পণ্য আমদানির জন্য আমদানিঋণপত্র (এলসি) খোলা হয়। এর বিপরীতে ব্যাংক বিদেশী ব্যাংকগুলোর গ্যারান্টি দিয়ে থাকে। রফতানিকারক পণ্য যথাসময়ে জাহাজীকরণ করল। নিয়ম অনুযায়ী আমদানিকারকের শর্ত অনুযায়ী পণ্যমূল্য ব্যাংকের মাধ্যমে পরিশোধ করতে হয়। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে গ্রাহক পরিশোধ করে না, বা যথাসময়ে দায় পরিশোধে কালক্ষেপন করে। এ ক্ষেত্রে ব্যাংককেই এ দায় বহন করতে হয়। পরে বাধ্য হয়ে ব্যাংক গ্রাহকের নামে ঋণ সৃষ্টি করে।
ব্যাংকগুলো এসব গ্যারান্টির হিসেব অব ব্যালেন্সসিটে সংরক্ষণ করে। এসব ঋণের বিপরীতে নিরাপত্তা ঝুঁকি মোকাবেলায় আগে মাত্র এক শতাংশ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হতো। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে গতকাল ব্যাংকিং খাতে এ ধরনের ঋণ ঝুঁকি কমাতে নতুন নির্দেশনা দিয়েছে। বলা হয়েছে, এ ধরনের ঋণের বিপরীতে ঝুঁকিভেদে ২ শতাংশ থেকে শতভাগ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হবে। ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক অব ব্যালেন্সসিটের বিপরীতে প্রভিশন সংরক্ষণের হার বাড়িয়ে দেয়ায় তারা চাপে পড়ে যাবে। কারণ, বাড়তি প্রভিশন সংরক্ষণ করতে ব্যাংকগুলোকে হিমশিম খেতে হবে। এতে আয়ের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
জানা গেছে, ঋণ ঝুঁকি কমাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। খেলাপি ঋণের ধরন অনুযায়ী ২০ শতাংশ থেকে শতভাগ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। এ ছাড়া সাধারণ ঋণের ক্ষেত্রেও একটি নির্ধারিত হারে প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয় ব্যাংকগুলোর আয় খাত থেকে অর্থ দিয়ে। যে ব্যাংকের যত বেশি প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়, ওই ব্যাংকের তত মুনাফা কমে যায়। আর মুনাফা কমে গেলে ব্যাংকগুলো সাধারণ শেয়ারহোল্ডারদের মাঝে লভ্যাংশও কম বিতরণ করতে পারে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, গত ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকিং খাতে ১১ হাজার কোটি টাকার প্রভিশন ঘাটতি হয়েছে। ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণের বিপরীতে ৮৪ হাজার ১৫৭ কোটি টাকার প্রভিশন সংরক্ষণের কথা ছিল। কিন্তু আয় কম হওয়ায় এ পরিমাণ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। আলোচ্য সময়ে ব্যাংকগুলো প্রভিশন সংরক্ষণ করতে পেরেছে ৭৩ হাজার ১৪৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ প্রভিশন ঘাটতি হয়েছে ১১ হাজার ৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারি ব্যাংকগুলোর ঘাটতি রয়েছে প্রায় সাড়ে ১০ হাজার কোটি টাকা। প্রভিশন ঘাটতির কারণে ও ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের বিপরীতে মূলধন সংরক্ষণ করতে না পারায় অনেক ব্যাংক এবার সাধারণ শেয়ার হোল্ডারদের মাঝে লভ্যাংশ বিতরণ করতে পারছে না।
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নানা সময়ে ঋণ আদায়ের ওপর নীতিমালা শিথিল করায় ঋণ আদায় কমে গেছে। এ ছাড়া ডলার সঙ্কটের কারণে সবধরনের পণ্যে বিশেষ করে বিলাসজাত পণ্যে এলসি খোলা একপ্রকার বন্ধই রয়েছে। এর ফলে সামগ্রিক আমদানি কমে গেছে। আমদানি কমায় এলসি কমিশনও কমে গেছে। আবার ঋণের সুদহার ৯ শতাংশের মধ্যেই রয়েছে। কিন্তু আমানত কমে যাওয়ায় আমানত সংগ্রহে তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয় বেড়ে গেছে। অনেক ব্যাংক কলমানি মার্কেট থেকে ধার করে চলছে। এর ফলে বেশ কিছু ব্যাংক চাপে পড়ে গেছে। এমনি পরিস্থিতিতে অব ব্যালেন্স সিটের ওপর প্রভিশন সংরক্ষণের হার বাড়িয়ে দেয়ায় ব্যাংকগুলোর বাড়তি প্রভিশন সংরক্ষণ করতে গিয়ে মুনাফা আরো কমে যাবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, গ্রাহককে এলসিসহ নানাভাবে গ্যারান্টি দিয়ে থাকে ব্যাংক। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে গ্রাহক এসব গ্যারান্টির বিপরীতে দায় যথাসময়ে পরিশোধ করে না। বা অনেক ক্ষেত্রে পরিশোধ করে না। এতে ব্যাংকগুলো বেকায়দায় পড়ে যায়। এমতাবস্থায় গ্রাহকের দায় ব্যাংকগুলোর ওপর এসে পড়ে। ব্যাংকগুলো বাধ্য হয়ে গ্রাহকের দায় পরিশোধ করে থাকে। পরে গ্রাহকের বিপরীতে ফোর্সড ঋণ সৃষ্টি করে। এসব দায়ের বিপরীতে আগে শুধু এক শতাংশ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হতো। এখন তা ঝুঁকিভিত্তিক করা হয়েছে। ঝুঁকিভেদে ব্যাংকগুলোকে শতভাগ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হবে। এতে ব্যাংকগুলোর ঝুঁকি অনেকটা কমে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
Leave a Reply