ভরা মৌসুমে অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে পেঁয়াজের দাম। গত মার্চ এপ্রিলে চাষিরা পেঁয়াজ ঘরে তুললেও এত তাড়াতাড়ি কেমন করে পেঁয়াজের দাম ৮০ টাকা কেজিতে পৌঁছল, এর কারণ খুঁজে পাচ্ছে না কৃষি মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্টরা। এ অবস্থায় ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানির দাবি উঠছে। তবে কৃষি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আমদানি করলে কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি। কৃষক যাতে পেঁয়াজ চাষে নিরুৎসাহিত না হন, সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হচ্ছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের কোয়ারেন্টিন উইংয়ের পরিচালক ড. রেজাউল করিম নয়া দিগন্তকে বলেন, সাধারণত সেপ্টেম্বর-অক্টোবরের দিকে পেঁয়াজের দাম বাড়ে। কিন্তু এবার পেঁয়াজ ঘরে তোলার মৌসুম থেকেই কেন ঊর্ধ্বগতি তা বোধগম্য নয়। এখন পর্যন্ত পেঁয়াজ আমদানির সিদ্ধান্ত আসেনি বলে জানান এই কৃষিবিদ।
এ দিকে বাজারে পেঁয়াজের দাম ৮০ টাকা পর্যন্ত পৌঁছায় পরিস্থিতি বিবেচনায় আমদানির জন্য কৃষি মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। চিঠিতে বলা হয়েছে, খুচরা বাজারে পেঁয়াজের মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। টিসিবির তথ্যানুযায়ী প্রতি কেজি পেঁয়াজের মূল্য এক মাস আগে ৩০ টাকা ছিল, যা গত সপ্তাহে ৫০ টাকা করে বিক্রি হয়েছে এবং বর্তমানে ৭০ থেকে ৮০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। পেঁয়াজের সরবরাহ বৃদ্ধি করে বাজার পরিস্থিতি স্থিতিশীল করার উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন। এ অবস্থায় পেঁয়াজের বাজার স্থিতিশীল করার স্বার্থে জরুরি ভিত্তিতে সীমিত পরিসরে পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি দেয়ার বিষয়টি বিবেচনা করার জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ জানানো হলো।
গতকাল রোববার রাজধানীতে একটি অনুষ্ঠানে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছেন, পেঁয়াজের বাজার নিয়ে যে অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে তাতে আমদানি ছাড়া কোনো উপায় নেই। সচিবালয়ে কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন, পেঁয়াজের দাম ৮০ টাকা কেজি কোনোক্রমেই গ্রহণযোগ্য নয়। তবে দাম কিছুটা কমতির দিকে থাকায় আরো ২-৩ দিন বাজার পরিস্থিতি দেখে পেঁয়াজ আমদানির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
রাজধানীর বাড্ডা আলাতুন্নেছা উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের বার্ষিক ক্রীড়া ও মেধা পুরস্কার এবং গুণীজন সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য শেষে বাণিজ্যমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমাদের দেশে পেঁয়াজ উৎপাদন পর্যাপ্ত হয়েছে। কিন্তু বেশি মুনাফা লাভের আশায় অনেকে পেঁয়াজ মজুদ রেখে সঙ্কট তৈরি করে বাজারকে অস্থিতিশীল করছে। ভোক্তাপর্যায়ে পেঁয়াজের দাম কয়েক দিনের ব্যবধানে বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমান বাজার বিবেচনায় আমরা পেঁয়াজ আমদানির জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে কৃষি মন্ত্রণালয়কে অবহিত করেছি। ইমপোর্ট পারমিট বা আইপি যেহেতু কৃষি মন্ত্রণালয় দিয়ে থাকে তাই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার জন্য বলা হয়েছে। বাজার পর্যবেক্ষণ করে তারা এ ব্যাপারে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেবে বলে আমাদের জানিয়েছে।
টিপু মুনশি আরে বলেন, দেশের কৃষকরা যাতে পেঁয়াজের ন্যায্য দাম পান সেজন্য মূলত ইমপোর্ট পারমিট বন্ধ রাখা হয়েছে। এখন যেহেতু ভোক্তাদের বাজারে পেঁয়াজ কিনতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাই আমদানি করা ছাড়া উপায় নেই। আমদানির পর বাজারে স্থিতিশীলতা আসবে বলে আশা করছি।
বাজার মনিটরিং করা হচ্ছে কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরসহ সংশ্লিষ্টদের দিয়ে বাজার মনিটরিং করা হচ্ছে। নির্ধারিত দামে বাজারে চিনি বিক্রয় করছে কি না তাও পর্যবেক্ষণে মনিটরিং করা হচ্ছে।
এ দিকে সচিবালয়ে নিজ দফতরে সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, কিছুদিন ধরে পেঁয়াজের দাম নিয়ে অস্থিরতা যাচ্ছে। হঠাৎ করে দাম বেড়ে আবার কিছুটা কমে যায়, আবার বাড়ে। দুই-তিন দিনের ব্যবধানে বাজার ওঠানামা করে। এটা কেন হবে, সব কিছুর ধারাবাহিকতা থাকে। গত ৪-৫ দিন আমরা আরো কাছ থেকে বাজার বোঝার চেষ্টা করেছি। পেঁয়াজের কেজি ৮০ টাকা এটা কোনোক্রমেই গ্রহণযোগ্য নয়, আমরা এটা মেনে নেই না।
কৃষিমন্ত্রী বলেন, মধ্যম আয়ের, সীমিত আয়ের সব মানুষেরই কষ্ট হচ্ছে। ৮০ টাকা কেজি তো পেঁয়াজ হতে পারে না। নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে… আমরা শেষ পর্যন্ত চাষির স্বার্থটা দেখতে চাচ্ছি। তিনি বলেন, আমরা উচ্চ পর্যায়ে, নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে আলোচনা করেছি। গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছি। ইনশা আল্লাহ দু-তিন দিনের মধ্যে আপনারা সিদ্ধান্ত পাবেন- যে আমরা বিদেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানি করব কি না। মন্ত্রী বলেন, গতকাল পেঁয়াজের দাম মণে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা কমেছে। যেহেতু কমার লক্ষণ আমরা আরো দু-এক দিন দেখবো।
ড. রাজ্জাক বলেন, আমরা মাঠ থেকে তথ্য পাচ্ছি যথেষ্ট পেঁয়াজ আছে। তাহলে দাম কেন কমছে না, এটা তো হওয়ার কথা নয়। দাম যদি সহনীয় অবস্থায় রাখা না যায় তাহলে আমাদের আমদানিতে যেতে হবে। তবে দাম কোনোক্রমেই ৮০ টাকা থাকবে না। আমরা চেষ্টা করছি, এ সিন্ডিকেট বা যারা এটা নিয়ন্ত্রণ করছে, তাদের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে নিয়ে আসা যায় কি না। ভারতে পেঁয়াজের দাম কম জানিয়ে আব্দুর রাজ্জাক বলেন, সেখান (ভারত) থেকে আমদানি করে আমাদের বাজারকে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আনতে হবে।
কৃষিমন্ত্রী বলেন, গত বছর আমাদের পেঁয়াজের উৎপাদন ভালো হয়েছিল, মজুদও ভালো ছিল। অনেক পেঁয়াজ পচে গিয়েছিল। এবার লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম জমিতে পেঁয়াজ চাষ হয়েছে, তাই উৎপাদন কিছুটা কম হয়েছে। গত বছরের চেয়ে এবার দুই লাখ টনের মতো পেঁয়াজের উৎপাদন কমেছে বলেও জানান কৃষিমন্ত্রী।
পেঁয়াজের দাম কত হওয়া উচিত বলে মনে করেন, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘দামটা ৪৫ টাকার বেশি হওয়া উচিত নয়। আমদানি করলে দাম আরো কমে যাবে। ভারতে প্রচুর পেঁয়াজ হয়েছে। ওদের উচ্চপর্যায় থেকে আমাদের বারবার অনুরোধ এসেছে আমদানির। চাষিরা আন্দোলন করছে, বাংলাদেশ পেঁয়াজ নেয় না। পেঁয়াজের দাম কমে যাবে।
কারসাজি করে পেঁয়াজের দাম বাড়ানো সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, ‘ভেতরে ভেতরে সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে’।
Leave a Reply