লাইলাতুল কদর বা শবেকদর বলা হয়, রমজানের এমন একটি মহিমান্বিত রজনীকে; যাকে মহান প্রভু হাজার মাসের চেয়ে ইবাদতের জন্য উত্তম বলে ঘোষণা করেছেন এবং এই সময়েই রাসূল সা:-এর প্রতি কুরআনের কারিম নাজিল করেছেন। সৃষ্টিকুলের মধ্যে মানবজাতিকে আল্লাহ তায়ালা সর্বশ্রেষ্ঠ ও মর্যাদাবান করে সৃষ্টি করেছেন। আর সব মানুষের মধ্যে মুহাম্মদ সা:-এর উম্মতদেরকে সবচেয়ে বেশি শ্রেষ্ঠত্ব দান করা হয়েছে এবং পূর্ববতী উম্মত থেকে হায়াত কম দেয়া হয়েছে। বর্ণিত আছে, একবার রাসূল সা: বনি ইসরাইলের জনৈক চারজন লোক সম্পর্কে আলোচনা করলেন যে, তারা দীর্ঘ হায়াত লাভ করে অধিককাল যাবত ইবাদত করেছেন। এই সময়ে তারা একটিও নাফরমানি করেননি। এই কথা শুনে সাহাবায়ে কেরাম অবাক ও বিস্মিত হয়ে আফসোস করতে লাগলেন এই বলে যে, তারা দীর্ঘ হায়াত পেয়েছেন ফলে বেশি ইবাদত করার সময় পেয়েছেন। তাদের আফসোসের পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ তায়ালা ‘সূরা কদর’ নাজিল করেন। (তাফসিরে নুরুল কুরআন) আর এই উম্মতদের বিশেষ কিছু নিয়ামত দান করা হয়েছে যার মধ্যে লাইলাতুল কদর অন্যতম।
পবিত্র মাহে রমজানের শেষ দশকেই রয়েছে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ রজনী তথা লাইলাতুল কদর। প্রকৃত মুমিনেরা মরিয়া হয়ে ওঠেন গুনাহ মাফের জন্য। এই রজনীতে চরম পাপিষ্ঠদেরও ক্ষমা করা হয়। এই সময়েও যেই ব্যক্তি তার গুনাহ ক্ষমা করাতে পারল না তার চেয়ে বড় হতভাগা আর কে আছে? কেননা রাসূল সা: বলেছেন, ‘যারা রমজান মাস পেয়েও নিজেকে পাপমুক্ত করতে পারল না, তারা ধ্বংসপ্রাপ্ত।’ আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআন মাজিদে ইরশাদ করেন- ‘নিশ্চয়ই আমি তা (কুরআন) এক মুবারক রজনীতে অবতীর্ণ করেছি, নিশ্চয়ই আমি সতর্ককারী।’ (সূরা আদ দুখান : ১-২) তাফসিরকারকদের মতে এখানে মুবারক রজনী বলতে লাইলাতুল কদরের রজনীকে উদ্দেশ্য করা হয়েছে।
সূরাতুল কদর নামে পবিত্র কুরআনে একটি সূরাও বিদ্যমান রয়েছে। এ ছাড়াও হাদিসেও এই রাতের ফজিলত সম্পর্কে অনেক বর্ণনা পাওয়া যায়, রাসূল সা: ইরশাদ করেন, ‘যদি কেউ খাঁটি নিয়তে ঈমানের সাথে সাওয়াব লাভের আশায় লাইলাতুল কদর কিয়ামুল লাইলে অতিবাহিত করে তবে তার পূর্ববর্তী সব গোনাহ ক্ষমা করে দেয়া হবে।’ (বুখারি) আর রমজান মাস এলেই রাসূল সা: বলতেন, ‘নিশ্চয়ই রমজান মাস তোমাদের কাছে উপস্থিত হয়েছে। এতে এমন বরকতপূর্ণ রাত আছে, যা হাজার মাসের চেয়েও উত্তম, যে একে সম্মান করল, সে যেন পুরো কল্যাণকেই সম্মান করল। আর যে এর কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হলো, সে যেন পুরো কল্যাণ থেকেই বঞ্চিত হলো।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ)
এই রজনীতে হজরত জিবরাইল আ: বিরাট একদল ফেরেশতা নিয়ে অবতরণ করেন এবং ইবাদতে থাকা সব নারী-পুরুষের জন্য দোয়া করতে থাকেন। (তাফসিরে মাজহারি) হজরত আনাস রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, ‘নিশ্চয়ই এ রজনীর সালাত, জাকাত ও সদাকাহ বা দান হাজার মাসের চেয়ে উত্তম।’
লাইলাতুল কদর শেষ দশকের কোন রজনী তা নির্দিষ্ট করে বলা যায় না, যদিও অনেক মুফাসসির ২৭ রমজানের রজনীকে লাইলাতুল কদর রজনী বলেছেন। তবে হাদিসের ভাষ্য অনুযায়ী, রমজানের শেষ দশকের রাত্রিতে লাইলাতুল কদর তালাশ করার কথা বলা হয়েছে। হজরত আবু সাঈদ খুদরি রা: বর্ণিত- তিনি বলেন, রাসূল সা: আমাদের উদ্দেশে ভাষণ দিলেন, অতঃপর তিনি বলেন, ‘আমাকে লাইলাতুল কদর দেখানো হয়েছিল, কিন্তু আমি তা ভুলে গিয়েছি/ভুলিয়ে দেয়া হয়েছে, তবে তোমরা তা রমজানের শেষ দশকের প্রত্যেক বিজোড় রাত্রিতে তালাশ করো।’ (বুখারি-মুসলিম)
লাইলাতুল কদরের রজনীতে করণীয় হলো প্রথমত; তওবা করা ও বেশি বেশি ইস্তিগফার করা। হাদিস শরিফে বর্ণিত হয়েছে- হজরত আয়েশা রা: বলেন, আমি রাসূল সা:-কে জিজ্ঞেস করলাম, ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমি যদি কেনোক্রমে অনুধাবন করি আজ লাইলাতুল কদরের রাত তাহলে সে রাতে আমি কী দোয়া করব? রাসূল সা: বলেন, তুমি এই দোয়া পাঠ করো, আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুব্বুন তুহিব্বুল আফওয়া ফাফু আন্নি- হে আল্লাহ তুমি পরম ক্ষমাশীল, তুমি ক্ষমা করতে ভালোবাস, কাজেই আমাকে ক্ষমা করে দাও।’ তাই গুনাহ মাফের এই সুযোগ আমাদের অবশ্যই কাজে লাগাতে হবে। এরপর কুরআন বেশি বেশি তিলাওয়াত করা। রাসূল সা: বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি সর্বোত্তম যে নিজে কুরআন শিখে ও অপরকে কুরআন শিক্ষা দেয়।’ (আল হাদিস) দরুদ পাঠ করা। হজরত আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত- রাসূল সা: ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি আমার প্রতি একবার দরুদ প্রেরণ করবে আল্লাহ তায়ালা তার ওপর ১০টি রহমত বর্ষণ করবেন।’ (সহিহ মুসলিম) অসহায় মানুষকে দান-সদকা করা এবং রবের সন্তুষ্টির নিমিত্তে বেশি নফল নামাজ আদায় করা, পাশাপাশি সেজদায় দোয়া করা।
এই রাত্রে যা করা উচিত নয় তা হলো- অধিক পরিমাণে খাদ্য গ্রহণ করা। কেননা, অতি খাদ্য শরীরে ক্লান্তি ও ঘুম নিয়ে আসে যার ফলে বেশি ইবাদত করা সম্ভব নয়। যথাসম্ভব এই রাত জাগ্রত থাকা ও ইবাদতে মশগুল থাকা। বিদয়াতমুক্ত আমল করা। কারণ বিদয়াত মৌলিক আমলকে নষ্ট করে দেয়। কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে রমজানের শেষ দশকের বিজোড় রাতে লাইলাতুল কদর তালাশ করে গুনাহ মাফের সুযোগকে কাজে লাগানোর পাশাপাশি দুনিয়াবি কল্যাণ ও আখিরাতের মুক্তির ওছিলা তৈরি করাই প্রকৃত মুমিন ও জ্ঞানীর পরিচয়।
লেখক :
শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।
Leave a Reply