অরভিন্দ কেজরিওয়ালের নেতৃত্বাধীন দিল্লি সরকারের প্রশাসনিক অধিকার কেড়ে নিতে কেন্দ্রীয় সরকার যে অধ্যাদেশ জারি করেছে, তা নিয়ে ভোটাভুটির সময়ে সংসদের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভায় তৃণমূল কংগ্রেস কেন্দ্রীয় সরকারের বিপক্ষে ভোট দেবে বলে মমতা ব্যানার্জি ঘোষণা করেছেন।
মঙ্গলবার (২৩ মে) কেজরিওয়ালের সাথে বৈঠকের পরে ব্যানার্জি এ ঘোষণা করেন।
আপাতত দিল্লি সরকারের অধিকার কেড়ে নেয়ার অধ্যাদেশ নিয়ে সংসদে ভোটাভুটির বিষয়টি গুরুত্ব পেলেও, দুই মুখ্যমন্ত্রীই বলছেন অধ্যাদেশ পাশ করানোর ওই ভোটে বিজেপির কেন্দ্রীয় সরকারকে পরাজিত করতে পারলে তা আগামী বছরের লোকসভা নির্বাচনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ মাইলেজ দেবে বিজেপিবিরোধী দলগুলিকে।
‘আমাদের সামনে একটা বড় সুযোগ’
অরভিন্দ কেজরিওয়ালের সাথে বৈঠকের পরে মমতা ব্যানার্জি এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘আমাদের দল সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে এই অধ্যাদেশের বিরুদ্ধেই আমরা ভোট দেব। আমি সব দলকে আপিল করব সবাই যদি একসাথে মিলতে পারি তাহলে রাজ্যসভায় আমরা বিজেপিকে হারাতে পারব, তাহলে অধ্যাদেশটিও নাকচ হয়ে যাবে। এটা আমাদের সামনে একটা বড় সুযোগ ২০২৪ সালের আগে।’
কেন্দ্রীয় সরকারের জারি করা অধ্যাদেশের বিরুদ্ধে অ-বিজেপি রাজ্য সরকারগুলির সমর্থন আদায়ের প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরভিন্দ কেজরিওয়াল।
দিল্লির সরকার তার অধীনস্থ কর্মী এবং অফিসারদের বদলি, শাস্তিমূলক ব্যবস্থা ইত্যাদি বিষয় নিজেদের অধীনে রাখতে চেয়ে মামলা করেছিল। সুপ্রিম কোর্ট দিল্লি সরকারের পক্ষেই রায় দিয়েছিল। কিন্তু গত শনিবার রাতে এক অধ্যাদেশ জারি করে কেন্দ্রীয় সরকার কর্মী ও অফিসারদের বদলি, শাস্তিদান সবকিছুই নিজেদের দখলে নিয়ে নিয়েছে।
যেহেতু এটি একটি অধ্যাদেশ, তাই সংসদের দুই কক্ষেই এটিকে বিল আকারে পেশ করে পাশ করাতে হবে। সংসদের নিম্নকক্ষ লোকসভায় বিজেপির সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকলেও উচ্চকক্ষ রাজ্যসভায় বিরোধীরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ।
কেজরিওয়াল আবেদন করছেন বিজেপিবিরোধী দলগুলি একজোট হয়ে যদি ওই অধ্যাদেশের বিরুদ্ধে ভোট দেয়, তাহলে সেটা রাজ্যসভায় পাশ করানো যাবে না এবং তাতে তার নিজের সরকারের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে।
২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনের ‘সেমি ফাইনাল’?
অরভিন্দ কেজরিওয়াল মঙ্গলবারের বৈঠকের পরে বলছিলেন, ‘২০১৫ সালে আমরা প্রথমবার ক্ষমতায় আসার পরেই আমাদের সরকারের কাছ থেকে একটি নোটিফিকেশন জারি করে সব অধিকার কেড়ে নিয়েছিল কেন্দ্রীয় সরকার। আমাদের নিজেদের কর্মী অফিসারদের বদলি, বা কেউ যদি ঠিক করে কাজ না করেন, তাদের শাস্তিদান কিছুই আমরা করতে পারি না। আট বছর ধরে আইনি লড়াই চালিয়ে আমরা সুপ্রিম কোর্টে জিতলাম। কিন্তু তার এক সপ্তাহের মধ্যেই অধ্যাদেশ জারি করা হল। সুপ্রিম কোর্ট যে আদেশ দিয়েছিল, তাকে সম্পূর্ণভাবে পাল্টিয়ে দেয়া হল এই অধ্যাদেশের মাধ্যমে।’
‘শনিবার রাতে ইচ্ছা করেই অধ্যাদেশ জারি করা হল, কারণ তার পরের দিন থেকেই সুপ্রিম কোর্টে গ্রীষ্মের ছুটি পড়ছে। কোর্ট চালু থাকলে আমরা গেলেই ওই অধ্যাদেশের ওপরে স্থগিতাদেশ পেয়ে যেতাম,’ বলছিলেন অরভিন্দ কেজরিওয়াল।
তিনি যোগ করেন, ‘যদি আমরা একজোট হয়ে এই অধ্যাদেশকে রাজ্যসভায় পরাস্ত করতে পারি, তাহলে তা ২০২৪-এর জন্য একটা সেমি-ফাইনাল হয়ে যাবে।’
বিজেপিবিরোধী জোটের প্রস্তুতি
মমতা ব্যানার্জি ও অরভিন্দ কেজরিওয়াল দু’জনেই মঙ্গলবার ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের প্রসঙ্গ ছুঁয়ে গেলেও বিস্তারিত মন্তব্য করেননি।
অন্যদিকে বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমার ২০২৪ সালের বিজেপিবিরোধী জোট গড়ার লক্ষ্যে সব বিরোধী দলের সাথে ব্যক্তিগত বৈঠক করেছেন। তিনি একদিকে যেমন মমতা ব্যানার্জি, তামিলনাডুর এমকে স্তালিন বা ঝাড়খণ্ডের হেমন্ত সরেন, উত্তর প্রদেশের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশ যাদবের সাথে আলোচনা চালাচ্ছেন, তেমনই নিয়মিত বৈঠক করছেন কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্বের সাথেও।
কর্ণাটকের নবনির্বাচিত কংগ্রেস সরকারের শপথ গ্রহণে যোগদান করার পরেই কুমার রবি এবং সোমবার দিল্লিতে গিয়ে কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্বের সাথেও কথা বলেছেন।
একাধিক আঞ্চলিক দল বিজেপিবিরোধী জোট গঠনের প্রচেষ্টার পাশে দাঁড়াচ্ছেন, কিন্তু সেই জোটের নেতৃত্ব কে দেবে, তা নিয়ে বিরোধী দলগুলির মধ্যে স্পষ্ট মতভেদ আছে।
তামিলনাডুর এমকে স্তালিন যেমন স্পষ্ট করে দিয়েছেন কংগ্রেস ছাড়া জাতীয় স্তরে বিরোধী জোট সম্ভব নয়। আবার তৃণমূল কংগ্রেস এবং অরভিন্দ কেজরিওয়ালের আম আদমি পার্টি বা আপ সরাসরি কংগ্রেসবিরোধী দল বলেই পরিচিত। কংগ্রেসের জনভিত্তি ভেঙ্গেই এই দুটি দল গড়ে উঠেছে। নির্বাচনগুলিতেও তৃণমূল কংগ্রেস এবং আপ দুটি দলই কংগ্রেসের বিরুদ্ধেই লড়াই করে।
একাধিকবার বিরোধী জোটের নেতৃত্বে কংগ্রেসকে রাখার বিরোধিতা করেছেন মমতা ব্যানার্জিও।
কংগ্রেসর প্রতি মনোভাব বদল মমতা ও কেজরিওয়ালের?
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন সেই অবস্থানের কিছুটা হলেও পরিবর্তন এসেছে কর্ণাটকে কংগ্রেসর বিপুল জয়ের পরে।
‘গোটা দেশে প্রায় ৪০০টি এমন আসন আছে, যেখানে একের বিরুদ্ধে এক লড়াই হলে বিজেপি সমস্যায় পড়তে পারে। যে মডেলটা কর্ণাটকে হয়েছে, সেই একই পদ্ধতিতে ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে লড়া যায় কী না, সেটা নিয়ে যথেষ্ট সিরিয়াসলি ভাবনাচিন্তা করছে বিরোধী দলগুলো,’ বলছিলেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক বিশ্বজিত ভট্টাচার্য।
তার কথায়, ‘কংগ্রেসের ব্যাপারে আপ এবং তৃণমূল কংগ্রেস দুই দলেরই কিছুটা অস্বস্তি আছে, কারণ দিল্লি বা পশ্চিমবঙ্গে যথাক্রমে আপ এবং তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধেই ভোটে লড়ে জাতীয় কংগ্রেস। কিন্তু কর্ণাটকের ভোটের ফল বেরনোর পর থেকে কংগ্রেস সম্বন্ধে মমতা ব্যানার্জির কথাবার্তা কিন্তু বদলিয়ে গেছে। আবার এমন খবরও শোনা যাচ্ছে, যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো ঘোষণা হয়নি, যে আপ হয়ত দিল্লিতেও কংগ্রেসের সাথে আসন সমঝোতা করতে অরাজি হবে না।’
এর আগে লোকসভা নির্বাচনের ঠিক আগ দিয়ে বিরোধী দলগুলো একটা প্রচেষ্টা চালাত বিজেপিবিরোধী ঐক্যের ছবি তুলে ধরতে। কিন্তু বাস্তবে তারা অনেক ক্ষেত্রেই নিজেদের মধ্যেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করত, যার ফল ঘরে তুলেছে বিজেপি।
সূত্র : বিবিসি
Leave a Reply