বৈশাখের শুরুতেই সূর্য যেন আগুন ঝরাতে শুরু করেছে। নতুন বছরের তৃতীয় দিন গতকাল রবিবার ঢাকার তাপমাত্রা ছিল ৪০ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা গত ৫৮ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এবারের বৈশাখে ছয় দশকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি উত্তাপের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে রাজধানীসহ দেশবাসী। গতকাল দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় চুয়াডাঙ্গা ও যশোরে, ৪১ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গ্রীষ্মে এমনিতে উত্তাপ থাকলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তুলনামূলক বেশি গরম পড়ছে। এ জন্য প্রকৃতিতে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের পাশাপাশি সরকারেরও দায় দেখছেন পরিবেশবিদরা।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারেণ বিশ্বব্যাপী দাবদাহ বাড়ছে। বাংলাদেশও তার অংশ। এ জন্য বিশ্বের উন্নত রাষ্ট্রগুলো দূষণ থেকে বেড়িয়ে আসার চেষ্টা করছে। কিন্তু আমাদের দেশ উল্টো পথে হাটছে। তিনি বলেন, আমরা বারবার নবায়নযোগ্য জ্বালানির কথা বলে এলেও সরকার তাতে নজর দিচ্ছে না। অথচ দূষণ কমাতে সারা বিশ্বে এখন নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়ছে। এর মধ্যে ঢাকা শহর এখন কনক্রিটের শহরে পরিণত হয়েছে। যতটুকু জলাশয় থাকার কথা, সবুজ থাকার কথা, যতটুকু ফাঁকা রাখার কথা, তা নেই। আইন ও বিধি মানা হচ্ছে না। এ বিষয়ে সরকারের দৃষ্টি দিতে হবে।
পরিবেশমন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন বলেন, তাপমাত্রা প্রতিদিনই বাড়ছে। আমরাও তাপমাত্রা পর্যবেক্ষণ করছি। আগামী আরও কয়েক দিন এই তাপমাত্রা পর্যবেক্ষণ করব। এরপরও যদি তাপমাত্রা না কমে, তাহলে পরিবেশ মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা অধিদপ্তরের সঙ্গে বসে কিছু সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নেওয়ার চিন্তা করছি। তবে এখনই চূড়ান্ত কিছু বলা সম্ভব নয়। আমরা আপাতত পর্যবেক্ষণ করছি তাপমাত্রার অবস্থা।
আবহাওয়াবিদ তরিফুল নেওয়াজ কবির আমাদের সময়কে বলেন, এই সময়টা এমনিতে উষ্ণ থাকে। কারণ সূর্য এখন লম্বাভাবে কিরণ দিচ্ছে। পাশাপাশি দিনের সময়টা বড়, সূর্য বেশি সময় পাচ্ছে। সেই সঙ্গে বর্তমানে বাতাস দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে বইছে না। ভারতের মধ্যভাগ থেকে বইছে। এর আগের বছরগুলোতে দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে বাতাস বহমান থাকায় বঙ্গোপসাগর থেকে জলীয়বাষ্প মিলত। ফলে আর্দ্রতা বেশি থাকত। এ বছর দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে বাতাস বহমান না থাকায় আর্দ্রতার পরিমাণ কম। তাই তাপ বেশি অনুভূত হচ্ছে।
তরিফুল নেওয়াজ কবির আরও বলেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই সময়ে বৃষ্টি হতো। এ বছর হচ্ছে না। বৃষ্টি হলে কিন্তু গরম অনেকটা কমে আসত। তা ছাড়া একেক বছর গরম কম-বেশি হতে পারে। ২০১৪ সালে বেশি গরম পড়েছিল, এবার হয়তো তেমন বেশি পড়বে।
টানা দুই সপ্তাহ ধরে দেশজুড়ে তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। বৈশাখের শুরুতে বৃষ্টিহীন এই সময়ে তাপমাত্রা বেড়েই চলেছে ঢাকায়। গতকাল রবিবার যশোর ও চুয়াডাঙ্গায় দেশের সর্বোচ্চ ৪১ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। আর ঢাকায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৪০ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আগের দিন শনিবার ঢাকায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৪০.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল চুয়াডাঙ্গায় ৪২.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, রবিবার ঢাকা, ফরিদপুর, মানিকগঞ্জ, পাবনা, বাগেরহাট, যশোর, চুয়াডাঙ্গা ও কুষ্টিয়া জেলার ওপর দিয়ে তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। দেশের অন্যত্র বয়ে যাচ্ছে মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের তাপপ্রবাহ। আরও দুই-তিন দিন এমন তাপপ্রবাহ অব্যাহত থাকতে পারে। এর মধ্যে সারাদেশে দিনের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে এবং রাতের তাপমাত্রা সামান্য বাড়তে পারে।
আরও জানিয়েছে, বৃষ্টিপাত না থাকায় তাপমাত্রা বেড়েই চলছিল। এখন দুয়েকদিন তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে। এ সময় অসহনীয় গরমের মধ্যেই যেতে হবে। সপ্তাহের শেষে ঝড়বৃষ্টির আভাস রয়েছে।
এর আগে ১৯৬৫ সালে এপ্রিল মাসে ঢাকায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা উঠেছিল ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। আর ১৯৬০ সালে ঢাকায় পারদ উঠেছিল রেকর্ড ৪২ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। এর আগে ২০১৪ সালে চুয়াডাঙ্গায় ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছিল। তার আগে ১৯৯৫ সালে এবং ২০০২ সালে দেশে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা উঠেছিল ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ১৮ মে রাজশাহীতে রেকর্ড ৪৫ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ ড. আবুল কালাম মল্লিক জানান, আগামী তিন দিন পর হালকা ঝড়বৃষ্টির আভাস রয়েছে। ২০ এপ্রিল রংপুর ও রাজশাহী বিভাগ ছাড়া দেশের অন্যত্র হালকা বৃষ্টি হতে পারে। তিনি বলেন, তাপমাত্রা বাড়ায় বেশ গরম অনুভব হলেও বাতাসে আর্দ্রতা কম থাকায় ততটা অস্বস্তিকর হয়নি। আগামী কয়েক দিনে তাপমাত্রা ধীরে ধীরে কমতে পারে। এ সময় বাতাসে জলীয়বাষ্পও ধীরে ধীরে বাড়বে।
ড. আবুল কালাম মল্লিক বলেন, দুদিনের মধ্যে তাপমাত্রা কমার সঙ্গে সঙ্গে আর্দ্রতা বাড়তে থাকবে। তাতে শরীরে ঘাম হবে। তাপমাত্রা কমলেও গরমের অস্বস্তি বাড়বে বেশি। ১৯-২০ এপ্রিলের দিকে হালকা বৃষ্টির আভাস রয়েছে। আগামী সপ্তাহে বৃষ্টির প্রবণতা বাড়তে পারে।
থার্মোমিটারের পারদ যদি ৩৬ থেকে ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে ওঠে, আবহাওয়াবিদরা তাকে মৃদু তাপপ্রবাহ বলেন। উষ্ণতা বেড়ে ৩৮ থেকে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলে তাকে বলা হয় মাঝারি তাপপ্রবাহ। আর তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি ছাড়িয়ে গেলে তাকে তীব্র তাপপ্রবাহ ধরা হয়। দেশের অধিকাংশ এলাকায় এখন তীব্র তাপপ্রবাহ বিরাজ করছে।
আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, অস্থায়ীভাবে আংশিক মেঘলা আকাশসহ সারা দেশের আবহাওয়া শুষ্ক থাকতে পারে।
তাপপ্রবাহের বিষয়ে বলা হয়, খুলনা বিভাগসহ ঢাকা, ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, পাবনা, যশোর, চুয়াডাঙ্গা ও কুষ্টিয়া জেলাগুলোর ওপর দিয়ে তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে এবং দেশের অন্যত্র মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে এবং তা অব্যাহত থাকতে পারে। সারা দেশে দিনের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে এবং রাতের তাপমাত্রা সামান্য বৃদ্ধি পেতে পারে।
অপ্রত্যাশিত এই গরমে রোজার মধ্যে জনজীবনে নাভিশ্বাস উঠেছে। ঘরে থেকে বের হলেই তীব্র গরমে হাঁসফাঁস, ঘরের ভেতরও গুমোট অবস্থা। বাতাসে আর্দ্রতা কম থাকায় তাপের আঁচ আরও বেশি অনুভূত হচ্ছে।
Leave a Reply