ক্রমাগত বাড়তে থাকা নিত্যপণ্যের উচ্চ দাম, বিদ্যুতের নাজুক পরিস্থিতি, অর্থনৈতিক গোলমাল, সামাজিক অস্থিরতাসহ নানা ঝুঁকি-ঝক্কিতে এখন দেশ। নিত্যপণ্যের সাথে বাড়ছে অন্যান্য সেবাপণ্যের দামও। এ অবস্থায় প্রতিদিনের খাদ্য তালিকা ছোট করছে সাধারণ মানুষ। কমিয়ে দিচ্ছে চিকিৎসার মতো গুরুত্বপূর্ণ ব্যয়ও। খরচ কমিয়ে টিকে থাকার এই কৌশলও এখন আর কাজে আসছে না। কারণ ব্যয়ের লাগাম টানা যাচ্ছে না কিছুতেই। প্রতিদিনই বাড়ছে কোনো না কোনো খরচ। তা কম খেয়ে, একবেলা না খেয়ে অথবা ঋণ করে সামলানোর মতো নয়।
ফলে বর্তমানে দেশের অবস্থা মোটেই ভালো যাচ্ছে না। তালগোল আরো অনেক দিকেই। টেনে আনতে ছিঁড়ে যাওয়ার দশা। সামলাতে গিয়ে হিমশিম অবস্থা। নানা ব্যাখ্যা থাকলেও এসব তথ্য নিয়ে দ্বিমত-ভিন্নমতের সুযোগ নেই। সেটি করা মানে সত্যকে অস্বীকার করা, বাস্তবতাকে এড়িয়ে যাওয়া, গায়ের জোরে পাহাড় ঠেলা। ফলে নিত্যপণ্যের লাগামহীন দামের সাথে আর পেরে উঠছে না সাধারণ মানুষ।
ক্ষমতাসীন মন্ত্রী-নেতারা নানা বাগাড়ম্বর করলেও প্রধানমন্ত্রী সত্য আড়াল করেননি। সোজাসাপটা তা জানান দিয়েছেন। বৈশ্বিক পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত কয়েক সপ্তাহ ধরেই তার বিভিন্ন বক্তব্যে দেশে দুর্ভিক্ষের সম্ভাবনার কথা বলছেন। দুর্ভিক্ষের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেছেন, কোভিডের অভিঘাত, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও রাশিয়াকে ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্রের অবরোধ আরোপের কারণে বিশ্বজুড়ে দুর্ভিক্ষ দেখা দিতে পারে, তাই সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। বাংলাদেশে যাতে এ ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি না হয় সে জন্য এখন থেকে প্রস্তুতি নিতে হবে। বাংলাদেশ যাতে দুর্ভিক্ষের শিকার না হয় সে জন্য খাদ্য উৎপাদনের কাজে প্রতি ইঞ্চি জমি উৎপাদনের কাজে ব্যবহার করতে হবে।’
প্রশ্ন হচ্ছে- প্রধানমন্ত্রী কি নিজে থেকেই দুর্ভিক্ষের কথা বলছেন নাকি সত্যিই দুর্ভিক্ষের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে? বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক এক কর্মকর্তা বলেছেন, দুর্ভিক্ষ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন সেটি একেবারে অমূলক নয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ এরই মধ্যে খাদ্য রফতানি বন্ধ করেছে কিংবা রফতানি নিরুৎসাহিত করার জন্য শুল্ক আরোপ করেছে। সে জন্য প্রধানমন্ত্রী আগে থেকেই উৎপাদন বাড়ানোর যে কথা বলছেন সেটি বাস্তবসম্মত। কারণ, খাদ্যের জন্য আন্তর্জাতিক বাজারের ওপর নির্ভর করা ঠিক হবে না। মনে রাখতে হবে, খাদ্য সঙ্কট দেখা দিলেই দুর্ভিক্ষের মতো পরিস্থিতি হওয়ার জোরালো সম্ভাবনা তৈরি হয়।
বাংলাদেশে একবার দুর্ভিক্ষ হয়েছিল যা ১৯৭৪ সালের মার্চে শুরু হয়ে সেই বছরেরই ডিসেম্বরের দিকে গিয়ে শেষ হয়। ওই দুর্ভিক্ষে অসংখ্য মানুষ অনাহারে মারা গিয়েছিল। সরকারি হিসাব অনুসারে ২৭ হাজার মানুষ অনাহারে মৃত্যুবরণ করে। বেসরকারি হিসাবে অনুমানিক এক লাখ থেকে সাড়ে চার লাখ লোক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মৃত্যুবরণ করে। সেই সময় এই দুর্ভিক্ষকে স্মরণকালের মধ্যে সবচেয়ে ভয়ানক হিসেবে গণ্য করা হয়। আবার ওই দুর্ভিক্ষ মানবসৃষ্ট বলেও দাবি আছে। সেই সময় বাংলাদেশকে খাদ্য না দিতে মার্কিন প্রশাসনের রাজনীতিও ইতিহাসের অংশ। বাংলাদেশ তখন ছিল যুক্তরাষ্ট্রের শত্রু এবং ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের বলয়ে। কিছুটা আজকের মতো। বিশ্বে তখনো চলছিল স্নায়ুযুদ্ধ। তখন নির্দিষ্টভাবে কিউবা ও সাবেক উত্তর ভিয়েতনামের সাথে যেকোনো দেশের বাণিজ্য সম্পর্ক করার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা ছিল। তাই নতুন স্নায়ুযুদ্ধকালে পুরনো স্মৃতি কেবল স্মৃতি নয়- আতঙ্কেরও।
দুর্ভিক্ষ-দুর্যোগ-দুর্বিপাক-মহামারী কারো জন্য ভালো খবর নয়। তবে দেশে দেশে এসবকে ইস্যু করে মাঠ গরম করা, সরকারকে চিৎকাত করে ফেলার চর্চা রয়েছে। আবার এসবকে ইস্যু করে সরকারের টিকে যাওয়ার নজিরও অনেক। কিন্তু এতে সমস্যা বিদায় নেয় না, দুস্থ মানুষের বিপর্যয় রোধ করা যায় না; বরং জটিলতা আরো বাড়ে। সমস্যার রূপ বদলে নতুন নতুন আপদ চাপে। আপদের সাথে বিপদ যোগ হয়। তিয়াত্তর-চুয়াত্তরে বাংলাদেশ তা হাড়ে হাড়ে ভুগেছে। এর জেরও সয়েছে। এবার কিছুটা ওই ধরনের পরিস্থিতির সন্ধিক্ষণে মাঠের বিরোধী দল বিএনপির ‘হুঙ্কার’ ও ‘লড়কে লেঙ্গে’ ভাব। টানা প্রায় ১৪ বছর ব্যাকফুটে পড়ে থাকা দলটির গত কয়েকদিনের তৎপরতার মধ্যে নানা মাত্রা দেখা যাচ্ছে। আবার সরকারি মহল থেকেও তীর্যক কথার অবিরাম তীর। ‘দেখিয়ে দেয়া’র কড়া হুমকি দিয়ে চলছেন তারা।
অন্যদিকে ডেডলাইন ছোঁড়া হয়েছে বিএনপির মধ্যপর্যায় থেকে। বলা হয়েছে, ১০ ডিসেম্বরের পর থেকে দেশ চলবে বেগম জিয়ার কথায়। সেটি কীভাবে? শেখ হাসিনা তখন কোথায়, কী অবস্থায় থাকবেন? জবাবহীন কথা ও প্রশ্ন। এমন ডেডলাইনে নানা প্রশ্ন ও ‘উৎকট গন্ধ’। এর কাছাকাছি ঘটনা ও পরিণতির সাথে মানুষ পরিচিত। ২০০৪ সালের মার্চের ২১-২২ তারিখে ‘৩০ এপ্রিলের মধ্যে’ বিএনপি সরকারের পতনের আল্টিমেটাম দিয়েছিলেন আওয়ামী লীগের তখনকার সাধারণ সম্পাদক প্রয়াত আবদুল জলিল। তার হাতে ট্রাম্পকার্ড আছে বলেও দাবি করেছিলেন তিনি। কিন্তু কার্ডটির ধরন বলেননি। দল থেকেও তাকে এ ইস্যুতে তেমন ‘ওউন’ বা গ্রাহ্য করা হয়নি আবার একেবারে অগ্রাহ্য করাও হয়নি। এতে রাজনীতির ময়দান উত্তপ্ত হয়েছে। প্রকাশ্যে রাজপথে বেদম পিটুনিসহ ধরপাকড় ও অবশেষে রক্তারক্তি। এই ধারাবাহিকতায় চলতে চলতে এক সময় ওয়ান-ইলেভেন। রাজনীতি ও রাজনীতিকদের খোলনলচে থেঁতলে দেয়া, একই সাথে স্বীকারোক্তির ধুম।
ওই ডেডলাইন ও পরবর্তী ঘটনাপঞ্জি এখনো অনেকের কাছে দগদগে ঘায়ের মতো। জলিলের মতো ক্রেজ বা জিজ্ঞাসা আসেনি এবার আমানের বাগাড়ম্বরে। আমান নিজেও তার এ কামান দাগানোর অবস্থানে অটল নেই। এদিক-ওদিক নানা কথা বলছেন আবার অস্বীকারও করছেন না। তার দল বিএনপি থেকেও ইনিয়ে-বিনিয়ে নানা কথা হচ্ছে। বলছে না, আমান এমনটি করেই থাকেন। এ ডেডলাইন ঠিক আছে অথবা এর সাথে দলের সম্পর্ক আছে বা নেই- কোনোটাই স্পষ্ট করছে না বিএনপি। তবে মাঠের তাওয়া গরম করার চেষ্টা বাড়িয়ে চলছে। দৃশ্যত বিএনপি বেশ সরবে মাঠে অবস্থান করছে। নিয়মিত কর্মসূচি চলছে। গরম গরম কথা আছে প্রতিদিনই। গত মাসখানেকে রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ১৬-১৭টি বড় ধরনের সমাবেশ করতে পেরে বিএনপির মধ্যে উজ্জীবিত ভাব। একই সাথে ভঙ্গিও। এই ভাবভঙ্গির মধ্যে ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ ও খুলনাসহ কয়েকটি বড় সমাবেশ করেছে। অম্লমধুর কথার খই ফুটছে দুদিকেই। বিএনপির দিক থেকে ডেডলাইন ধরনের কথা আসতে থাকলে খালেদা জিয়া এভাবে মুক্ত থাকবেন না আবার জেলখানায় পাঠানো হবে, তা ভাবতে তাদের সতর্ক করে দেয়া হয়েছে সরকারি মহল থেকে।
গোটা আলামতটি দেশ, রাজনীতি, বাস্তবতার জন্য অ্যালার্মিং। গণমাধ্যমে দলটির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের বরাতে প্রকাশিত খবরের সারাংশ হচ্ছে- জ্বালানি তেলসহ নিত্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি ও পুলিশের গুলিতে দলের নেতাকর্মীদের হত্যার প্রতিবাদে চলতি বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত সব কর্মসূচি একাই পালন করবে বিএনপি। চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ ও খুলনার পর ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী সমাবেশ হবে রংপুর, বরিশাল, ফরিদপুর, সিলেট, কুমিল্লা, রাজশাহীতে ও ১০ ডিসেম্বর ঢাকায়। সেদিনই খালেদা জিয়ার কথায় দেশ চলা শুরুর ঘোষণা আমানদের। কথা ছিল, এসব কর্মসূচির ফাঁকে ফাঁকে শেষ করা হবে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে দ্বিতীয় দফার সংলাপ। এসব সংলাপে ‘যুগপৎ আন্দোলন’-এর প্রধান দাবিগুলো চূড়ান্ত করার পাশাপাশি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হবে। এরপর সরকারবিরোধী ‘যুগপৎ’ আন্দোলনের সূচনা করতে চান তারা। সেই সূচনার আগেই ১০ ডিসেম্বর সরকারের আখেরি দিন হয়ে গেলে তো আর কিছুই লাগে না; কিন্তু সেটি কীভাবে? নির্বাচন ছাড়াই?
এর বাইরেও বিএনপির আধাআধি ঘোষণার মতো কিছু কর্মসূচি আছে। মহাসমাবেশ বলা হলেও ১০ ডিসেম্বরে তারা ঢাকা অবরোধ বা ঢাকায় অবস্থান কর্মসূচির মাধ্যমে সব কিছু অচল না হলেও একটি বড় ধাক্কা দেবে। আবার জাতীয় সংসদ থেকে পদত্যাগের কথাও আলোচিত। সংসদে বিএনপির সদস্য মাত্র ছয়জন। বিএনপির কৌশলগত সিদ্ধান্ত এই ছয় এমপির পদত্যাগ। তবে সেটি কখন, কীভাবে- এ ব্যাপারে কোনো আভাস এখনো নেই। শেখ হাসিনার পতন হয়ে গেলে তাদের আর পদত্যাগের কিছু থাকে? হিসাবমতো আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বাকি আরো এক বছরেও বেশি। নির্বাচন ঘনিয়ে আসার আগে এমন উত্তেজনা, দ্রব্যমূল্য, দুর্ভিক্ষের শঙ্কা, গ্যাস-বিদ্যুৎ সঙ্কটের মধ্যে বাড়তি কোনো বিপদকে আমন্ত্রণ কি না- তা ভাবনার বিষয় হয়ে উঠেছে অনেকের কাছে।
বিশেষ করে খাদ্যসঙ্কট তথা দুর্ভিক্ষের শঙ্কা কারো একার বিষয় নয়। তবে বিষয়টি আওয়ামী লীগের জন্য স্পর্শকাতর। এ বিষয়ক ঐতিহাসিক বদনাম আছে তাদের। আবার সমসাময়িক সাফল্যও আছে। ১৯৭২-৭৫ সময়কালে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে অভাব-অনটনের ঘটনা আছে আবার এই দশকে এসে বাংলাদেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার গৌরবও আছে। করোনা মহামারী উতরে রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ, বিশ্বময় অস্থিরতার বাঁকে এসে এখন খাদ্যাভাব ক্ষমতাসীন দলটির জন্য চরম মুসিবতের মতো। সাফল্য ঢেকে পুরনো বদনাম চাড়া দিয়ে ওঠার সমূহ ঝুঁকিপূর্ণ সময় সরকারের জন্য। বিএনপি এ সময়টিকে ঝাঁকি দেয়ার জন্য বিশেষভাবে উপযুক্ত মনে করে বেছে নিয়েছে কি না, তা যৌক্তিক প্রশ্ন। দেশে খাদ্যমূল্য যদি অনেক বেড়ে যায় তখন দরিদ্র মানুষ খাবার কিনতে পারে না। ফলে লাগামছাড়া মূল্যস্ফীতি দরিদ্র মানুষের জন্য বড় ধরনের সঙ্কট তৈরি করে। দুর্ভিক্ষ-দুর্বিপাক-মহামারী কখনো সরকারি দল-বিরোধী দল চেনে না, দলমত বাছে না; ছোবল মারে সবাইকে। তবে দুর্ভিক্ষ ভাইরাসের মতো ছোঁয়াচে রোগ নয়। দুর্ভিক্ষ রোধযোগ্য। কেন দুর্ভিক্ষ হয়, হতে পারে, কীভাবে তা রোধ করা যায়- সব দৃষ্টান্তই দুনিয়ায় আছে।
রাজনৈতিক সমস্যা জিইয়ে থাকলে পরিস্থিতির ভয়াবহতা আরো তেজ পায়। তবে, বাংলাদেশে এবার বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় আমন ধানের ফলন ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অন্য দিকে বিশ্ববাজারেও খাদ্যের সঙ্কট রয়েছে। এ দুটো পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ নাজুক অবস্থায় পড়ে যাওয়াই স্বাভাবিক। সহসাই এই পরিস্থিতি কাটবে, এমন সম্ভাবনা কম। তবে, দেশে যদি উৎপাদন বাড়ানো যায় এবং দরিদ্র মানুষদের খাদ্য সহায়তা দেয়া হয় তাহলেই পরিস্থিতি সামাল দেয়া সম্ভব।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
Leave a Reply