দাবি, ‘ইন্ট্রো’ শব্দটা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন শিক্ষার্থীদের বা আবাসিক শিক্ষার্থীদের কাছে স্রেফ ইংরেজি শব্দ ‘ইন্ট্রোডাকশন’-র (পরিচিতি) সংক্ষিপ্ত রূপ নয়। ওই একটা শব্দ তাদের কাছে বিভীষিকা। ওই একটা শব্দ কত প্রতিভার ফুলকে বিকশিত হতে হয়নি, কত শিক্ষার্থীর স্বপ্নকে ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে, তার কোনো ইয়ত্তা নেই বলে দাবি করেছেন শিক্ষার্থীদের একাংশ।
কিন্তু কী এই বিভীষিকার ‘ইন্ট্রো’? বিষয়টি নিয়ে মুখ খুলেছেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র। যিনি স্নাতক স্তরের ছাত্র বলে জানিয়েছেন। ওই ছাত্র জানিয়েছেন, যাদবপুরে ভর্তি হওয়ার পর প্রাথমিকভাবে রোজ বাড়ি থেকে যাতায়াত করতেন (বাড়ি থেকে দূরত্ব প্রায় ১০০ কিলোমিটার)। অবশেষে গত বছর হস্টেলে থাকার সুযোগ থাকা পেয়েছিলেন। কিন্তু সেটা যে আদতে ‘সুযোগ’ নয়, বরং বিভাষিকা, তা বুঝতে একটা রাতই যথেষ্ট ছিল বলে জানিয়েছেন ওই ছাত্র।
দুঃখ, যন্ত্রণা, আতঙ্কের মধ্যেই স্নাতক স্তরের ওই ছাত্র জানান, হস্টেলে আসার পর খাওয়া-দাওয়া মিটলে ‘ইন্ট্রো’-র জন্য ডাক পড়েছিল। ‘ইন্ট্রো’ বিষয়টা কী, তা বুঝিয়ে দিতে বলা হয়েছিল ওই ছাত্রের রুমমেটকে। যিনি ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে যাদবপুরে পড়াশোনা করেন (সিনিয়র)। আর ওই সিনিয়র ভাই যা বলেছিলেন, তাতে আতঙ্কের চোরাস্রোত বয়ে গিয়েছিল তার শরীর দিয়ে।
ওই ছাত্র জানিয়েছেন, ‘ইন্ট্রো’-র নিয়ম অনুযায়ী, প্রতিদিন ঘড়ির কাঁটা ১১টা বা ১২টা ছুঁলে হস্টেলের প্রতিটি দরজায় ধাক্কা দিতে হয়। ওইসময় নামমাত্র পোশাক পরে থাকতে হয় ছাত্রদের (উল্লেখ্য, স্বপ্নদীপের নগ্ন লাশ উদ্ধার করা হয়)। সিনিয়ররা দরজা খোলার পর গড়গড় করে কয়েকটি বিষয় মুখস্থ বলতে হয়। কী কী বলতে হবে, সেটার একটা নির্দিষ্ট ‘ফর্ম্যাটও’ আছে। নিজের নাম, বাবার নাম, মায়ের নাম, জন্মতারিখ, বাবা-মায়ের যৌনমিলনের তারিখ, শিক্ষাগত যোগ্যতা বলতে হয়। সেখানেই রেহাই মেলে না। নিজের শারীরিক গঠনের বর্ণনা দিতে হয়। আর ‘ইন্ট্রো’-র সময় মুখ ফসকে ইংরেজি শব্দ বেরিয়ে গেলেই করা হয় শারীরিক অত্যাচার। দরজার খিল দিয়ে হাঁটুতে মারা হয়। নয়তো কান ধরে ওঠবোস করার শাস্তি দেন সিনিয়ররা।
আর ‘ইন্ট্রো’-র নামে তথাকথিত ‘ভালো’ ছেলেদের অত্যাচারের বহর সেখানেই শেষ হয় না বলে ওই ছাত্র জানিয়েছেন। তার কথায়, এক সিনিয়র ভাইয়ের থেকে জানতে পেরেছিলেন যে যতদিন না হস্টেলের প্রতিটি ছাত্র নিমেষের মধ্যে নিজের পুরুষাঙ্গের আকৃতি তথা দৈর্ঘ্য বলতে পারছেন, ততদিন ‘ইন্ট্রো’ চলতে থাকবে। প্রতিদিনের ‘ইন্ট্রো’-র মেয়াদ হয় আড়াই থেকে তিন ঘণ্টা। রাত ২টা ৩০ মিনিট চলে ‘ইন্ট্রো’। সাথে আরো নানারকমভাবে হেনস্থা করা হয়। ওই ছাত্র জানিয়েছেন, ক্লাসের সব মেয়ের (‘মামনি’ হিসেবে বলা হতো) বিষয়ে খুঁটিনাঁটি তথ্য দিতে হয় সিনিয়রদের। সপ্তাহে এক দিন সিনিয়রদের পানি ভরে দিতে হবে। একেবারে ছোট-ছোট চুল কাটতে হবে (স্বপ্নদীপের বাবারও অভিযোগ যে ছেলেকে চুল কাটতে জোরজুলুম করা হয়েছিল)।
তবে স্বপ্নদীপকেও সেরকম বিভীষিকার শিকার হতে হয়েছিল কিনা, র্যাগিংই তার প্রাণ কেড়েছে কিনা, তা এখনো প্রমাণিত হয়নি। তবে শুক্রবার রাতে যে সৌরভ চৌধুরীকে গ্রেফতার করেছে যাদবপুর থানার পুলিশ, স্বপ্নদীপের বাবার দায়ের করা এফআইআরে তার নাম ছিল। তার নেতৃত্বেই ছেলেকে অত্যাচারিত হতে হয়েছিল বলে দাবি করেছেন স্বপ্নদীপের পরিবার। তিনি রোববারই হস্টেলে এসেছিলেন। আর বুধবার ওই হস্টেল থেকে নিথর লাশ বেরিয়ে এসেছে।
সূত্র : হিন্দুস্তান টাইমস
Leave a Reply