বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে অনেকদিন ধরেই। সংস্থাটির সাধারণ সম্পাদককে বিশ্ব ফুটবলের সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক সংস্থা ফিফা নিষেধাজ্ঞা দেয়ার পর এই প্রথমবারের মতো সেসব অভিযোগের অনেকগুলোই সত্য প্রমাণিত হলো।
বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক আবু নাইম সোহাগকে দুই বছরের নিষেধাজ্ঞার সিদ্ধান্ত জানানোর পাশাপাশি কী কারণে তাকে নিষিদ্ধ করা হলো এবং কীভাবে বাফুফের আর্থিক দুর্নীতির বিষয়টি তারা বুঝতে পারল, সেই বিষয়েও তাদের ব্যাখ্যা প্রকাশ করে।
বাফুফে কীভাবে, কোন পদ্ধতিতে এবং কবে এই আর্থিক দুর্নীতি করেছে, সে সম্পর্কে ফিফা তাদের ওয়েবসাইটে বিস্তারিত প্রতিবদেন প্রকাশ করেছে।
ফিফা তাদের ওয়েবসাইটে এই বিষয়ে ৫১ পৃষ্ঠার একটি বিস্তারিত বিবরণ প্রকাশ করেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে সোহাগ জালিয়াতি ও মিথ্যা তথ্য প্রদান করেছেন। বাফুফের তহবিল আত্মসাত ও অপব্যবহার করেছেন। এছাড়াও তিনি তার সাধারণ দায়িত্ব ও নৈতিক দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে ফিফার কোড অব এথিক্স ভঙ্গ করেছেন।
যার মধ্যে ফিফার কাছ থেকে পাওয়া অর্থের খরচ দেখাতে গিয়ে একাধিক জালিয়াতির অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। আর এই আর্থিক জালিয়াতি সহজেই ফিফার তদন্ত কমিটির চোখে পড়েছে বাফুফে কয়েকটি ইংরেজি শব্দের বানান ভুল করায় ও ফিফার কাছে জমা দেয়া কাগজে ভূয়া নামে কিছু গায়েবি প্রতিষ্ঠানের উল্লেখ করায়।
ভুল বানান আর গায়েবি নামের প্রতিষ্ঠান
ফিফার তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০২০ সালের জুন মাসে বাফুফে প্রায় ২৬ লাখ টাকার খেলার সরঞ্জাম কেনার জন্য দরপত্র আহ্বান করে।
খেলাধুলার সরঞ্জাম বিক্রি করে এমন তিনটি প্রতিষ্ঠান তাদের দরপত্র জমা দেয়। একটি প্রতিষ্ঠানকে সরঞ্জাম সরবরাহের দায়িত্ব দেয়া হয় এবং সেই বছরের আগস্টে প্রতিষ্ঠানটিকে তাদের প্রাপ্য অর্থও দিয়ে দেয়া হয় বলে দাবি করে বাফুফে।
বাফুফে যদিও দাবি করেছে যে এই পুরো প্রক্রিয়ায় তিনটি প্রতিষ্ঠান দরপত্র জমা দিয়েছে। কিন্তু ফিফার তদন্তে উঠে আসে যে তিনটি দরপত্র মূলত ভিন্ন নাম ব্যবহার করে একই ধাঁচে লেখা এবং এর পেছনে একটিই প্রতিষ্ঠান রয়েছে।
আর প্রাথমিকভাবে তাদের এই সন্দেহ হয়। কারণ তিনটি দরপত্রেই ‘কোটেশন’ বানান একইভাবে ভুল করে লেখা হয়েছিল।
এরপর ২০১৯ সালে বিমানের টিকিট কেনার জন্য একটি ট্রাভেল এজেন্সিকে প্রায় ১৭ লাখ টাকা দেয় বাফুফে। সেবারো দরপত্র জমা দেয়া তিনটি ট্রাভেল এজেন্সির মধ্যে একটি এজেন্সিকে টিকিটের দায়িত্ব দেয়া হয় বলে দাবি করে বাফুফে।
মজার বিষয় হলো, এক্ষেত্রেও তিনটি দরপত্রেই ‘রাউট’ শব্দের বানান ভুলভাবে লেখা হয়েছিল। আর তিনটি দরপত্র একই ধাঁচে, একই তারিখে এবং একই ফন্টে লেখা হয়েছিল।
পরে ফিফার তদন্তে উঠে আসে যে এই দরপত্রগুলো মূলত জাল এবং শুধুমাত্র ফিফাকে জমা দেয়ার উদ্দেশ্যে এগুলো তৈরি করা হয়েছিল।
আর্থিক লেনদেনের এরকম বেশ কয়েকটি জাল কাগজের বিষয় উঠে আসে ফিফার প্রতিবেদনে। কয়েকটি ক্ষেত্রে হাতে লেখা কাগজের ভিত্তিতে টাকা লেনদেনের প্রমাণও পেয়েছে তারা। এমনকি চালানপত্রের জায়গায় সাদা কাগজের ভিত্তিতেও আর্থিক লেনদেন দেখানো হয়েছে বলে উঠে এসেছে ফিফার তদন্তে।
এগুলো ছাড়া ফিফার দেয়া অর্থ দিয়ে নারীদের পোশাকের দোকান থেকে ফুটবল কেনার তথ্য দেয়া, জনশক্তি রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানকে ট্রাভেল এজেন্সি হিসেবে দেখানো, বছরের পর বছর ভুয়া নামে একের পর এক প্রতিষ্ঠান তৈরি করে আর্থিক লেনদেনের অনিয়ম ঢাকার চেষ্টা করার মতো চেষ্টার কাজের প্রমাণ উঠে এসেছে ফিফার তদন্ত প্রতিবেদনে।
ফিফার কাছ থেকে পাওয়া টাকা নিয়ে যেসব দুর্নীতি
ফিফার কাছ থেকে পাওয়া ফরোয়ার্ড ফান্ডের ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে তিনটি অনিয়মের বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে ফিফার তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে।
সেগুলো হলো ফিফার নির্ধারিত অ্যাকাউন্ট থেকে নগদ টাকা উঠানো, ফিফার সাথে জড়িত প্রকল্পে অন্য অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা দেয়া এবং ফিফার কাজ ছাড়াও ফিফার ফান্ডের অর্থ ব্যবহার করা।
ফিফা তাদের প্রতিবেদনে বাফুফের অর্থনৈতিক লেনদেনের অনিয়মের বেশ কিছু উদাহরণও তুলে ধরেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ফিফা ফরওয়ার্ড প্রোগ্রামের অর্থ নির্দিষ্ট ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে দেয়ার কথা থাকলেও বাফুফে বিভিন্ন সময়ে ফিফার প্রোগ্রামের কাজে নিজেদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করেছে।
উদাহরণ হিসেব বলা হয়েছে ২০১৬ সালে ফিফা ফরোয়ার্ড ফান্ড হিসেবে সাত লাখ ডলারের বেশি অর্থ পায় বাফুফে। কিন্তু এরমধ্যে নিয়ম মেনে খরচ করা হয় শুধু ৯০ হাজার ডলার। এছাড়া ওই বছর নারী ফুটবলারদের বেতন ও বিদেশ সফর-সংক্রান্ত এক লাখ ডলারের বেশি অর্থের কোনো নথি ছিল না।
ফিফার কাছ থেকে পাওয়া অর্থ থেকে বাংলাদেশের ক্লাবগুলোকে প্রায় সোয়া এক লাখ ডলার অনুদান দেয় বাফুফে, যে বিষয়ে ফিফাকে জানানো হয়নি। এই লেনদেন-সংক্রান্ত কোনো নথি তো বাফুফের কাছে ছিলই না, বরং এর মধ্যে প্রায় ৫৪ হাজার ডলার দেয়া হয় নগদ অর্থ, যা ফিফার নিয়ম বহির্ভূত।
এছাড়া ২০১৭-২০২০ সময়কালে ফিফার নির্ধারিত ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে কোনো ব্যাখ্যা ছাড়া বড় অঙ্কের নগদ অর্থ উত্তোলন করেছে বাফুফে।
তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী বাফুফের দেখানো হিসেবের সাথে মোট হওয়া আর্থিক লেনদেনের গড়মিল প্রায় ছয় লাখ ডলারের। বর্তমান বাজারের হিসেবে যা ছয় কোটি টাকারো বেশি।
আর্থিক লেনদেন-সংক্রান্ত অনিয়মের বিষয়ে বাফুফে সাধারণ সম্পাদক আবু নাইম সোহাগের ব্যাখ্যাও সংযুক্ত করা হয়েছে ফিফার তদন্ত প্রতিবেদনে।
এই বিষয়ে সোহাগের বক্তব্য ছিল, অনেক সময় আমরা আমাদের স্পন্সরদের কাছ থেকে সময়মত অর্থ না পেলেও আমাদের সময়মত টুর্নামেন্ট আয়োজন করতে হত। সেরকম ক্ষেত্রে আমরা বাধ্য হয়েই ফিফার অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা নিয়েছি। এছাড়া স্পন্সরদের কাছ থেকে সবসময় পুরো অর্থও পেতাম না। তখন আমরা অন্য অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা নিয়ে ফিফার বাজেটের হিসেবেই খরচ করেছি। অর্থাৎ, আমরা মূলত ফিফার অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা ধার নিয়েছি।
বাংলাদেশে ফিফা কীভাবে তদন্ত পরিচালনা করল?
ফিফার তদন্ত প্রতিবেদনে বাফুফের অনিয়মের প্রমাণসহ বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেখে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে যে বাংলাদেশে কীভাবে এরকম পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত করতে পারল ফিফা।
এরকম ক্ষেত্রে ফিফা সাধারণত প্রাথমিক তদন্তের জন্য তৃতীয় পক্ষের একটি সংস্থা নিয়োগ দেয় বলে জানান দেশ রূপান্তরের সিনিয়র ক্রীড়া সাংবাদিক ও বাংলাদেশ ক্রীড়া লেখক সংস্থার সাবেক সাধারণ সম্পাদক সুদীপ্ত আনন্দ।
তিনি বলেন, ‘কোনো দেশের ফেডারেশনের বিরুদ্ধে ক্রমাগত অভিযোগ এলে ফিফা ওই দেশে অন্য একটি প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ দেয় প্রাথমিক তদন্তের জন্য। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে। এরকম ক্ষেত্রে ওই প্রতিষ্ঠান অত্যন্ত গোপনভাবে কাজ করে এবং সংস্থার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের বিরুদ্ধে প্রমাণ সংগ্রহ করে। ফিফার নিয়ম অনুযায়ী, এই কাজে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানকে সব ধরণের সহায়তা দিতে বাধ্য থাকে অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠান।’
বাংলাদেশে বাফুফের বিরুদ্ধে ওঠা বেশকিছু অভিযোগের বিরুদ্ধে প্রাথমিক তদন্ত ও প্রমাণাদি সংগ্রহের দায়িত্ব ছিল ফিফার নিয়োগ দেয়া ওই প্রতিষ্ঠানের। পরবর্তীতে প্রমাণ সংগ্রহ করে ফিফার মূল তদন্ত কমিটির কাছে পাঠানোর পর তারা আবু নাইম সোহাগকে এই বিষয়ে আলোচনা করার জন্য তলব করে বলে জানান ক্রীড়া সাংবাদিক সুদীপ্ত আনন্দ।
সূত্র : বিবিসি
Leave a Reply