চলতি বছরের প্রথম মাসে বিশ্বের বড় বড় কোম্পানিগুলো একের পর এক কর্মী ছাঁটাইয়ের ঘোষণা দিয়েছে। মিডিয়া থেকে শুরু করে পণ্য উৎপাদনের কারখানা পর্যন্ত সবাই কর্মী ছাঁটাইয়ের জন্য সংবাদের শিরোনাম হয়েছে। তবে সবচেয়ে বেশি কর্মী ছাঁটাইয়ের ঘোষণা এসেছে টেক জায়ান্টদের কাছ থেকে। কর্মী ছাঁটাইয়ের ঘটনা ২০২২ সাল থেকে শুরু হয়ে ২০২৩ সালেও চলছে এবং বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে, আগামী আরো এক থেকে দেড় বছর এই ধারা অব্যাহত থাকতে পারে।
কোভিড-১৯ মহামারির মধ্যে বিভিন্ন শিল্পখাত সুবিধা করতে না পারলেও, ভিন্ন ছিল প্রযুক্তি খাত। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তারা ভালো মুনাফাও করেছে। আর বর্তমানে যখন সব কিছু স্বাভাবিক হতে চলেছে তখন কেন কোম্পানিগুলো বিশ্বব্যাপী কর্মী ছাঁটাইয়ের সিদ্ধান্ত নিচ্ছে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
বিভিন্ন কোম্পানি কর্মী ছাঁটাইয়ের জন্য আলাদা আলাদা কারণ দেখালেও যেসব কারণ সামনে আসছে তা হলো ধীর প্রবৃদ্ধি, মুদ্রাস্ফীতি রুখতে উচ্চমাত্রার সুদের হার এবং আগামী বছরে সম্ভাব্য একটি মন্দার আশঙ্কা।
ব্লুমবার্গের এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, মহামারির সময়ে মানুষের মধ্যে প্রযুক্তির যে বিশেষ চাহিদা তৈরি হয়েছিল তা স্থায়ী হবে মনে করে যারা ব্যবসা বাড়িয়েছিল, তারাই মূলত এখন কর্মী ছাঁটাইয়ের দিকে ঝুঁকছে।
কারা কর্মী ছাঁটাই করছে?
ফোর্বসের এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে বর্তমানে যেসব প্রতিষ্ঠান কর্মী ছাঁটাই করছে, তার চেয়ে যারা ছাঁটাই করছে না তাদের তালিকা ছোট। কর্মী ছাঁটাইয়ে যারা প্রথম সারিতে রয়েছে উবার, এয়ারবিএনবি, জিলো, কয়েনবেইজ, নেটফ্লিক্স, স্পটিফাই, পেলোটন, শপিফাই, স্ট্রাইপ এবং রবিনহুড।
চলতি মাসের শুরুর দিকে গুগল জানিয়েছে, তারা প্রায় ১২ হাজার কর্মী ছাঁটাই করবে, যা কোম্পানির মোট কর্মী সংখ্যার প্রায় ৬ শতাংশ।
মাইক্রোসফট প্রায় ১০ হাজার কর্মী ছাঁটাই করছে। সারা বিশ্বে এই কোম্পানিটির দু’লাখ ২০ হাজারের বেশি কর্মী রয়েছে। যাদের মধ্যে এক লাখ ২২ হাজার রয়েছে শুধু যুক্তরাষ্ট্রে।
আমাজন তাদের এক শতাংশ কর্মী ছাঁটাইয়ের ঘোষণা দিয়েছে। ওই হিসেবে প্রায় ১৮ হাজার কর্মী ছাঁটাই করতে যাচ্ছে তারা। পুরো বিশ্বে প্রায় ১৫ লাখ কর্মী রয়েছে কোম্পানিটির। আমাজনের ইতিহাসে এটাই সবচেয়ে বড় কর্মী ছাঁটাইয়ের ঘোষণা।
মিউজিক স্ট্রিমিং জায়ান্ট স্পটিফাই জানিয়েছে, তারা তাদের মোট কর্মীর ৬ শতাংশ বা ছয় শ’ কর্মী ছাঁটাই করবে।
২০২০ সাল থেকে প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর কর্মী ছাঁটাই নিয়ে কাজ করছে এমন একটি ওয়েবসাইট লেঅফস ডট এফওয়াইআই বলছে, চলতি বছরেই ২৯৭টি প্রযুক্তি কোম্পানি মিলে প্রায় ৯৫ হাজার কর্মী ছাঁটাই করেছে। এটা চলতে থাকলে চলতি বছরের শেষ দিকে এই শিল্পে কর্মী ছাঁটাইয়ের সংখ্যা দাঁড়াবে নয় লাখে। ২০২২ সালের তুলনায় এটি প্রায় ছয় গুণ বেশি। ওয়েবসাইটির হিসাবে ২০২২ সালে টেক কোম্পানিগুলো প্রায় দেড় লাখ কর্মী ছাঁটাই করেছিল।
গত বছর নভেম্বরে ফেসবুকের প্যারেন্ট কোম্পানি মেটা ১১ হাজার কর্মী ছাঁটাই করেছে। গুগলের প্যারেন্ট কোম্পানি আলফাবেট ছাঁটাই করেছে ১২ হাজার কর্মী। এছাড়া মার্কিন প্রযুক্তি কোম্পানি কয়েনবেইজ, ফ্লেক্সপোর্ট ও সেলসফোর্স বলেছে যে তারাও ১০ শতাংশ বা আরো বেশি সংখ্যক কর্মী ছাঁটাই করবে।
চিপ তৈরির কোম্পানি ইনটেল কর্মী ছাঁটাই করেছে এবং তারা নতুন প্রকল্পে খরচ কমিয়ে দিয়েছে। তারা প্রায় তিন বিলিয়ন ডলার খরচ কমাতে চাইছে। ২০২৫ সাল নাগাদ ১০ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত খরচ কমানোর লক্ষ্য রয়েছে তাদের।
বাংলাদেশে শীর্ষস্থানীয় ই-কমার্স প্ল্যাটফরম দারাজ বাংলাদেশ কর্মী ছাঁটাইয়ের ঘোষণা দিয়েছে। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের প্রতিবেদন বলছে যে, এই প্রতিষ্ঠানটির ৫০ জন পূর্ণকালীন কর্মী ইতোমধ্যে ছাঁটাইয়ের চিঠি পাওয়ার কথা জানিয়েছে। দারাজ বাংলাদেশের মূল প্রতিষ্ঠান দারাজ গ্রুপ তাদের ১১ শতাংশ কর্মী ছাঁটাইয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
দারাজ গ্রুপের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বিয়ার্কে মিকেলসেন কর্মীদের উদ্দেশে পাঠানো চিঠিতে জানিয়েছে যে ইউরোপে যুদ্ধ, সরবরাহে ব্যাপক সমস্যা ও মূল্যস্ফীতির কারণে গত এক বছরে বাজারের অবস্থা কঠিন হয়ে পড়েছে। যার কারণে কর্মী ছাঁটাইয়ের সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে।
কর্মী ছাঁটাইয়ের পেছনে কারণ কী?
বৃহস্পতিবার এনটারটেইনমেন্ট জায়ান্ট ডিজনি বলেছে যে প্রায় সাত হাজার কর্মী ছাঁটাই করতে যাচ্ছে তারা, যা বিশ্বব্যাপী প্রতিষ্ঠানটির মোট কর্মীর সাড়ে তিন শতাংশের বেশি। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান বব ইগার বলেছেন, সাড়ে পাঁচ বিলিয়ন ডলার ব্যয় কমানো ও ডিজনি প্লাসকে লাভজনক করার পরিকল্পনার অংশ হিসেবে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি।
বব ইগার মনে করেন, এই সিদ্ধান্ত তাদেরকে ভবিষ্যতে যেকোনো বাধা এবং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় তাদের ভালো অবস্থানে রাখবে।
একটু ভিন্ন মত দিয়েছেন স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির গ্র্যাজুয়েট স্কুল অব বিজনেসের অধ্যাপক জেফ্রি ফেফার। তিনি বিশ্বের বিভিন্ন কোম্পানিগুলোর কর্মী নিয়োগ ও ছাঁটাই নিয়ে গবেষণা করেছেন। তার মতে, বর্তমানে প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো যে কর্মী ছাঁটাই করছে তার পেছনে ‘আচরণ অনুকরণ’ যাকে তিনি ’সোশ্যাল কনটাজিওন’ বলে উল্লেখ করেছেন, এটি একটি বড় ভূমিকা পালন করছে।
তিনি বলেন, ‘কোনো কিছু না ভেবেই অন্যরা করছে বলে তাকেও করতে হচ্ছে’ কোম্পানিগুলোর মধ্যে এমন মনোভাবের কারণে কর্মী ছাঁটাই দেখা যাচ্ছে। কোম্পানিগুলোর এমন সিদ্ধান্তের পেছনে তেমন কোনো প্রমাণিত ভিত্তি থাকে না বলেও মনে করেন তিনি।
উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, মেটা প্রচুর আয় করছে। তাদের অনেক অর্থও আছে। তারপরও তারা কর্মী ছাঁটাই করছে, কারণ অন্য সব কোম্পানিও তাই করছে।
ফোর্বসের প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, বর্তমানে যে কর্মী ছাঁটাই করা হচ্ছে তা আসলে কোম্পানিগুলোর অতীতে একটি ভুলের ফল। মহামারির সময় ঘরে থাকার বাধ্যবাধকতার কারণে মানুষের জীবন ব্যাপকভাবে অনলাইনের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল। ফলে অফিসের কাজ তো বটেই, কেনাকাটা থেকে শুরু করে সিনেমা দেখার জন্যও মানুষের হাতে একমাত্র উপায় ছিল অনলাইন।
এ ধরনের পরিস্থিতির কারণে টেক কোম্পানিগুলো তাদের প্রবৃদ্ধিতে একটা বিস্ফোরণ দেখেছিল। তারা ওই সময় রেকর্ড পরিমাণ মুনাফাও করেছে, যার কারণে তারা উচ্চহারে বেতন ও সুবিধা দিয়ে প্রকৌশলী, ডেভেলপার ও অন্য প্রযুক্তি কর্মীদের নিয়োগ দিয়েছে। অনেক টেক কোম্পানিই মনে করেছে যে এটা আসলে ‘নতুন স্বাভাবিক পরিস্থিতি’ বা ’নিউ নরমাল’, যা দীর্ঘস্থায়ী হবে।
ফোর্বসের প্রতিবেদন, অনেক কোম্পানি তাদের যত কর্মী দরকার তার চেয়ে বেশি কর্মী নিয়োগ করেছিল। যা এখন আর তারা প্রয়োজনীয় বলে মনে করছে না। একই সাথে ‘নিউ নরমাল’ পরিস্থিতি দীর্ঘস্থায়ী না হয়ে বরং বর্তমানে যখন সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে আসছে তখন মানুষের অনলাইনের উপর নির্ভরশীলতা কমে গেছে।
অর্থনীতিবিদ খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, তবে তার মানে এই নয় যে এসব কোম্পানির লোকসান হচ্ছে। এসব কোম্পানি এখনো লাভই করছে। তবে কোভিড মহামারির সময় তারা যে আকাশচুম্বী প্রবৃদ্ধি দেখেছিল, সেটা আর এখন নেই।
তিনি বলেন, এখন সংকোচনটা হচ্ছে কোম্পানিগুলোর এর আগে যে বৃদ্ধিটা হয়েছিল তার উপর। এখনো বৃদ্ধি হচ্ছে, তবে সেটা আগের মতো নয়। ছোট কোম্পানিগুলোর তুলনায় বড় কোম্পানিগুলোতে এই প্রভাবটা বেশি পড়ে। কারণ প্রথমত তারা হঠাৎ করেই নতুন কোনো পণ্য বাজারে আনতে পারে না। কারণ তা সময় সাপেক্ষ। আর দ্বিতীয়ত, ছোট কোম্পানিগুলোর মতো তাদের গ্রাহক সীমিত থাকে না।
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম মনে করেন, ’বর্তমানে বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম, যুদ্ধাবস্থা ও এর সাথে জড়িত রাজনীতি’ এসব বিষয়ের সাথে কোম্পানিগুলোর কর্মী ছাঁটাইয়ের একটি সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। কারণ এসব অবস্থা বিভিন্ন অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধিকে যেমন ধীর করে তুলেছে, তেমনি মুদ্রাস্ফীতি ও জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধিতেও প্রভাব ফেলেছে। এ কারণে মানুষের চাহিদা সংকুচিত হচ্ছে এবং তারা ব্যয়ের লাগাম টেনে ধরতে বাধ্য হচ্ছে। ফলে কোম্পানিগুলোও সংকুচিত হচ্ছে এবং কর্মী ছাঁটাই করছে।
আরেকটি বিষয় হচ্ছে, টেক কোম্পানিগুলো মনে করছে যে সামনের দিনগুলো খুব একটা সহজ হবে না। বেশ কয়েক মাস ধরে শোনা যাচ্ছে যে, যুক্তরাষ্ট্র মন্দার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এই ধারণাটি নিয়ে প্রথম উদ্বেগ প্রকাশ করেন কয়েনবেইজ নামে এক টেক কোম্পানির সিইও ব্রায়ান আমর্স্ট্রং। এরপর ইলন মাস্ক, জাকারবার্গ, জেফ বেজোস এবং বর্তমানে অনেকেই একই উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
মন্দা মানে হচ্ছে গ্রাহকদের ব্যয় কমে যাবে এবং টেক ফার্মগুলোর জন্য এটা বেশ উদ্বেগের। কারণ তখন বিজ্ঞাপনের ব্যয় কমে যাবে যা তাদের আয়ের একটি বড় উৎস।
এই বিষয় নিয়ে সবচেয়ে আগে আওয়াজ তোলে মেটা। তারা বলে যে চলতি অর্থবছরের শেষ তিন মাসে এবং ২০২৩ এর শুরুতে বিজ্ঞাপন থেকে যে মুনাফা হয়েছে তারা এর চেয়ে বেশি আশা করেছিল। এ কারণে টালমাটাল অর্থনৈতিক পরিস্থিতি পার হওয়ার সময়টাকে টেক কোম্পানিগুলো ব্যয় কমানোর দিকেই গুরুত্ব দিচ্ছে বলে জানাচ্ছে ফোর্বস।
কী হতে পারে ভবিষ্যত?
যুক্তরাষ্ট্রে কর্মী ছাঁটাই যেমন বাড়ছে, আবার প্রযুক্তি খাতে বেকারত্বও কমে আসছে। আমেরিকার একটি নন-প্রফিট ট্রেড অ্যাসোসিয়েশন কম্পিউটিং টেকনোলজি ইন্ডাস্ট্রি অ্যাসোসিয়েশন যা কম্পটিয়া নামে পরিচিত, এই প্রতিষ্ঠানটির হিসাবে, যুক্তরাষ্ট্রে প্রযুক্তিক্ষেত্রে বেকারত্ব ১.৮ শতাংশ থেকে কমে ১.৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
কম্পটিয়ার প্রধান গবেষণা কর্মকর্তা টিম হার্বার্ট বলেন, এর মানে হচ্ছে যেসব কর্মীকে ছাঁটাই করা হয়েছিল তারা প্রযুক্তি খাতেই আবার চাকরি খুঁজে পাচ্ছে।
আর তাদের নিয়োগ দিচ্ছে প্রযুক্তিখাতের ক্ষুদ্র ও মাঝারি কোম্পানিগুলো যারা এখনো কর্মী সঙ্কটে ভুগছে। কারণ এর আগে তারা বেশি বেতন ও সুবিধা দিয়ে দক্ষ ব্যক্তিদের নিয়োগ দেয়ায় বড় কোম্পানিগুলোর সাথে পাল্লা দিয়ে জিততে পারেনি।
আর প্রযুক্তি শিল্পের মোট কর্মশক্তিতে সিলিকন ভ্যালির জায়ান্ট কোম্পানিগুলোর অংশ খুব বেশি নয়। বরং ক্ষুদ্র ও মাঝারি কোম্পানিগুলোই এই কর্মশক্তির বেশিরভাগ নিয়োগ দিয়ে থাকে। আর এই কোম্পানিগুলো বর্তমান বাজার অবস্থায় বেশ ভালোই আছে।
অর্থনীতিবিদ খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, প্রযুক্তি খাতের কোম্পানিগুলোতে কোভিডের আগে যে প্রবৃদ্ধি ছিল এবং কোভিড চলাকালীন যে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল, তার মাঝামাঝি একটি প্রবৃদ্ধি এখন তৈরি হবে। তবে এটা নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি নয়।
তবে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি যেহেতু এখনো স্থিতিশীল হয়নি এবং জ্বালানির বাজার এখনো গরম, ডলারের দামও যেকোনো মুদ্রার তুলনায় আকাশচুম্বী, ফলে কর্মী ছাঁটাইয়ের ঘটনা আগামী আরো কিছু সময় ধরে চলতে পারে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।
সূত্র : বিবিসি
Leave a Reply