নবীরা হলেন আল্লাহ তায়ালার মনোনীত ব্যক্তি। যাকে আল্লাহ বাছাই করেন তিনিই নবী হতে পারেন। স্বেছায় বা সাধনা করে কেউ নবী হতে পারেন না। তাঁদের সঠিক সংখ্যা আল্লাহই অধিক জ্ঞাত। সব নবী-রাসূলই উচ্চ মর্যাদার অধিকারী। তাদের মধ্যে দু’জন নবীকে জীবন্ত আকাশে উঠিয়ে নেয়া হয়েছে।
হজরত ইদরিস আ:
তিনি ছিলেন হজরত নূহ আ:-এর প্রপিতামহ এবং হজরত শীশ আ:-এর দৌহিত্র। তাঁর আরেক নাম ছিল আখনুখ। অধিক অধ্যয়নপ্রিয় ছিলেন বলে তাঁর নাম হয়েছে ইদরিস। তার প্রতি ৩০টি সহিফা নাজিল করা হয়। ইমাম বগবি বলেন, হজরত ইদরিস প্রথম কলম দিয়ে লিখার প্রচলন করেন এবং চামড়ার পোশাকের পরিবর্তে কাপড় পরিধান করার প্রথা চালু করেন। তিনি প্রথম যুদ্ধাস্ত্র ও তা দিয়ে দ্বীনের শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। তা ছাড়া তিনি জ্যোতির্বিদ্যা ও গণিতশাস্ত্রও আবিষ্কার করেন। আল্লাহ তায়ালা তার সম্পর্কে বলেছেন- ‘এ কিতাবে উল্লিখিত ইদরিসের কথা স্মরণ করো, সে ছিল সত্যবাদী, নবী ও আমি তাকে দান করেছি উচ্চ মর্যাদা’ (সূরা মরিয়ম : ৫৬-৫৭)। হজরত ওহাব ইবনে মুনাব্বাহ আরো বলেন, হজরত ইদরিস আ: ছিলেন অধিক ইবাদতগুজার বান্দাহ। তার সময়ের সব বিশ্বাসীর সমপরিমাণ ইবাদত তিনি একাই করতেন। ফেরেশতা তাঁর ইবাদতের কথা শুনে আশ্চর্য হন এবং কৌতূহলী হয়ে একদা মৃত্যুর ফেরেশতা তার সাথে সাক্ষাৎ করেন। তিনি নিয়মিত রোজ রাখতেন। তাই ইফতারের সময় মানবরূপী ফেরেশতা মেহমানকে যথারীতি ইফতার করতে বলেন। কিন্তু মেহমান তার ডাকে সাড়া দেননি। তিন দিন ক্রমান্বয়ে এরূপ করা হয়।
অবশেষে হজরত ইদরিস আ: জানতে চান- হে প্রিয় অতিথি! আপনার পরিচয় কী? তখন মেহমান বলেন, আমি মৃত্যুর ফেরেশতা! আল্লাহর পক্ষ থেকে আমি আপনার সঙ্গ লাভের জন্য অনুমতিপ্রাপ্ত হয়েছি। হজরত ইদরিস বললেন, তবে আমার একটি কাজ করে দিন। অতিথি বললেন, কী কাজ? হজরত ইদরিস বললেন, আমার প্রাণ হরণ করুন। আল্লাহর হুকুমে মৃত্যুর ফেরেশতা তাঁর জান কবজ করেন। কিন্তু কিছুক্ষণ পর আল্লাহর হুকুমে তিনি আবার জীবিত হয়ে উঠেন। অতিথি বললেন, এরকম ঘটল কেন? হজরত ইদরিস বললেন, আমি মৃত্যুর স্বাদ পেতে চেয়েছিলাম। মৃত্যুবরণ করা আমার উদ্দেশ্য ছিল না। আল্লাহ আমার ইচ্ছা পূর্ণ করেছেন। এখন আমি যথাসময়ে মৃত্যুবরণ করার যথাপ্রস্তুতি গ্রহণ করতে পারব। কারণ মৃত্যুর স্মৃতি আমার স্মরণপটে সদা জাগরূক থাকবে। এখন আপনি আমার আরেকটি কাজ করে দিন। আমাকে আকাশে নিয়ে চলুন এবং বেহেশত ও দোজখ দেখিয়ে দিন। মৃত্যুর ফেরেশতা এবারো অনুমতিপ্রাপ্ত হলেন এবং হজরত ইদরিসকে নিয়ে প্রথমে দোজখের দ্বারপ্রান্তে যান। হজরত ইদরিস বললেন, দোজখের প্রধান প্রহরীকে বলে দরজা খোলার ব্যবস্থা করুন। তাই করা হলো। হজরত ইদরিস ভালো করে দোজখের অভ্যন্তর ভাগ দেখে নিলেন। তারপর বললেন, দোজখ তো দেখলাম। এবার আমাকে নিয়ে বেহেশতে চলুন। মৃত্যুর ফেরেশতা তাঁকে নিয়ে বেহেশতে উপস্থিত হলেন। আল্লাহর নির্দেশে বেহেশতের দরজাও খুলে দেয়া হলো। হজরত ইদরিস ঘুরে ঘুরে বেহেশতের অপরূপ সৌন্দর্য দেখতে লাগলেন। মৃত্যুর ফেরেশতা বললেন, এবার ফিরে চলুন। হজরত ইদরিস একটি বৃক্ষের ডাল আঁকড়ে ধরে বললেন, আমি এখান থেকে আদৌ যাব না। আল্লাহর নির্দেশে তখন সেখানে আর একজন ফেরেশতা উপস্থিত হয়ে বললেন, আপনি ফিরে যেতে রাজি হচ্ছেন না কেন?
হজরত ইদরিস বললেন, আল্লাহ বলেছেন, সবাইকে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। আমি তা আস্বাদন করেছি। আল্লাহ আরো বলেছেন, সবাইকে দোজখ দেখানো হবে। তাও আমি অবলোকন করেছি। তিনি এ কথাও বলেছেন, বেহেশতে প্রবেশকারীরা আর কখনো বহিষ্কৃত হবে না। আমি তো সেই জান্নাতেই প্রবেশ করেছি। সুতরাং আমি এখান থেকে বের হবো কেন? আল্লাহ তখন মৃত্যুর ফেরেশতাকে বললেন, আমার অনুমতিক্রমেই তো সে বেহেশতে প্রবেশ করেছে। সেখান থেকে বের হতে হলে আমার অনুমতিক্রমেই তা হবে। তোমাদের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে আর কোনো চেষ্টা করো না। এভাবেই হজরত ইদরিস আ: এক ব্যতিক্রমী উচ্চ মর্যাদা লাভ করেছেন (তাফসিরে মাজহারি, সপ্তম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৩৯৬)।
ওহাব ইবন মুনাব্বাহ অন্যত্র বলেছেন, হজরত ইদরিস আ: আকাশে জীবিত অবস্থায় আছেন না মৃত অবস্থায়- এ ব্যাপারে মতভেদ রয়েছে। একদল মনীষীর মতে তিনি আকাশে জীবিত অবস্থায় আছেন।
হজরত ঈসা আ:
তাফসিরের কিতাবে উল্লেখ রয়েছে, একদল ইহুদি হজরত ঈসা আ: এবং তাঁর পুত-পবিত্র জননীকে গালি দিলো। তিনি তখন তাদের জন্য বদদোয়া করেন। তাঁর বদদোয়ার ফলে অল্লাহ তায়ালা গালিদাতাদের বানর ও শূকরে পরিণত করে দেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে তারা নিজেদের মধ্যে পরামর্শক্রমে এই সিদ্ধান্ত নেয়, হজরত ঈসা আ:-কে হত্যা করতে হবে। আল্লাহ পাক তখন হজরত ঈসা আ:-কে ওহির মাধ্যমে জানালেন যে, তোমাকে আকাশে উঠিয়ে নেয়া হবে। আল্লাহ তায়ালা এ প্রসঙ্গে বলেছেন- ‘তারা তাকে হত্যা করেনি ও ক্রুশবিদ্ধও করেনি। তবে তারা সন্দেহে পতিত হয়েছে’ (সূরা নিসা-১৫৭)।
কোনো কোনো বর্ণনায় রয়েছে, হজরত ঈসা আ: তাঁর সহচরদের বললেন, তোমাদের মধ্যে কেউ আছো কি আমার আকৃতিবিশিষ্ট হতে চাও? যাকে ইহুদিরা শূলে চড়াবে এবং সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। একজন দাঁড়িয়ে বলল- আমি চাই। তখন আল্লাহ তায়ালা তার আকৃতি হজরত ঈসা আ:-এর আকৃতির মতো করে দেন। এ ব্যক্তিকেই ইহুদিরা শূলে চড়িয়ে হত্যা করে।
ইমাম বগবি বলেছেন, আল্লাহ তায়ালা এই ব্যক্তিকে হজরত ঈসা আ:-এর আকৃতি বিশিষ্ট করে দেন। ইহুদিরা তাকেই হজরত ঈসা আ: মনে করে ক্রুশবিদ্ধ করে। হজরত ইবনে আব্বাস রা: থেকে বর্ণিত আছে- ইহুদিদের নেতা ইয়াহুদা হজরত ঈসা আ:-কে হত্যার জন্য এক ব্যক্তিকে নিযুক্ত করে। তার নাম ছিল তাতিয়ানুস। সে হত্যার উদ্দেশ্যে যখন হজরত ঈসা আ:-এর গৃহে প্রবেশ করল তৎক্ষণাৎ আল্লাহ তায়ালা হজরত ঈসাকে আকাশে উঠিয়ে নেন। আর তাতিয়ানুসের চেহারা অবিকল হজরত ঈসার মতো হয়ে যায়। সে ঘর থেকে বের হয়ে এলে অপেক্ষমাণ ইহুদিরা তাকেই হজরত ঈসা মনে করে প্রথমে বন্দী করে তারপর শূলে চড়ায়।
কেউ কেউ বলেছেন, ইহুদিরা হজরত ঈসা আ:-কে একটি ঘরে বন্দী করে রাখে এবং তার জন্য একজন পাহারাদার নিযুক্ত করে। আল্লাহ তায়ালা পাহারাদারের চেহারাকে হজরত ঈসা আ:-এর চেহারার মতো করে দেন। ইহুদিরা তাকে হজরত ঈসা আ: ভেবে হত্যা করে। অথচ আল্লাহ তায়ালা তাঁকে আকাশে উঠিয়ে নেন।
হজরত ঈসা আ:-এর ক্রুশবিদ্ধ হওয়া নিয়ে ইহুদিদের মধ্যেই মতভেদ রয়েছে। কালবি বলেছেন, ইহুদিরা বলে, আমরা ঈসাকে হত্যা করেছি। খ্রিষ্টানরা বলে তাকে আমরা হত্যা করেছি (তাফসিরে মাজহারি, সপ্তম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৩৯৪)।
লেখক : প্রধান ফকিহ, আল-জামিয়াতুল ফালাহিয়া কামিল মাদরাসা, ফেনী
Leave a Reply