কিয়েভের নজর এখন স্পষ্টতঃই একইসাথে দু’দিকে। একটা হলো ওয়াগনার গ্রুপের বিদ্রোহের পর তাদের এবং তাদের নেতা ইয়েভগেনি প্রিগোশিনের ভাগ্যে কী ঘটে। অন্যটা হলো, এর ফলে ভ্লাদিমির পুতিন এবং ইউক্রেনে তার শুরু করা যুদ্ধের পরিণতি কী হয়।
সীমান্তের ওপারে রাশিয়ায় যে নাটকীয় ঘটনা ঘটে গেল- তাতে কিয়েভে এই ধারণা ক্রমশঃ বদ্ধমূল হচ্ছে যে যে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট হিসেবে ভ্লাদিমির পুতিনের সময় শেষ হয়ে আসছে।
“আমার মনে হয়, ক্ষণগণনা শুরু হয়ে গেছে” – বললেন আন্দ্রিই ইয়েরমাক, প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির ঘনিষ্ঠতম উপদেষ্টা।
কিয়েভে এক ব্রিফিংএর সময় ইয়েরমাক বলছিলেন ২০১৪ সালের কথা – যে বছর রাশিয়া প্রথমবার ইউক্রেনে অভিযান চালিয়ে ক্রাইমিয়া উপদ্বীপ দখল করে নিয়েছিল।
“সেই ২০১৪ সাল থেকে ইউক্রেন যা দেখে আসছে তা এখন সারা দুনিয়ার কাছে স্পষ্ট হয়ে গেছে”- বলছিলেন তিনি।
“রাশিয়া হচ্ছে একটি সন্ত্রাসী দেশ- যার নেতা এমন একজন অনুপযুক্ত লোক যিনি বাস্তবের সাথে সংযোগ হারিয়ে ফেলেছেন।বিশ্বের এখন এটা উপলব্ধি করা উচিত যে এই দেশটির সাথে কোনো সিরিয়াস সম্পর্ক রাখা সম্ভব নয়।”
ইউক্রেনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা – যারা কিয়েভে বিবিসির সাথে কথা বলেছেন -তারা সবাই এখন বলছেন যে প্রেসিডেন্ট পুতিন যেরকম গুরুতরভাবে তার কর্তৃত্ব হারিয়ে ফেলেছেন তা কাটিয়ে ওঠা তার পক্ষে সম্ভব নয়।
তারা বলছেন, এর শুরু হয়েছিল গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে ইউক্রেনে পূর্ণমাত্রার সামরিক অভিযান চালানোর সেই বিপর্যয়কর সিদ্ধান্ত দিয়ে।
এর পর ওয়াগনার বিদ্রোহ, আর প্রিগোশিন যেভাবে ইউক্রেন যুদ্ধের সপক্ষে ক্রেমলিনের দেয়া যুক্তি উড়িয়ে দিয়েছেন – তার পরে পুতিনের ক্ষমতায় টিকে থাকার যেটুকু সম্ভাবনা অবশিষ্ট ছিল, তা-ও শেষ করে দিয়েছে।
“পুতিনের শাসকচক্রকে আর রক্ষা করা যাবে না” -বলেন তাদের একজন।
তবে এটা অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে ইউক্রেনীয়রা তাদের শত্রু রাশিয়ানদের সম্পর্কে যাই বলুক – তাকে দেখতে হবে এই যুদ্ধের আলোকে। কারণ তারা এ যুদ্ধকে তাদের জাতীয় অস্ত্বিত্বের সংগ্রাম হিসেবেই দেখছে।
ইউক্রেনীয়রা তাদের ‘মিডিয়া যুদ্ধ’ চালিয়েছে বুদ্ধিমত্তার সাথে। তারা তাদের দেশের মানুষ, পশ্চিমা মিত্র এবং মস্কোয় থাকা শত্রুদের উদ্দেশ্যে দেয়া বার্তাগুলোতে সবসময়ই ধারাবাহিকতা রক্ষা করেছে।
সাংবাদিকদের কাছে তারা এ যুদ্ধের ব্যাপারে যে মতামত প্রকাশ করে – তার মধ্যে নিশ্চয়ই একটা ‘উইশফুল থিংকিং’ অর্থাৎ তারা যেভাবে ঘটনা ঘটতে দেখতে চায় তার একটা প্রতিফলন পড়ে।
কিন্তু এতে কোনো সন্দেহই নেই যে তাদের চরম শত্রু ভ্লাদিমির পুতিন ২০০০ সালে প্রেসিডেন্ট হবার পর এবারই তার কর্তৃত্বের প্রতি সবচেয়ে গুরুতর চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন।
কিয়েভের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলেন, তারা নিশ্চিত যে রাশিয়ার ভেতরের মহলের কিছু বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠী – যা আনুষ্ঠানিক নয়, কিন্তু সংগঠিত – পুতিনের বিরোধিতা করছে।
ইউক্রেনের জাতীয় নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা কাউন্সিলের সচিব ওলেক্সি দানিলভ বিবিসিকে বলছেন, “প্রিগোশিন তাদের মধ্যে সবচেয়ে সিনিয়র নয়। তারা হয়তো এখন নতুন রাজনৈতিক এলিট হয়ে উঠতে পারে।”
দানিলভ বলছেন, এদের মধ্যে আছে নিরাপত্তা বাহিনীগুলো, রুশ অলিগার্কদের প্রতিনিধি ও কর্মকর্তারা।
তার মতে, এরা বিশ্বাস করে যে পুতিন ফেব্রুয়ারি মাসে ইউক্রেনে পূর্ণমাত্রার সামরিক অভিযান চালানোর যে সিদ্ধান্ত নেন তা তাদের জন্য ব্যক্তিগত বিপর্যয় ডেকে এনেছে এবং রাশিয়ার জন্যও হুমকি হয়ে উঠেছে।
কিন্তু তার এসব বিশ্লেষণের পক্ষে কি কোন প্রমাণ আছে? আমি এ প্রশ্ন করায় কালো সামরিক-ধাঁচের পোশাক পরা ষাটোর্ধ্ব দানিলভ এক মুহূর্তের জন্য বিরক্ত হলেন।
“আমি অনুমানের ভিত্তিতে কথা বলছি না” – জোর দিয়ে বললেন তিনি, “আমরা জানি ওইসব লোকেরা কারা, তাদের জীবন সম্পর্কেও আমরা জানি।”
প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির আরেকজন ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টা হচ্ছেন মিখাইলো পডোলিয়াক।
তিনি দানিলভের সাথে একমত, এবং তার কথা হলো, রাশিয়াতে এমন “বেশ কয়েকটি গোষ্ঠী আছে যারা ক্ষমতা দখল করতে চায়।”
পুতিন যে শাসনকাঠামো গড়ে তুলেছেন তা ওপর-থেকে-নিম্নমুখী এবং কর্তৃত্ববাদী। পডোলিয়াক দাবি করছেন, এখন ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে একটা শূন্যতা এসে এই সিস্টেমের জায়গা নিচ্ছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আরেকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আরো এক পা এগিয়ে আভাস দিলেন, প্রেসিডেন্ট পুতিন এখন বাধ্য হবেন তার প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগু এবং চিফ অব স্টাফ জেনারেল ভ্যালেরি গেরাসিমভকে বরখাস্ত করতে। সম্ভবত আরো একটি সামরিক বিপর্যয়ের প্রতিক্রিয়ায় এটা ঘটতে পারে, বলছেন তিনি।
প্রিগোশিন এবং তার ওয়াগনার বিদ্রোহীদের একটি অন্যতম দাবি ছিল এ দুই ব্যক্তিকে বরখাস্ত করা।
“প্রিগোশিন যা চেয়েছিল তা সে পাবে”- পূর্বাভাস দিলেন কর্মকর্তাটি – “তার রাজনৈতিক জীবন শেষ হয়ে যায়নি। সে বেলারুসে নির্বাসনে থাকবে না।”
ইউক্রেনের পাল্টা যুদ্ধের ক্ষেত্রে পডোলিয়াক বললেন, ওয়াগনার বিদ্রোহ এ যুদ্ধে প্রভাব বিস্তার করার মতো যথেষ্ট সময় স্থায়ী হয়নি। এখন লড়াই চলছে ১৮০০ কিলোমিটার জুড়ে, যা ১৯৪৫ সালের পর কোনো যুদ্ধে হয়নি।
এ যুদ্ধের দিকে তাকালে একজন নির্মোহ পর্যবেক্ষকের কাছে স্পষ্ট হয়ে যাবে যে – ইউক্রেনকে এই পাল্টা অভিযানে অত্যন্ত কঠিন লড়াই করতে হচ্ছে। তাদের সৈন্য হতাহত হচ্ছে, সরঞ্জাম নষ্ট হচ্ছে যার মধ্যে নেটোর দেয়া সুরক্ষাব্যবস্থাও আছে।
পূর্বদিকে ইউক্রেনের কৌশলগত অগ্রগতি কতটা হয়েছে – তা জিজ্ঞেস করেছিলাম নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কর্মকর্তাটিকে। তিনি তার হাতের বুড়ো আঙুল আর তর্জনী দিয়ে এক ইঞ্চির মতো জায়গা দেখালেন – যার অর্থ, অগ্রগতি হচ্ছে সীমিত ও ধীরগতিতে।
তবে তিনি আশা প্রকাশ করলেন যে এ পরিস্থিতি আগামীতে পাল্টে যেতে পারে।
উর্ধতন ইউক্রেনীয়রা এখন চেষ্টা করছে তাদের “গ্রীষ্মকালীন অভিযান” নিয়ে যে প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল তা নিয়ন্ত্রণে রাখতে। তারা মনে করে কিছু পশ্চিমা মিত্র এবং মিডিয়ায় তাদের সমর্থকরা ইউক্রেনের সেনাবাহিনী ওনেটোর সরঞ্জামের ব্যাপারে বেশি উত্তেজিত হয়ে উঠেছিল।
ইউক্রেনের কিছু কর্মকর্তা স্বীকার করেন যে প্রেসিডেন্ট পুতিনের ক্ষমতা সবার চোখের সামনে ধসে পড়লে তা আসলেই কিছু বিপদ সৃষ্টি করতে পারে।
পুতিনের উত্তরসুরীরা হয়তো তখন ক্ষমতার লড়াইয়ে নেমে পড়বে – এমন একটি দেশে, যেখানে রয়েছে পারমাণবিক অস্ত্রের সবচেয়ে বড় মজুত। এ আশংকা পশ্চিমা নেতাদের বিনিদ্র রজনী ডেকে আনতে পারে।
আগামী মাসে লিথুয়ানিয়াতে নেটোর যে শীর্ষ বৈঠক হতে যাচ্ছে তাতে এ সম্ভাবনার বিষয়টি নিশ্চয়ই এজেন্ডার ওপর দিকেই থাকবে।
প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি এবং তার উপদেষ্টারা চাইছেন যে এ সম্মেলনে যেন ইউক্রেনের নেটো সদস্যপদের ব্যাপারে সুনিশ্চিত পথনির্দেশনা দেয়া হয়।
তারা মনে করেন, রাশিয়ায় অস্থিতিশীলতার সর্বোত্তম জবাব এটাই – মস্কোর সামনে একটা লৌহপ্রাচীর তুলে ধরা।
কিন্তু প্রেসিডেন্ট পুতিনের শাসন নিয়ে অনিশ্চয়তা, দেড় বছর ধরে চলমান যুদ্ধ আর ওয়াগনার নাটকের পর – নেটো দেশগুলোর দুর্ভাবনা বেড়ে যেতে পারে। লড়াইয়ের অবসান যুদ্ধক্ষেত্রে না হয়ে আলোচনার টেবিলে হোক এটাই হয়তো তারা বেশি চাইবে। সূত্র : বিবিসি
Leave a Reply