-রিজার্ভ থেকে ১১ মাসে ১৩ বিলিয়ন ডলার বিক্রি
-ব্যবসায় ব্যয়ের সাথে বাড়ছে উৎপাদন খরচ
ব্যাংকগুলোর চাহিদা অনুযায়ী ডলার সংস্থান করতে পারছে না। আর এ কারণে ব্যবসায়ী উদ্যোক্তাদের শিল্পের কাঁচামালসহ প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি করতে পারছে না। যেটুকু ডলার সংস্থান হচ্ছে তাই দিয়েই এলসি খোলা হচ্ছে। আর এতেই বেড়ে যাচ্ছে ডলারের দাম। শুধু বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসেবেই গত এক বছরে প্রতি ডলারের জন্য ব্যয় বেড়েছে সাড়ে ১৬ টাকা। গত বছরের ৭ জুন প্রতি ডলারের জন্য ব্যবসায়ীদের যেখানে ব্যয় করতে হয়েছিল ৯১ টাকা ৯৫ পয়সা, যেখানে চলতি বছরের ৭ জুনে তা বেড়ে হয়েছে ১০৮ টাকা ৪৫ পয়সা। শতকরা হিসেবে শুধু ডলারের বিপরীতে ব্যবসায়ীদের ব্যয় বেড়েছে প্রায় ১৮ শতাংশ। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডলারের মূল্যের এ তথ্য বাজারের অবস্থার সাথে একেবারে অমিল। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতির ফেডারেশন (এফবিসিসিআই) সভাপতি মো: জসিম উদ্দিন গত ৭ জুন এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ব্যাংকগুলো ইচ্ছেমতো ডলারের দাম নিচ্ছে। লুটের মালের মতো ব্যাংকগুলো যেভাবে পারছে সেভাবে ডলারের দাম নিচ্ছে। বর্তমানে এক ডলারের বিপরীতে ১১৪ থেকে ১১৫ টাকা পর্যন্ত দাম নেয়া হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ানোর পরেও নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস ও বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে না। এর ওপর ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় ব্যবসায়ীদের ব্যয় অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেছে। এ পরিস্থিতিতে তাদের টিকে থাকাই দায় হয়ে পড়েছে।
এ দিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, ব্যাংকগুলোর ডলার সঙ্কটের কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে প্রতি দিনই আসছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক শুধু সরকারি কেনাকাটার দায় মেটানোর জন্য বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে সরকারি ব্যাংকগুলোর কাছে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করছে। এরপরেও চলতি অর্থবছরের ১ জুলাই থেকে গত ৮ জুন পর্যন্ত প্রায় ১১ মাসে রিজার্ভ থেকে প্রায় ১৩ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে। রিজার্ভ ধরে রাখতে অন্য ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার বিক্রি করছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বলে দেয়া হয়েছে, নিজেরা ডলার সংস্থান করেই পণ্য আমদানির জন্য এলসি খুলতে হবে। এ কারণে পণ্য আমদানিতে ব্যয় অস্বাভাবিক হারে কমে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, গত বছরের এপ্রিলে পণ্য আমদানিতে ব্যয়ের প্রবৃদ্ধি হয়েছিল প্রায় ২৪ শতাংশ। সেখানে চলতি বছরের এপ্রিলে পণ্য আমদানির প্রবৃদ্ধি হয়েছে ঋণাত্মক সাড়ে ৩২ শতাংশ। অর্থাৎ আলোচ্য সময়ে পণ্য আমদানি কমেছে ৫৬ শতাংশ।
পণ্য আমদানি ব্যাপকভাবে কমে গেলেও রিজার্ভ পতন থামানো যাচ্ছে না। গত বছরের ৭ জুন বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল প্রায় ৪২ বিলিয়ন ডলার, চলতি বছরের ৭ জুন তা কমে নেমেছে ২৯ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ আলোচ্য সময়ে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমেছে ১২ বিলিয়ন ডলারের উপরে।
এ দিকে ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ পাওয়ার শর্ত হিসেবে শিল্পের গ্যাসের দাম এক লাফে প্রায় ২০০ শতাংশ বাড়ানো হয়েছিল। জ্বালানি তেলের দামও প্রায় ৫০ শতাংশ বাড়ানো হয়েছিল। ওই সময় সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হবে। এর পরেও তারা বর্ধিত মূল্য পরিশোধ করে আসছিলেন। কিন্তু শিল্পে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ও গ্যাস সঙ্কট তো দূরের কথা, ঘন ঘন লোডশেডিং ও অপ্রতুল গ্যাস সরবরাহের কারণে শিল্পকারখানার চাকা দিনের অর্ধেক ভাগই বন্ধ রাখতে হচ্ছে। পথে বসতে যাচ্ছে অনেক প্রতিষ্ঠিত শিল্প উদ্যোক্তারা। বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ আলী খোকন এ খাতের বিদ্যমান ভয়াবহ পরিস্থিতি তুলে ধরে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, গ্যাসের দাম অস্বাভাবিক বাড়ানোর পর বলা হয়েছিল নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হবে। কিন্তু এখন বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহ পরিস্থিতি এত শোচনীয় যে বর্তমানে তা অসহনীয় অবস্থানে চলে গেছে। বেশির ভাগ কারখানার উৎপাদন ৫০ শতাংশ নেমে গেছে। সবমিলে তাদের গত ১৫ মাসে প্রায় ৪৫ হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে।
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, কাক্সিক্ষত হারে রফতানি আয় বাড়ছে না। উপরন্তু মুনাফার হার কমিয়ে দিয়ে বেশি দামে রেমিট্যান্স সংগ্রহ করেও চাহিদা অনুযায়ী ডলার পাওয়া যাচ্ছে না। প্রায় প্রতি মাসেই রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, গত মে মাসে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমেছে প্রায় সাড়ে ১০ শতাংশ। একিিট ব্যাংকের তহবিল ব্যবস্থাপক গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, অনেক ব্যাংকই বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেন হয় এমন ব্যাংকগুলোর সংগঠন বাফেদার নির্দেশনা না মেনে বেশি দামে রেমিট্যান্স সংগ্রহ করছে। যেহেতু বেশি মূল্যে রেমিট্যান্স সংগ্রহ করছে এ কারণে আমদানিকারকদের কাছ থেকেও বেশি মূল্য আদায় করছে। এর ফলে পণ্যের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। পণ্যের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাওয়ার অর্থই হলো মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়া। পাশাপাশি বাংলাদেশী পণ্য বিদেশী পণ্যের সাথে মূল্যের প্রতিযোগিতায় হেরে যাচ্ছে। আর এর পাশাপাশি যেসব ব্যাংক নিয়মনীতি মেনে ডলার সংগ্রহ করছে তারাও বেকায়দায় পড়ে যাচ্ছে। কারণ তাদের রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যাওয়ায় ব্যবসায়ীদের কাছে দেয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী পণ্যের এলসি খুলতে পারছেন না। এতে ভালো ভালো গ্রাহক অন্য ব্যাংকে চলে যাচ্ছে।
এ দিকে টাকার বিপরীতে ডলারের দাম কমে যাওয়ায় খোদ সরকারি কেনাকাটিতেও ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। এমন তথ্য উঠে এসেছে খোদ অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়েছে, ডলারের বিপরীতে টাকার মান আর এক টাকা কমলে আগামী অর্থবছর শুধু বিদ্যুৎখাতেই সরকারের ভর্তুকি বাবদ ব্যয় ৪৭৩.৬ কোটি টাকা বেড়ে যাবে। শুধু ডলারের বিপরীতে টাকার মান ১০ শতাংশ কমলেই ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সরকারি ও সরকারি গ্যারান্টিযুক্ত ঋণের পরিমাণ ৩,৮০০ কোটি টাকা বেড়ে যাবে বলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রক্ষেপণে বলা হয়েছে।
এসব উদাহরণ তুলে ধরে একটি নথিতে টাকার অবমূল্যায়নকে বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য মধ্যমেয়াদে (আগামী ৩ বছর) সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হিসেবে চিহ্নিত করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। কারণ এটি মূল্যস্ফীতি উসকে দিয়ে শুধু জনগণকেই ভোগাচ্ছে না, টাকার অবমূল্যায়নে আরো আর্থিক চাপ বাড়ছে সরকারেরও।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের বিশ্লেষণে উঠে এসেছে, ক্রমে দুর্বল হয়ে চলা টাকার মান কিভাবে ভর্তুকিতে সরকারের সার্বিক ব্যয় বাড়াবে, ঋণ পরিশোধ ও প্রকল্প বাস্তবায়নে খরচের চাপ বাড়াবে। ‘মধ্যমেয়াদি সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি-বিবৃতি ২০২৩-২৪ হতে ২০২৫-২৬’ শিরোনামে প্রকাশিত বাজেট নথিটিতে অর্থ মন্ত্রণালয় বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য অন্যান্য কয়েকটি ঝুঁকিও চিহ্নিত করেছে।
Leave a Reply