স্বাভাবিকভাবে একজন শিশু দুই আড়াই বছর বয়স থেকে একটু আধটু কথা বলে। ছোট ছোট বাক্য বলতে পারে। ইসলামের ইতিহাসে এমন কতক শিশু আছে, যারা আল্লাহর হুকুমে নবজাতক অবস্থায় কথা বলেছিল!
প্রথম শিশু ফেরাউনের বাঁদীর সত্যের ওপর থাকার প্রতি সাক্ষী দেন। ফেরাউনের মেয়ের চুল আঁচড়ে দেয়ার সময় হাত থেকে চিরুনি পড়ে যায়। ফেরাউনের বাঁদী সেটি তোলার সময় বিসমিল্লাহ বলেন। ফেরাউনের মেয়ে শুনে ফেলে। জিজ্ঞাসা করল, ‘এই পৃথিবীতে একমাত্র খোদা হলেন আমার আব্বা! তুমি কার নাম নিলে।’
বাঁদী তখন নতুন ধর্মের সংবাদ দেন এবং বলেন, আমি এক আল্লাহর ওপর ঈমান এনেছি, মুসা আ:-কে সত্য নবী হিসেবে মানি। ফেরাউনের মেয়ে এই খবর ফেরাউনকে বলে দেয়। ফেরাউন বাঁদীকে সভায় উপস্থিত করাল। প্রথমে হুমকি ধমকি দিতে থাকে। তার ধর্ম থেকে ফিরে আসতে বলে, ফেরাউনকে খোদা হিসেবে মানার জন্য বলে। ফেরাউনের বাঁদী তা অস্বীকার করেন। ফলে ফেরাউন আরো কঠিন পদক্ষেপ নেয়।
বাঁদীর কোলে থাকা সদ্যজাত সন্তানকে কেড়ে নিয়ে হত্যা করার আদেশ দিলো ফেরাউন। যদি মুসার ধর্ম ত্যাগ না করে, তার সন্তানকে হত্যা করে ফেলা হবে। তখন সদ্যজাত সন্তানটি মাকে বলল, আপনি সত্যের ওপর আছেন, সত্যের ওপর অটল থাকুন। সন্তানের মুখে এ কথা শোনে, বাঁদীটির ঈমান আরো মজবুত হয়।
দ্বিতীয় শিশু ইউসুফ আ:-এর পক্ষে সাক্ষ্য দেয়। ইউসুফ আ:-কে কূপ থেকে তুলে মিসরে নিয়ে যায় একটি বণিক দল। ইউসুফ আ: ছিলেন অধিক সৌন্দর্যের অধিকারী। তাঁর সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে তৎকালীন যুগের মন্ত্রীদের স্ত্রী-মেয়েরা হাত কেটে ফেলেন, অথচ একটু ব্যথা অনুভব হলো না।
মিসরে ক্রমেই ইউসুফ আ:-এর মূল্য বৃদ্ধি পেতে লাগল। মূল্য এমন পর্যায়ে পৌঁছাল, তাঁকে খরিদ করার মতো ক্ষমতা আর কারোর ছিল না একমাত্র বাদশাহ, মন্ত্রী ছাড়া। তাঁকে তাঁর ওজন পরিমাণ স্বর্ণ দিয়ে কিনে নেয় আজিজ মিসর। তার স্ত্রী ছিলেন জুলেখা! ইউসুফকে জুলেখা নিজের সন্তানের মতো লালন পালন করেন।
ইউসুফের সৌন্দর্যের কাছে জুলেখা হেরে গেল। নিজেকে কন্ট্রোলে রাখতে পারেনি। তার ধ্যান-জ্ঞান সব ইউসুফ আ:। একদিন ইউসুফ আ:-কে বদ্ধ ঘরে নিজের প্রতি আহ্বান করে জুলেখা। কিন্তু ইউসুফ আ: কোনোমতেই রাজি হচ্ছিলেন না। জুলেখা প্রথমে লোভ দেখায়, তারপর হুমকি ধমকি দেয়। ইউসুফ আ: নাছোড়বান্দা, কোনোভাবেই রাজি করতে পারছিল না।
ইউসুফ আ: আল্লাহর নাম নিয়ে দরজার দিকে দৌড় দেন। পেছন পেছন জুলেখাও ধরার জন্য ছুটে। কুদরতিভাবে সব দরজা আপনাআপনি খুলে যায়। জুলেখা ধরার জন্য পেছন থেকে জামা ধরলে তা ছিঁড়ে যায়। সর্বশেষ দরজাটি খুলতেই সামনে পড়ে আজিজ মিসর। জুলেখা সাথে সাথে নিজের অবস্থান পরিবর্তন করে ফেলে এবং ইউসুফকে শাস্তি দেয়ার কথা বলে। তখন আজিজ মিসরের খেদমতে থাকা এক বাঁদীর নবজাতক শিশু ইউসুফ আ:-এর নিষ্পাপ হওয়ার সাক্ষী দেন।
তৃতীয়তম শিশু মরিয়ম আ:-এর পবিত্রতা ঘোষণা করেন! ইমরান আ:-এর বিবি নিয়ত করেন, গর্ভে থাকা সন্তানকে বায়তুল মাকদাসে খেদমতের জন্য পেশ করবেন! কিন্তু মাতৃগর্ভ থেকে আগমন করলেন একজন মেয়ে শিশু। এতে ইমরান আ:-এর স্ত্রী বিপাকে পড়ে যান, মেয়ে তো মসজিদের খেদমত করতে পারবে না।
আল্লাহর হুকুমে মরিয়ম আ:-কে বায়তুল মাকদাসে খেদমতে পাঠিয়ে দেন। সেখানেই মরিয়ম আ: আল্লাহর ইবাদত করেন এবং আল্লাহর কুদরতি ফলাদি থেকে আহার করতেন! আল্লাহর ইচ্ছা ছিল, মরিয়ম আ: থেকে একজন নবীর আবির্ভাব ঘটানো।
মরিয়ম আ:-এর কোলে আসে একটি ফুটফুটে শিশু সন্তান!
এলাকায় শোরগোল পড়ে গেল, ‘মরিয়মকে আমরা দ্বীনদার বলে জানতাম। আল্লাহর খাস বান্দী বলে জানতাম, অথচ কোনো বিয়ে-শাদী ছাড়া সন্তান ভূমিষ্ট হলো!’ অপবাদ দিতে লাগল একে একে সবাই। সেই অপবাদের কঠোর প্রতিবাদ করে নবজাতক শিশুটি। ‘মরিয়ম আ:-এর পবিত্রতা বর্ণনা করে এবং নিজের নবী হওয়ার আগাম পয়গাম দেয়! শিশুর কথা বলা দেখে সবাই অবাক হয় এবং নিজেদের ভুল বুঝতে পারে! শিশুটি হলেন ঈসা আ:!
চতুর্থতম শিশু ইবনে জুরাইজের নিষ্পাপ হওয়ার সাক্ষী দেয়! ইবনে জুরাইজ ছিলেন একজন মুত্তাকি মানুষ! তিনি ছিলেন বনি ইসরাঈলের লোক। তার দ্বীনদারিত্ব সবারই জানা। কিন্তু মায়ের বদদোয়া তার পিছু ছাড়েনি।
একদিন ইবনে জুরাইজের আম্মাজান ইবনে জুরাইজকে ডাকতে আসেন। কামরার বাইরে থেকে নাম ধরে ডাকলেন অনেকবার। কিন্তু ভেতর থেকে কোনো সাড়াশব্দ এলো না। কারণ, ইবনে জুরাইজ নামাজ অবস্থায় ছিলেন। এভাবে তিন দিন ডাকতে আসেন, প্রতিবারই ব্যর্থ হন। ব্যথিত অন্তরে বদদোয়া করেন, ‘ইবনে জুরাইজ কোনো ব্যভিচারী মহিলার চেহারা না দেখা পর্যন্ত যেন মৃত্যুবরণ না করে!’ আল্লাহ তায়ালা এই বদদোয়া কবুল করেন এবং ঠিক তাই হলো।
ওই এলাকায় আসে এক ব্যভিচারী মহিলা। সেও ইবনে জুরাইজ সম্পর্কে শোনে। প্রতিজ্ঞা করে, সে ইবনে জুরাইজকে তার প্রতি আকৃষ্ট করাবে, তার ফাঁদে ফেলবে! অনেকভাবে জাল ফেলল, শিকার করতে পারেনি। অনেক রকমে ফাঁদ পাতে, কোনো লাভ হয়নি। ক্ষোভে, রাগে, পরাজয়ের গ্লানি অতিষ্ঠ করে তুলেছিল তাকে।
সে একটি রাখালের সাথে সম্পর্ক করে। একটি সন্তানও জন্মলাভ করে। সে গ্রামে গ্রামে বলে বেড়ায়, এই শিশু জুরাইজের। কিন্তু কেউ বিশ্বাসই করতে পারছে না, জুরাইজ এই কাজ করেছে। কারণ সবাই জুরাইজ সম্পর্কে জানে। গ্রামের মানুষ জুরাইজের খানকাহ ভেঙে ফেলে এবং জুরাইজকে প্রচণ্ড মার মারে! এমতাবস্থায় শিশুটি সাক্ষ্য দেয়, তার বাবা জুরাইজ নয়, অমুক রাখাল! সবাই অবাক হয়ে যায়। অবাক হওয়ারই কথা! আপনার সামনে এমন ঘটনা ঘটলে আপনিও অবাক হতেন!
এই চারজন শিশুর কথা বলার কথা ইতিহাসে পাওয়া যায়।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও গল্পকার
Leave a Reply