আমাদের দেশে ফাঁকাবুলির গুরুত্ব অত্যাধিক। সরকার, মিডিয়া, জনগণ—সবার কাছে সমান তালে এর গুরুত্ব যেন অপরিসীম। ফাঁকাবুলি হাঁকাতে হাঁকাতে বিরোধী দল ক্লান্ত, সরকার ভাবতে ভাবতে ক্লান্ত, মিডিয়া দৌড়া দৌড়িতে ক্লান্ত, বেচারা জনগণ অসন্তোষে ক্লান্ত। তবুও অভিনয়, টানটান উত্তেজনা ‘খেলা হবে’। কে কী নিয়ে খেলবে, কোন ধরনের খেলা হবে, এর প্রতিপক্ষই বা কে—এটা দেশ ও জনতার কাছে পরিষ্কার নয়, তবুও ‘খেলা হবে’।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে ফাঁকাবুলির ঐতিহাসিক ব্যবহার কবে, কখন শুরু হয় তার সঠিক ইতিহাস আমার জানা নেই। অকাট্ট দালিলিক প্রমাণে বলতে পারি, মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন দেশের জনগণের কাছে কোনো রাজনৈতিক নেতা ফাঁকাবুলি ব্যবহার করেননি। মহান স্বাধীনতার স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনে একটিও ফাঁকা আওয়াজ করতে দেখা যায়নি। তিনি যা বলতেন বাস্তবে সেটা করতেন। লক্ষ্য করে দেখবেন, বঙ্গবন্ধুর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে তিনি ১০৮০ সেকেন্ডে শব্দ চয়ন ছিল ১০৯২টি। একটি শব্দ বের করে দেখান, যেখানে কোনো ফাঁকা আওয়াজ ছিল।
বঙ্গবন্ধু তখন জাতির পিতা নন, এমনকি বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত হননি। তিনি কলকাতায় লেখাপড়া করছেন। সেসময়ে এই উপমহাদেশে দাপুটে নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, কলকাতার কোনো এক অনুষ্ঠানে তার সিদ্ধান্ত পুনঃবিবেচনার বিনম্র প্রস্তাব দেন ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ক্ষিপ্ত হয়ে বললেন, Who are you? You are no body. ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান উত্তর দিলেন, if I am nobody but why you have invited me. you are no right insult me. I will provted that I am same body. I will never come to agin. thank you sir.
সত্য কথা বলতে কী, ছাত্রজীবনেও তিনি ফাঁকা আওয়াজ দেননি বিধায় সেদিনও শ্রদ্ধেও নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমানের কথা রেখেছিলেন। এটাই তো রাজনৈতিক শিষ্টাচার।
রাজনৈতিক অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ও তার স্বপরিবার নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়ার পর রাজনীতিতে ফাঁকা আওয়াজ, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও লুটপাটের অধ্যায় রচিত হয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে যে কয়টি রাজনৈতিক দল পরিচিতি লাভ করেছে, তারা প্রত্যেকেই কম-বেশি ফাঁকা আওয়াজ দিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে।
রাজনৈতিতে ট্রামকার্ড মনে আছে কি? এক আওয়াজে জামায়াত-বিএনপি সরকারের কী ভয়াবহ অবস্থা হয়েছিল? প্রায় ১৮ বছর আগের কথা, ওই সময়কার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল জলিল বিরাট আওয়াজ দিয়ে বলেছিলেন, ৩০ এপ্রিল জামায়াত-বিএনপি সরকারের পতন হবে। এমন ঘোষণায় জামায়াত-বিএনপি সরকার নাজেহাল হয়ে পড়েছিল। ১ মাস ১০ দিন তাদের চোখের ঘুম হারাম হয়ে গিয়েছিল।
পুলিশ কারে রেখে কারে ধরে, ভুতুড়ে এক পরিবেশ আওয়ামী লীগের প্রায় ৮ হাজার নেতাকর্মী গ্রেপ্তার, দিনশেষে যার যার তার তার। কেউ কথা রাখেনি। তবে এ কথা মানতে হবে, প্রয়াত আব্দুল জলিলের ট্রামকার্ডের ঘোষণায় বিরোধী দল আওয়ামী লীগ বেজায় তৎপর ছিল। আমরা দেখেছিলাম, ৩০ এপ্রিল সরকার পতন হবে, ২১ মার্চের ওই ঘোষণার কয়েক দিন যেতে না যেতেই আওয়ামী লীগ ৩০ মার্চ রাজধানীর পল্লবী থেকে বাহাদুর শাহ পার্ক পর্যন্ত ২২ কিলোমিটার ‘গণঅনাস্থা প্রাচীর’ গড়ে তুলেছিল, যাকে সংবাদপত্রে ‘বাংলাদেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন’ সফল রাজনৈতিক কর্মসূচি হিসেবে অভিহিত করেছিল।
বিএনপি টানা সাড়ে ১৬ বছর ক্ষমতার বাইরে, দলে হ-য-ব-র-ল অবস্থা। তাদের সভানেত্রী এতিমের টাকা আত্মসাৎ মামলায় দণ্ডিত, তারেক রহমান পালাতক আসামি, অন্যদিকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ একাধারে ১৪ বছরের বেশি সময় ক্ষমতায়। এই দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় কার্যত বিএনপি সরকারের বিপক্ষে জনগণের সম্মুখে তেমন কোনো এজেন্ডা নিয়ে আসতে সক্ষম হয়নি। প্রেস বিজ্ঞপ্তি আর ফাঁকা আওয়াজ তাদের রাজনীতির প্রধান হাতিয়ার হয়ে দাড়িয়েছে। বিএনপির ফাঁকা আওয়াজ শুনতে শুনতে জনগণ আজ তিক্ত ও বিরক্ত।
নতুন করে বিএনপির পক্ষ থেকে আগামী ১০ ডিসেম্বর নিয়ে যে ডেড লাইন দেওয়া হয়েছে, তা ১০ ডিসেম্বর ফাঁকাবুলিতে পরিণত হবে। এতে কারও মনে কোনো সন্দেহ নেই। ১৮ বছর আগে আব্দুল জলিলের ট্রামকার্ড খেলা সম্ভাব হয়নি, বিএনপি ১৬ বছরে নিজেদের খেলা দেখাতে পারেনি, ১০ তারিখেও কোনো ‘খেলা হবে’ বলে মনে করার কোনো কারণ নেই। আমরা রাজনীতিতে শুভবুদ্ধির উদয় দেখতে চাই। ফাঁকাবুলি আর মুখরোচক খেলা নয়।
ইব্রাহিম হোসেন মুন: সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
Leave a Reply