সেবাদানকারী সরকারি সংস্থার দায়িত্বে অবহেলা এবং জবাবদিহিতার অভাবে খেসারত দিচ্ছেন রাজধানীবাসী। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) নিয়মিত নজরদারি না থাকায় ভবন নির্মাণ হচ্ছে যেনতেনভাবে। ভবন মালিকরা আইনের তোয়াক্কা না করেই বেজমেন্ট ব্যবহারের শর্ত ভাঙছেন। তিতাস গ্যাস কোম্পানিও দায় এড়াতে পারে না বলে মনে করছেন নগর পরিকল্পনাবিদরা। যেখানে-সেখানে গ্যাসের সংযোগ ঠেকাতে তিতাসের চরম গাফিলতি রয়েছে বলে মনে করছেন তারা।
রাজউক ও তিতাসের বাইরে রাজধানীতে সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে আছে সিটি করপোরেশন। নাগরিক সেবায় তাদের সম্পৃক্ততা সবচেয়ে বেশি। অথচ রাজধানীতে এই মুহূর্তে কতটি ভবন রয়েছে; কতটি ভবন ঝুঁকিপূর্ণ- এ ধরনের কোনো তথ্য দুই সিটি করপোরেশনের কারও কাছেই নেই। তারা নতুন করে ভবন জরিপ শুরু করেছে।
বিদ্যুৎতের অবৈধ সংযোগ কতগুলো রয়েছে, তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই সংস্থাটির হাতে। বাসাবাড়ি ছাড়াও রাস্তার পাশে হাজার হাজার টং দোকান অবৈধ সংযোগ নিয়ে ব্যবসা করছে। অথচ ডিপিডিসি কখনই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারেনি।
অনেকেই মনে করেন, রাজধানী ঢাকার বিস্ফোরণ ও অগ্নিকা-ের ঘটনার দায় ফায়ার সার্ভিসও এড়াতে পারে না। যখন কোনো একটি ভবনে বিস্ফোরণ বা অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটে তখন সবার আগে খুঁজে বের করা হয় অবৈধ গ্যাসের লাইন বা বিদ্যুৎতের লাইন রয়েছে কিনা। ভবনটি রাজউকের অনুমোদনের বাইরে করেছে কিনা; কিন্তু চোখের সামনে এতো বড় বড় অট্টালিকা মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে, তখন সেবা সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে কোনো বাধা দেওয়া হচ্ছে না। আর এই বাধা না দেওয়ার পেছনে বড় কারণ সেবা সংস্থাগুলোর দায়িত্বরত কর্মকর্তাদের দুর্নীতি। তারা নিজেদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করছেন না বলেই এতো দুর্ঘটনা ঘটছে বলে অভিযোগ অনেক নগর পরিকল্পনাবিদের।
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) চেয়ারম্যান আনিছুর রহমান মিঞা আমাদের সময়কে বলেন, ‘এককভাবে শুধু রাজউক বা কোনো সংস্থাকে দায়ী করলে চলবে না। যিনি ভবনটি ব্যবহার করছেন, তারও কিছু দায় থাকে। নাগরিকদের আইন মানার সদিচ্ছা থাকতে হবে। আগে যা-ই ঘটুক, বর্তমানে নতুন ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে রাজউক জিরো টলারেন্স নীতিতে রয়েছে। আগে শুধু আর্কিটেকচারাল নকশা জমা দিলেই অনুমোদন মিলত। এখন অফিস সার্কুলার জারি করা হয়েছে। আর্কিটেকচারাল, স্ট্রাকচারাল নকশা ও ইলেকট্রিক্যাল নকশা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। শুধু জমা দিলেই হবে না, আমাদের কর্মকর্তারা পরিদর্শন করে দেখে সনদ জমা দিলেই কেবল ভবন নির্মাণের অনুমোদন মিলবে।’
বেজমেন্টের অবৈধ ব্যবহার বা অনুমোদনহীন ভবনের দায় কার- এমন প্রশ্নের জবাবে রাজউক চেয়ারম্যান বলেন, ‘বেজমেন্টের অবৈধ ব্যবহার যে বেআইনি, সেটাই তো কেউ মানতো না। এখন তো অভিযান চালানো হচ্ছে। আমাদের লোকবলের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তবে আমরা আগের চেয়ে কঠোর হচ্ছি।’
স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ আমাদের সময়কে বলেন, নির্দিষ্ট একটি সেবা সংস্থাকে দায়ী করা ঠিক হবে না; দায় সবারই আছে। যাদের ব্যর্থতায় দুর্ঘটনা, তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনা জরুরি। জবাবদিহিতা না থাকায় নিয়মের ব্যতয় ঘটে।’
তোফায়েল আহমেদ মনে করেন, ‘সিটি গভার্নেন্স ব্যবস্থাতেই পরিবর্তন দরকার। সব সেবা সংস্থাই অর্থের বিনিময়ে সেবা দেয়; কিন্তু সব সেবা কি যথাযথ ভাবে পাচ্ছেন সেবাগ্রহীতারা? বছরজুড়ে কার্যকর নজরদারি ব্যবস্থা নেই বলেই নিয়ম মানার সংস্কৃতি ভুলে গেছে নগরবাসী।’
রাজধানীতে দুর্ঘটনার পেছনে সেবা সংস্থাগুলোর ব্যর্থতা আছে বলে মনে করেন ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান। তিনি বলেন, ‘সেবা সংস্থাগুলো তাদের দায়িত্ব ঠিকঠাক পালন করলে এত দুর্ঘটনা ঘটত না। রাজউক এখন বেজমেন্ট জরিপ করছে। বেজমেন্টের অবৈধ ব্যবহার করার সুযোগ কারা দিয়েছে? এটি দেখার দায়িত্ব রাজউকের। তাদের কর্মকর্তারা গাফিলতি করেছেন বলেই ভবনমালিকরা আইনের তোয়াক্কা করেনি।’
শাহজাহান মোল্লা
Leave a Reply