করোনাভাইরাস নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় বিপুল ভুল তথ্য ছড়িয়ে পড়েছে – স্বাস্থ্য উপদেশ থেকে শুরু করে বিভিন্ন দেশের সরকারের পরিকল্পনা পর্যন্ত অনেক কিছু নিয়েই বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়িয়েছে। একটি পোস্ট কীভাবে ভাইরাল হলো, এই গল্পটি সেই বিষয়ে।
পোস্টটি ছিল কিছু তথ্য এবং উপদেশ সংক্রান্ত। তার মধ্যে কিছু সত্য, কিছু আংশিক কার্যকর এবং কয়েকটি সম্ভবত ক্ষতিকর। ফেসবুক, হোয়্যাটসঅ্যাপ, টুইটার এবং অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়েছে এই পোস্ট।
৮৪ বছর বয়সী এক ব্রিটিশ পুরুষের ফেসবুক প্রোফাইল থেকে ঘানার একজন টেলিভিশন উপস্থাপকের ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্টে যাওয়ার আগে পোস্টটি ভারতের করোনাভাইরাস সংক্রান্ত ফোরাম, হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ, টুইটার অ্যাকাউন্টের মতো নানা সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম ঘুরে গেছে।
প্রথম দেখায় ঐ পোস্টের তথ্যগুলোকে সঠিকই মনে হয় কারণ তথ্যগুলো বেশ বিশ্বাসযোগ্য সূত্র থেকে উদ্ভূত বলে দাবি করা হয়।
যেভাবে ছড়িয়েছিল পোস্টটি
প্রথম পোস্ট
ওই পোস্টটির সবচেয়ে প্রথম যে ভার্সনটি আমরা খুঁজে বের করতে পারি সেটি একজন ফেসবুক ব্যবহারকারী ৭ ফেব্রুয়ারিতে পোস্ট করেছিলেন। ২ হাজার সদস্যের ‘হ্যাপি পিপল’ নামের এক ফেসবুক গ্রুপে কেউ একজন সেটি পোস্ট করেছিলেন।
পোস্টটিতে লেখা ছিল : “আমার সহপাঠীর আঙ্কেল মাস্টার্স ডিগ্রিধারী এবং শেনজেন হাসপাতালে কাজ করেন। তাকে উহানে সেখানকার নিউমোনিয়া ভাইরাস সম্পর্কে গবেষণা করতে পাঠানো হয়েছে। তিনি আমাকে ফোন করে এই তথ্যগুলো আমার বন্ধুদের জানিয়ে দিতে বললেন….”
এরপর যেই তথ্য এবং উপদেশগুলো দেয়া হয় সেগুলো হয় বিভ্রান্তিকর অথবা ভুল। যার মধ্যে একটি ছিল ‘আপনার যদি সর্দি থাকে তাহলে আপনার দেহে ভাইরাসটি নেই।’
তথ্য যাচাই করার সংস্থা ফুল ফ্যাক্ট এবং স্নোপস যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল (সিডিসি) এবং ল্যান্সেট জার্নালের মতো প্রতিষ্ঠিত স্বাস্থ্য বিষয়ক প্রতিষ্ঠানের বরাত দিয়ে জানায়, সর্দি করোনাভাইরাসের সাধারণ উপসর্গ না হলেও করোনাভাইরাস আক্রান্তদের সর্দি হওয়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে।
ঐ পোস্টে মানুষকে ‘বেশি করে গরম পানি খাওয়া’ এবং ‘পারতপক্ষে বরফ না খাওয়া’র পরামর্শ দেয়া হয়।
এখন পর্যন্ত কোনো প্রমাণ নেই যে এই ধরণের পরামর্শ মানলে ভাইরাস আক্রমণ করবে না বা ভাইরাস সংক্রমণ ভালো হয়ে যাবে।
এই পোস্টটি যিনি করেছিলেন তার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হয়েছিল, তবে তিনি উত্তর দেননি।
যেভাবে পোস্ট ছড়াল
বেশ কিছুদিন পর ভারতে গ্লেন নামক এক ব্যক্তি শেয়ার করার পর পোস্টটি জনপ্রিয়তা পাওয়া শুরু করে। ঐ ব্যক্তি পোস্টটি বিভিন্ন ফেসবুক গ্রুপে পোস্ট করেন, যার মধ্যে একটি ছিল ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের একটি গ্রুপ।
নতুন শেয়ার করা পোস্টটিতে পুরনো পোস্টের উপদেশ ও পরামর্শ ছাড়াও নতুন অনেক তথ্য দেয়া ছিল।
এই নতুন তথ্যগুলোর মধ্যে কিছু কিছু সঠিক তথ্যও ছিল। যেমন, সেখানে মানুষকে হাত ধোয়ার পরামর্শ দেয়া হয় যা ভাইরাস সংক্রমণ ঠেকাতে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
কিন্তু নতুন ভার্সনেও কিছু অযাচাইকৃত এবং বিভ্রান্তিকর তথ্য দেয়া ছিল।
যেমন, রোগটি কীভাবে বিস্তার লাভ করে সেসম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য দেয়া ছিল সেখানে। কিন্তু ডাক্তারদের মতে করোনাভাইরাসের উপসর্গ এবং তীব্রতা একেকজনের জন্য একেকরকম এবং এর বিস্তারের কোনো নির্দিষ্ট ধারা নেই।
পোস্ট যেভাবে ভাইরাল হলো
অনেক সপ্তাহ ধরে পোস্টটি অপেক্ষাকৃত ছোটখাটো গ্রুপ এবং পেইজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু ২৭ ফেব্রুয়ারিতে ৮৪ বছর বয়সী সাবেক আর্ট গ্যালারির মালিক পিটার এটিকে ভাইরাল করেন।
পিটারের পোস্টটিও গ্লেনের মতোই ছিল, তবে এটির মধ্যেও নতুন কিছু তথ্য জুড়ে দেয়া হয় – আগের মতো এবারেও ওই তথ্যগুলোর কয়েকটি ছিল ভুল বা বিভ্রান্তিকর।
পিটারের পোস্ট এত দ্রুত ভাইরাল হয় যে তা তথ্য যাচাই করার প্রতিষ্ঠানগুলোর নজরে পড়ে। ফুল ফ্যাক্ট এবং স্নোপস, দুটি প্রতিষ্ঠানই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, যুক্তরাষ্ট্রের সিডিসি, যুক্তরাজ্যের এনএইচএসের মত চিকিৎসা সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের সাথে যাচাই করে পোস্টের দাবিগুলোর ভুলগুলো তুলে ধরে।
যেমন ঐ পোস্টে একটি তথ্য ছিল যে ‘ভাইরাসটি সূর্যকে ঘৃণা করে।’ কিন্তু এখন পর্যন্ত এরকম কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি যে সূর্যের আলোতে এই ভাইরাস মারা যায় বা দুর্বল হয়ে যায়। অনেক উষ্ণ এবং তীব্র সূর্যালোক সমৃদ্ধ দেশেও করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগী শনাক্ত করা গেছে।
আগের পোস্টগুলোর মতো এই পোস্টেও ভুল এবং বিভ্রান্তিকর তথ্যের পাশাপাশি কিছু সঠিক তথ্যও ছিল।
বিবিসি যখন দক্ষিণ ইংল্যান্ডের বাসিন্দা পিটারের কাছে এই পোস্ট করার কারণ সম্পর্কে জানতে চান, তখন তিনি বলেন যে মানুষ যেন নিজেদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারে সেজন্য তিনি এই পোস্ট করেছেন।
পরিবর্তন হওয়া শুরু করল পোস্ট
পিটারের পোস্টটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়া শুরু করার পর সেটি দ্রুত পরিবর্তনও হতে শুরু করে। সেগুলোর অনেকগুলোতে আরো বেশি বিভ্রান্তিকর তথ্য যুক্ত হতে থাকে।
এ পর্যায়ে পোস্টের মূল উৎস কী, সেটিও পরিবর্তন হয়ে যায়। ফেসবুক, টুইটার ও হোয়্যাটসঅ্যাপে কয়েকটি গ্রুপে ‘মাস্টার্স ডিগ্রিধারী আঙ্কেল’-এর জায়গায় ‘স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের হসপিটাল বোর্ড’-এর বরাত দেয়া শুরু হতে থাকে।
এমনকি কিছু কিছু ভার্সনে ‘জাপানের চিকিৎসকরা’ অথবা ‘তাইওয়ানের বিশেষজ্ঞ’দের নামও উঠে আসতে থাকে।
স্ট্যানফোর্ডের নাম উল্লেখ করা পোস্টগুলো ফেসবুকে এত বিস্তৃতভাবে ডালপালা ছড়ায় যে, স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় বাধ্য হয় একটি বিবৃতি প্রকাশ করতে – যেখানে উল্লেখ করা হয় যে ঐ পোস্টে করা দাবিগুলোর সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো সম্পর্ক নেই।
বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হতে থাকে পোস্ট
বিভিন্ন সেলেব্রিটি ও মিডিয়া ব্যক্তিত্বের মাধ্যমে পোস্টটি ছড়াতে থাকে এ পর্যায়ে। অসংখ্য সাধারণ মানুষের মধ্যে ঘানার একজন টেলিভিশন উপস্থাপক ও অ্যামেরিকান তারকা অভিনেতাও পোস্টটি ছড়াতে ভূমিকা রাখে।
ফেসবুকে করোনাভাইরাসের আপডেট সম্পর্কিত হাজার হাজার গ্রুপের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে থাকে পোস্টটি।
এপ্রিল নামের একজন অ্যামেরিকান নারী এরকম একটি গ্রুপে পোস্ট করেছিলেন। তাকে যখন জিজ্ঞাসা করা হয় যাচাই না করে তিনি কেন এই ধরণের পোস্ট করলেন, তার উত্তরে তিন জানান, “আমি প্রতিদিন সারাদিন ধরে ফেসবুক ব্যবহার করি। আমি নিউজ দেখি না। আমি ভেবেছিলাম এই পোস্ট দেখে অনেক মানুষ উপকৃত হবে।”
এরকম কিছু গ্রুপের মাধ্যমে আরবি, আমহ্যারিক, ভিয়েতনামিজ, ফ্রেঞ্চ, স্প্যানিশ এবং ইতালিয়ান ভাষায় পোস্টটি অনূদিত হয়।
আগের পোস্টগুলোর মতোই এবারও পোস্টগুলোতে কিছু তথ্য ছিল সঠিক এবং কিছু তথ্য ছিল ভুল।
যেমন একটি তথ্য ছিল এমন যে, প্রতিদিন সকালে করোনাভাইরাসের ‘সেল্ফ চেক’ বা নিজেকে পরীক্ষা করা সম্ভব। বরা হয় ১০ সেকেন্ড শ্বাস বন্ধ করে রাখতে পারলে নিশ্চিত হওয়া যাবে যে ভাইরাস সংক্রমণ হয়নি। কিন্তু এই দাবিরও কোনো মেডিকেল ভিত্তি নেই।
কপিপাস্তা
‘মাস্টার্স ডিগ্রিধারী আঙ্কেল’ জাতীয় পোস্টের একটি নেতিবাচক নামও রয়েছে – এগুলোকে বলা হয় ‘কপিপাস্তা।’
অর্থাৎ, সোশ্যাল নেটওয়ার্কের শেয়ার বা রিটুইটের মত অপশন ব্যবহার না করে কেউ কপি এবং পেস্ট করেছেন।
এর ফলে প্রত্যেকটি পোস্টই দেখতে আসল পোস্টের মত মনে হয়। তখন মনে হয় পোস্টটি পরিচিত কারো দ্বারা লেখা হয়েছে।
এরকম ক্ষেত্রে এই পোস্ট কতজনের মধ্যে ছড়িয়েছে, অর্থাৎ কতজন পোস্টটি কপি এবং পেস্ট করেছে তা খুঁজে বের করে প্রায় দু:সাধ্য একটি কাজ হয়ে দাঁড়ায়।
ফেসবুক কী করছে?
যেসব পোস্টে ভুল এবং বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়ানো হয়েছে, সেগুলো সম্পর্কে ফেসবুকের একজন মুখপাত্র জানান: “এই ধরণের পোস্ট আমাদের নীতি বিরুদ্ধ এবং এগুলো সরিয়ে ফেলা হয়েছে।”
“করোনাভাইরাস সংক্রান্ত ভুল তথ্য সরিয়ে নিতে আমরা ক্রমাগত কাজ করে যাচ্ছি। ফেসবুক যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের সাথে যুক্ত হয়েছে এবং তাদের নির্দেশনা সম্বলিত পোস্ট নিউজ ফিড এবং মেসেজে পাঠানো হচ্ছে যারা করোনাভাইরাস সম্পর্কে জানতে চাচ্ছেন।”
ফেসবুক একই ধরণের কন্টেন্টে লেখা বার্তাও যাচাই করছে এখন।
ভাইরাস সংক্রান্ত ভুল এবং বিভ্রান্তিকর তথ্য যেন না ছড়ায় তা নিশ্চিত করতে ফেসবুক, মাইক্রোসফট, গুগল, লিঙ্কড ইন, রেডিট, টুইটার এবং ইউটিউব একসাথে কাজ করার অঙ্গীকার করেছে।
তথ্য যাচাইকারীদের মতে, এই ক্ষেত্রে যারা তথ্য ছড়ায় তাদেরও একট বড় ভূমিকা রয়েছে। তাদের মতে কোনো কিছু শেয়ার করার আগে চিন্তা করো উচিত।
ফুল ফ্যাক্টের ক্লেয়ার মিলনে বলেন, “শেয়ার করার আগে এক সেকেন্ড থামুন। খোঁজ নিন এবিষয়ে আরো তথ্য জানতে পারেন কিনা।”
“যাচাই করার চেষ্টা করুন এই তথ্য ঠিক নাকি আপনার শেয়ার করা পোস্টের মাধ্যমে আপনার বন্ধু ও পরিবারের সদস্যরা ভুল তথ্য জানতে পারেন।”
কোনোকিছু শেয়ার করার আগে যে তিনটি প্রশ্ন করবেন নিজেকে :
১. তথ্যের উৎস কী অসমর্থিত মনে হচ্ছে অথবা এমন কোনো ব্যক্তির কাছ থেকে আসছে বলে মনে করছেন যাকে আপনি খুঁজে বের করতে পারবেন না?
কোথা থেকে এই তথ্য শেয়ার হলো তার মূলে যাওয়ার চেষ্টা করুন। না পারলে এটি শেয়ার করা থেক বিরত থাকুন। আপনার বিশ্বস্ত কেউ এটি আপনাকে পাঠিয়েছে তার মানে এই নয় যে তারা তাদের পরিচিত কারো কাছ থেকে এই তথ্য পেয়েছে।
২. সব তথ্যই সত্যি মনে হয়?
যখন অনেক তথ্যের লম্বা একটি তালিকা থাকে তখন সেই তালিকার সব তথ্য বিশ্বাস করার প্রবণতা থাকে কারণ এর মধ্যে হয়তো একটি বা কিছু সঠিক তথ্য থাকে।
৩. কন্টেন্ট কী আপনাকে খুশি, রাগান্বিত বা আতঙ্কিত করে?
ভুল তথ্য ভাইরাল হয় কারন সেগুলো আমাদের অনুভূতি নিয়ে খেলা করে। এটি একটি ইঙ্গিত যে পোস্টের তথ্য বিভ্রান্তিকরও হতে পারে। এরকম সময় নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা, সতর্কতামূলক উপদেশ বা গণ বিজ্ঞপ্তির ওপর ভরসা করুন।
সূত্র : বিবিসি
Leave a Reply