ইন্দোনেশিয়ার বালিতে জি২০ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিনপিংয়ের সঙ্গে করমর্দন করেছেন। ভিডিও ফুটেজে এমনটাও নাকি দেখা গেছে যে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নিজে চীনের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে করমর্দন করতে এগিয়ে আসেন এবং শি চিনপিং ঘুরে দাঁড়িয়ে তাঁর সঙ্গে করমর্দন করেন। সৌজন্য বিনিময় হয় দুই রাষ্ট্রনায়কের মধ্যে। এই ছোট্ট সামাজিক শিষ্টাচারের দৃশ্যটি দেখে ভারতে বিরোধী রাজনীতিতে তুলকালাম কাণ্ড শুরু হয়ে গেছে।
বিশেষত কংগ্রেসের পক্ষ থেকে রাহুল গান্ধী, জয়রাম রমেশ—তাঁরা প্রশ্ন তুলেছেন, চীন যখন ভারতের মধ্যে দখলদারি নিয়ে বসে আছে এবং তারা কিছুতেই তাদের সেনা, যাদের অনুপ্রবেশ করানো হয়েছিল মোদি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর, সেই চীনা সেনা প্রত্যাহার করার ব্যাপারে তারা কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করছে না, তাহলে মোদির এই সৌজন্যমূলক করমর্দনের অতি-উৎসাহের কারণ কী? এটা কি চীনের ড্রাগনের শক্তির কাছে ভারতের আত্মসমর্পণ করা নয়?
আসলে দেশজ রাজনীতি আর বিশ্বকূটনীতির মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা না করাটাও একটা মহাসমস্যার বিষয়। নরেন্দ্র মোদি যখন প্রধানমন্ত্রী হন এবং রাহুল গান্ধী বিরোধী নেতা, তখন চীনা রাষ্ট্রদূত রাহুল গান্ধীর সঙ্গে দিল্লিতে বৈঠক করেন। সেই বৈঠকটি সংগঠিত করতে সাহায্য করেন সাবেক পররাষ্ট্রসচিব এবং চীনে ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত শিবশঙ্কর মেনন। এই বৈঠকটিকে কেন্দ্র করে সেদিন বিজেপি তীব্র সমালোচনায় নামে যে কেন রাহুল গান্ধী চীনের সঙ্গে বৈঠক করছেন। ভারত যখন চীনের সঙ্গে সংঘাতের পথে যাচ্ছে, চীন দখল নিচ্ছে ভারতের ভূখণ্ডে তখন রাহুল গান্ধীর এমন আচরণ একটা বিশ্বাসঘাতকতার পরিচয়।
চীন যখন ১৯৬২ সালে ভারত আক্রমণ করেছিল তখন কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল। বিজেপিও সেই অভিযোগ সাংঘাতিকভাবে সামনে তুলে নিয়ে আসে যে তারা কমিউনিস্টদের এই আক্রমণকে সুষ্ঠুভাবে বিরোধিতা করেনি। তারা এই আক্রমণকে আক্রমণ বলে মনে করেনি। তাই কমিউনিস্টরা বিশ্বাসঘাতক, দেশের শত্রু। এমনকি অটল বিহারি বাজপেয়ির মতো রাজনৈতিক নেতা—তিনিও একটি পুস্তিকা পর্যন্ত লিখে ফেলেন ‘বিশ্বাসঘাতক কমিউনিস্ট’ নামে। এখনো সেই বইটি বিজেপির পার্টি অফিসের পুস্তক বিপণিতে বিক্রি হয়।
এখন আজকের প্রসঙ্গে ফিরে আসা যাক। ভারত সম্পর্কে চীন অনমনীয় অবস্থান নিচ্ছে। অর্থাৎ ১৯৬২ সালের চীন আক্রমণের পর চীনা সেনারা যে জায়গা দখল করেছিল, সেই দখল তারা ত্যাগ করেনি। সামান্য দুটি পোস্ট থেকে তারা সেনা সরিয়ে নিয়েছিল। সেটাকেও ইতিবাচক পদক্ষেপ বলে মনে করা হয়েছিল। তবে চীন এখনো কিন্তু ভারত সম্পর্কে তাদের মনোভাবের সুস্পষ্ট পরিবর্তন দেখাচ্ছে না।
এমন পরিস্থিতিতে সমরখন্দে অনুষ্ঠিত সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশনের সম্মেলনে নরেন্দ্র মোদি পাকিস্তান তো দুরস্ত, চীনের সঙ্গেও কোনো বৈঠক করেননি। চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিনপিং প্রত্যাশা করলেও ভারত তখন চীনের সঙ্গে বৈঠকে বসতেই রাজি হয়নি। নরেন্দ্র মোদি একটা বার্তা দিয়েছিলেন, তিনি চীনকে ভয় পাচ্ছেন না। তিনি চীনের সঙ্গে একটা At-per কূটনীতির বার্তা দিতে চেয়েছিলেন। এ নিয়ে সেই সময় একটা প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছিল। কেননা চীন সেই সময় ভারতের সঙ্গে আলোচনায় বসতে আগ্রহী ছিল।
সময় বদলায়। প্রতিটি দেশের রাজনীতি বদলাচ্ছে, পৃথিবী বদলাচ্ছে, বিশ্বকূটনীতির ধরন-ধারণ বদলাচ্ছে। ইন্দোনেশিয়ার বালিতে জি২০ সম্মেলন শেষ হয়েছে। এবার ভারত হচ্ছে পরবর্তী জি২০ সম্মেলনের প্রধান হোতা। ভারতে নরেন্দ্র মোদি হলেন অন্য সব রাষ্ট্রের হোস্ট। তার ফলে চীন, পাকিস্তানসহ আমেরিকা, রাশিয়া—সবাই ভারতে আমন্ত্রিত। ২০২৩ সালের জি২০ সম্মেলনে তারা ভারতে আসবে। ভারত তাদের সবাইকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। জি২০-এর সদস্য না হলেও বাংলাদেশকে বিশেষভাবে এই সম্মেলনে উপস্থিত থাকার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়ে নরেন্দ্র মোদি এই প্রতিবেশী রাষ্ট্রের যে কূটনীতি, ভারত-বাংলাদেশ যে কূটনৈতিক অক্ষ, সেখানেও একটা বিশেষ বার্তা দিয়েছেন।
এখন এই পরিস্থিতিতে নরেন্দ্র মোদি যখন চীনের সঙ্গে At-per কূটনীতিতে যেতে চাইছেন তখন চীন কী করবে, সেটাই দেখার বিষয়। পুতিন যে রকম ইন্দোনেশিয়ার বালিতে গেলেন না, পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে পাঠিয়ে দিলেন, ঠিক সেভাবে যদি চীন ভারতে জি২০ সম্মেলনে মোদির আমন্ত্রণে সাড়া দিতে না আসে এবং চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে পাঠিয়ে দেয়, তাহলে সেটাও একটা সম্ভাব্য পরিস্থিতি হতে পারে। আবার চীনের প্রেসিডেন্ট ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী—কেউই না এসে একটা ভার্চুয়াল কনফারেন্সের মাধ্যমেও জি২০ সম্মেলনে চীনের প্রেসিডেন্ট যোগ দিতে পারেন। কেননা এমনটা আজকাল বহু ক্ষেত্রে হচ্ছে। কভিডের পর তো এ ধরনের ভার্চুয়াল মিটিং করার একটা রেওয়াজ শুরু হয়েছে।
তৃতীয় অপশন হচ্ছে, জি২০ সম্মেলনে ভারতের অনমনীয় অবস্থানের জন্য চীন সম্পূর্ণ বয়কট করল। যখন ৯ মাস হয়ে গেল ইউক্রেন যুদ্ধ থামল না এবং রাশিয়ার পুতিনের সঙ্গেও ব্যক্তিগতভাবে সম্পর্ক ভালো রেখে ভারতের পক্ষ থেকে রাশিয়াকে বার্তা দিয়ে নরেন্দ্র মোদি সেপ্টেম্বর মাসে বলেছেন, এটা কিন্তু যুদ্ধের যুগ নয়। অর্থাৎ যুদ্ধটাকে বন্ধ করে শান্তির পথে আসাটাই তাঁর লক্ষ্য। জি২০-এর সম্মেলনেও একটা রেজল্যুশন নেওয়া হয়েছে। যেখানে বলা হয়েছে, কোনো রাষ্ট্র যেন পরমাণু বিস্ফোরণ বা পরমাণু শক্তি ব্যবহারের হুমকি না দেয়। আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলতে হবে এবং শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সে ব্যাপারে সবাই সম্মত হয়েছে। তবে রাষ্ট্রসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ইউক্রেন যুদ্ধের বিরুদ্ধে কোনো প্রস্তাব নেওয়াই যাচ্ছে না। কারণ সেখানে চীন পাশে এসে দাঁড়িয়েছে রাশিয়ার। বিশ্বরাজনীতির এই সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে চীন একটা ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
এ রকম একটা পরিস্থিতিতে ভারত জি২০-এর প্রধান হিসেবে বিশেষভাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত। তারা চাইছে, কী করে ইউক্রেন যুদ্ধটাকে থামানোর ব্যাপারে সমাধানের সূত্র তৈরিতে সাহায্য করা যায়। ইউরোপের অন্যান্য রাষ্ট্রও চাইছে এই যুদ্ধ থামাতে। ইউরোপের দেশগুলো ভারতকেও অনুরোধ করছে, যাতে ভারত মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। এখন এই পরিস্থিতিতে নরেন্দ্র মোদির পক্ষে চীনের রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গে করমর্দন করা এবং আমন্ত্রণ জানানোটাই কিন্তু স্বাভাবিক কূটনীতি। সেটা না করাটাই অনুচিত বলে আমি মনে করি। সে ক্ষেত্রে আমার মনে হয়, নরেন্দ্র মোদি করমর্দন করে ঠিক কাজই করেছেন।
দেশের ভেতরে দেশজ রাজনীতি আর বিশ্বরাজনীতির মধ্যে যখন সংঘাত বাধে তখন অনেক সমস্যা হয়। আজ গোটা বিশ্বের রাজনীতিতে যে এত নৈরাজ্য, এত অশান্তি, নরেন্দ্র মোদি চাইছেন, এই উপমহাদেশে যাতে কোনো অশান্তির ছায়া এসে না পড়ে। কেননা ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যেও সম্পর্ক বিষময়। সেই সম্পর্কটাকেও সুস্থির জায়গায় নিয়ে আসার একটা চেষ্টা রয়েছে। কেননা ভারত ও পাকিস্তান দুটি পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্র। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি হচ্ছে তাদের সার্বভৌম পররাষ্ট্রনীতি। সেখানে বাংলাদেশের সার্বভৌম স্বার্থকে প্রথম গুরুত্ব দিয়ে অন্য সব রাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রক্ষা করা—এটাই বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালেই এই পররাষ্ট্রনীতি সাংবিধানিকভাবে প্রতিষ্ঠা করে গেছেন।
এখন এই পরিস্থিতিতে নরেন্দ্র মোদির পররাষ্ট্রনীতি হলো ‘ইন্ডিয়া ফার্স্ট’ পররাষ্ট্রনীতি। অর্থাৎ প্রথমে ভারতের স্বার্থটা দেখতে হবে। ভারতের স্বার্থ দেখেই এখন চীনের সঙ্গেও আলাপ-আলোচনার পথে যেতে হবে। যতই সংঘাত থাক, আজ আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বাইডেনও কিন্তু জি২০ সম্মেলনে চীনের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠকে বসলেন। তাই বলে কি বাইডেনের সঙ্গে চীনের ঝগড়া মিটে গেল? ঝগড়া মিটল না, কিন্তু একটা এনগেজমেন্ট যে চালু আছে, একটা পারস্পরিক আলোচনা যে চালু আছে, সেই বার্তাটা তিনি গোটা বিশ্বের কাছে দিয়েছেন। সেটা হলো শান্তির বার্তা। এমনিতেই কোয়াড সক্রিয় রয়েছে। কোয়াডের যারা সদস্য, সেখানে ভারত-আমেরিকা ছাড়াও অস্ট্রেলিয়া-জাপান আছে। এখন এই গোষ্ঠীটাকে চীন ভালো চোখে দেখছে না। চীন কিন্তু আগামী দিনে পানির সংকট হতে পারে জেনে ধীরে ধীরে হিমালয় দখলের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে।
এখন এ রকম একটা পরিস্থিতিতে পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো যুদ্ধ থামানোর চেষ্টা করবে। যুদ্ধকে আরো বাড়িয়ে দিয়ে এমনিতেই গোটা পৃথিবীতে আর্থিক সংকট চলছে। জনসংখ্যা বিপুলভাবে বেড়ে গেছে। সেখানে কর্মহীনতা, বৃত্তিহীনতা এমন নানা সমস্যা রয়েছে। তার মধ্যে মহামারি অর্থনীতিকে আরো বিপর্যস্ত করে দিয়েছে। সেখানে একটা যুদ্ধ মানে কতটা আর্থিক লোকসান, সেটা বুঝতে তো পৃথিবীর কোনো সচেতন নাগরিকের অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। তাই নরেন্দ্র মোদি যখন প্রধানমন্ত্রী হন তখন সবরমতীর তীরে চীনের প্রেসিডেন্টকে ডেকে তিনি শান্তির বার্তা দিয়েছিলেন। ঠিক যেমনটা করেছিলেন নওয়াজ শরিফের সঙ্গেও, একেবারে শপথগ্রহণের সঙ্গে সঙ্গেই তিনি দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে বসেছিলেন। অবশ্য তাঁর সেই শান্তির প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল। এর ফলে সেই শান্তি থেকে একটা সংঘাতের পরিবেশ তৈরি হয়। সেখানে একদিকে যে রকম পুলওয়ামা আক্রমণ হয়েছে, আর একদিকে চীনের হিমালয় দখলের আগ্রাসনও আমরা দেখেছি। এই পরিস্থিতিতে নতুন বছরে আবার নতুন করে যদি একটা আলাপ-আলোচনার পরিস্থিতি তৈরি করা যায়, তবে সেটা কাঙ্ক্ষিত।
১৯৬২ সালের পর থেকে চীনের সঙ্গে সীমান্ত নিয়ে বিবাদ বেড়েছে বৈ কমেনি। ১৯৪৭ সালের পর থেকে সেই বিবাদ মেটানোর চেষ্টা হয়েছিল। নেহরু ‘পঞ্চশীল’ নীতির মাধ্যমে সেটা মেটানোর চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু সফল হননি। চীন আক্রমণও করেছিল। সেই আক্রমণের পর এতগুলো বছর কেটে গেছে। দুই দেশের মধ্যে সীমান্তবর্তী আলাপ-আলোচনা চলতেই থাকে। সীমান্ত বিবাদেরও চূড়ান্ত সমাধান হয়নি। সমাধান যদি এত তাড়াতাড়ি না-ও হয়, সে ক্ষেত্রেও যেভাবে চীন এবং সীমান্ত নিয়ে আলাপ-আলোচনার প্রক্রিয়াটা চালু আছে, সেটা বন্ধ হয়নি, ঠিক সেভাবে আগামী দিনে এই উপমহাদেশে সন্ত্রাস দমন করে শান্তির পথে এগোনোর জন্যও চীনের সঙ্গে আবার নরেন্দ্র মোদির আলোচনায় বসা বিশেষভাবে জরুরি। মতপার্থক্য থাকলেও আলোচনার মাধ্যমেই মতপার্থক্য নিরসন করতে হবে। যুদ্ধের মাধ্যমে নয়।
লেখক : নয়াদিল্লিতে কালের কণ্ঠের
বিশেষ প্রতিনিধি
Leave a Reply