যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সামনে এখন যেসব আইনি লড়াই রয়েছে সেগুলো বিস্তৃত এবং বেশ বৈচিত্র্যময়।
সাবেক এই প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে যেসব তদন্ত চলছে তার মধ্যে রয়েছে, গোপন নথি ব্যবহার শুরু করে তার নিউইয়র্কের পেনথাউস ফ্ল্যাটের জালিয়াতি। এছাড়াও তার বিরুদ্ধে রয়েছে অসংখ্য মামলা।
তবে চারটি গুরুত্বপূর্ণ তদন্ত ব্যক্তিগত এবং রাজনৈতিকভাবে ট্রাম্পের ওপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলতে পারে।
এই তদন্তগুলো এখনো চলছে। তবে তার বিরুদ্ধে কোনো মামলাতেই এখনো কোনো ফৌজদারি অভিযোগ গঠন করা হয়নি।
কী অভিযোগে তদন্ত চলছে?
গত বছরের ৬ জানুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রের সংসদ ভবন ক্যাপিটলে হামলার ঘটনায় ট্রাম্পের কথিত ভূমিকা নিয়ে বেশ কয়েকটি ফেডারেল সরকারি সংস্থার তদন্ত চলছে। ওই দিন তার একদল উচ্ছৃঙ্খল সমর্থক কংগ্রেসে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের নির্বাচনী বিজয়ের অনুমোদন প্রক্রিয়া বন্ধ করার লক্ষ্যে ক্যাপিটল হিলে হামলা চালায়।
এই তদন্তগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দৃশ্যমান হচ্ছে একটি কংগ্রেস কমিটির তদন্ত যেখানে ওই ঘটনাকে ঘিরে ট্রাম্পের কর্মকাণ্ড তারা খুঁটিয়ে দেখছেন। এ তদন্তের শুনানি তারা টেলিভিশনে লাইভ সম্প্রচার করছে যেখানে দেখা হচ্ছে নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে বলে তার দাবির জেরেই ক্যাপিটল হিলে দাঙ্গার ঘটনা ঘটেছে।
সর্বশেষ ক্যাপিটলে হামলার তদন্তকারী মার্কিন কমিটির শুনানিতে হাজির হওয়ার জন্য সমন জারি করা হয়েছে। এই কমিটি অভিযোগ করছে, ৬ জানুয়ারি ট্রাম্পের সমর্থকরা যে দাঙ্গা করে সেখানে তিনিই ছিলেন মূল খেলোয়াড়।
একাধিক শুনানির মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে যে সে দিনের প্রাণঘাতী সহিংসতাটি ২০২০ সালের নির্বাচনের ফলাফলকে উল্টে দেয়ার জন্য সাবেক প্রেসিডেন্টের কয়েক মাসের প্রচেষ্টার চূড়ান্ত পরিণতি ছিল। তিনি বিদ্রোহকে সমর্থন করেন ও এতে উস্কানি দেন।
ট্রাম্পের বিরুদ্ধে আরেকটি অভিযোগ হলো- ৬ জানুয়ারিতে মার্কিন বিচার বিভাগের ফৌজদারি তদন্ত এবং নির্বাচনের ফলাফল বাতিলের প্রচেষ্টা। তবে এই তদন্তটি বেশ গোপনীয়ভাবে চালানো হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে এটি বৃহত্তম পুলিশি তদন্ত। কিন্তু ট্রাম্প নিজে এই তদন্তের কতটা লক্ষ্যবস্তু, তা স্পষ্ট নয়।
কী বলেছেন ট্রাম্প?
তিনি ওই দাঙ্গার দায় অস্বীকার করেন এবং কংগ্রেশনাল কমিটির সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, এটি একটি ক্যাঙ্গারু কোর্ট বা প্রহসনের আদালত যেটি পরিচালিত হচ্ছে অনির্বাচিত ছদ্ম-কমিটির মাধ্যমে।
নির্বাচনে ব্যাপক ভোটার জালিয়াতি হয়েছে বলে কোনো প্রমাণ ছাড়াই তিনি আগে যে অভিযোগ করেন, সেটা তিনি এখনো চালিয়ে যাচ্ছেন।
অভিযোগ কতটা গুরুতর?
কংগ্রেশনাল কমিটিতে আছে সাতজন ডেমোক্র্যাট ও দু’জন রিপাবলিকান। এই কমিটির বিচার করার ক্ষমতা নেই। তবে এটি ট্রাম্পকে ‘সাপিনা’ করার পক্ষে ভোট দিয়েছে।
এর মানে হলো, তিনি আইনগতভাবে কংগ্রেসে সাক্ষ্য দিতে বাধ্য হবেন। তবে মনে করা হচ্ছে, তিনি এই সমনকে উপেক্ষা করবেন এবং এটি একটি দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের দিকে যাবে।
এই কমিটি আরো বিবেচনা করছে যে ট্রাম্পকে অভিযুক্ত করার সুপারিশ করে একটি ফৌজদারি রেফারেল বিচার বিভাগে পাঠানো হবে কিনা। পদক্ষেপ হিসেবে এটা তেমন বড় কিছু না, তবে এতে তদন্তকারীদের ওপর চাপ বাড়তে পারে।
বিচার বিভাগের ফৌজদারি তদন্তের ফলে যারা ক্যাপিটলে হামলা চালায় এরকম শত শত লোকের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে অভিযোগ করা হয়েছে।
সেই তদন্তে ট্রাম্পকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডাকা হয়নি। তবে এটি একটি সম্ভাবনা হিসেবে রয়ে গেছে। তাত্ত্বিকভাবে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করা যেতে পারে। যদি তদন্তকারীরা বিশ্বাস করেন তার অপরাধের যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে।
কী নিয়ে তদন্ত হচ্ছে?
মার্কিন বিচার বিভাগ হোয়াইট হাউস থেকে সরকারি গোপন নথিপত্র সরিয়ে নেয়ার ঘটনাটি তদন্ত করে দেখছে। প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব ছাড়ার পর এগুলো ফ্লোরিডার মার-এ-লাগোতে ট্রাম্পের বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়। তদন্তকারীরা এখন দেখছেন, এই নথিগুলো কীভাবে সেখানে সংরক্ষণ করা হয় এবং কে কে এগুলো দেখতে পেয়েছে।
গত অগাস্ট মাসে ফ্লোরিডা সৈকতের পাশে সাবেক প্রেসিডেন্টের বিশাল ভিলায় তল্লাশি অভিযান চালানো হয়। সেখান থেকে ১১ হাজার নথি জব্দ করা হয়। এর মধ্যে ১০০টি দলিল গোপন বলে চিহ্নিত করা ছিল। কয়েকটিকে টপ সিক্রেট বা অত্যন্ত গোপনীয় বলে লেবেল লাগানো ছিল।
এটি মোটেও অবাক হওয়ার মতো বিষয় নয় যে এই পর্যায়ে এসব নথিতে কী আছে সে সম্পর্কে আমরা খুব কমই জানি। কিন্তু গোপনীয় বা অত্যন্ত গোপনীয় দলিলে সাধারণত এমন সব তথ্য থাকে যা প্রকাশিত হলে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষতি হতে পারে।
কী বলেছেন ট্রাম্প?
তিনি এই অভিযোগ অস্বীকার করেন ও বিচার বিভাগের তদন্তের সমালোচনা করে বলেন, এটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং হয়রানি।
নিজের সাফাই করে তিনি বলেন, এসব দলিল থেকে আগেই তিনি গোপনীয়তার লেবেল অপসারণ করেন। তবে এটি যে সত্য তার স্বপক্ষে এখনো কোনো প্রমাণ মেলেনি।
ট্রাম্প আরো যুক্তি দেন যে কিছু দলিল প্রিভিলেজ অধিকারে সুরক্ষিত। এটি একটি আইনি শব্দ যার অর্থ ভবিষ্যতে কোনো মামলা হলে এসব দলিল আদালতের সামনে উপস্থাপন করা যাবে না। একজন স্বাধীন আইনজীবী এখন এসব জব্দ করা দলিলপত্র পর্যালোচনা করে দেখেন এবং সেই প্রক্রিয়াটি এখনো চলছে।
কিন্তু প্রধান যে প্রশ্ন এসব নথি কেন মার-এ-লাগোতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল সে বিষয়ে এই সাবেক প্রেসিডেন্ট সরাসরি কোনো জবাব দেননি।
তাহলে অভিযোগ কতটা গুরুতর?
এটি এমন একটি ফৌজদারি তদন্ত যার জেরে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হতে পারে।
অন্য আইনের মধ্যে, মার্কিন বিচার বিভাগ মনে করছে যে ক্ষমতা ত্যাগের পরও জাতীয় নিরাপত্তা সংক্রান্ত তথ্য, যা বেহাত হলে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষতি পারে এসব তথ্য নিজের হাতে রেখে ট্রাম্প মার্কিন গুপ্তচরবৃত্তি আইন লঙ্ঘন করেছেন।
গোপন দলিলপত্র সম্পর্কিত অভিযোগগুলোর পাশাপাশি সরকারি কৌসলিরা ট্রাম্পের বিরুদ্ধে আরেক অপরাধ বিবেচনা করছেন।
এই তদন্তকে ঘিরে ট্রাম্পের আইনজীবীরা এখনো বিচার বিভাগের সাথে আইনি লড়াই চালাচ্ছেন।
কী তদন্ত করা হচ্ছে?
নিউইয়র্কের প্রসিকিউটররা সাবেক প্রেসিডেন্টের পারিবারিক সংস্থা ট্রাম্প অর্গানাইজেশনের ওপর তদন্ত করেন। নিউইয়র্কে দু’টি তদন্ত চলছে- একটি দেওয়ানি ও অন্যটি ফৌজদারি।
নিউইয়র্কের অ্যাটর্নি জেনারেল লেটিশিয়া জেমস দেওয়ানি তদন্তের নেতৃত্ব দিচ্ছেন এবং কোম্পানিটি গত কয়েক দশক ধরে নানা ধরনের প্রতারণার সাথে জড়িত কিনা তা নিয়ে প্রায় তিন বছর ধরে তদন্ত চালাচ্ছেন।
এসবের মধ্যে রয়েছে গলফ কোর্স এবং হোটেলের মতো রিয়েল এস্টেটের মূল্য বাড়িয়ে দেখানোর কথিত অভিযোগ। যাতে আরো সুবিধাজনক ঋণ এবং আরো ভালো কর সুবিধা পাওয়া যায়।
ইতোমধ্যে বছরের পর বছর ধরে চলা ফৌজদারি তদন্ত চালানো হচ্ছে ম্যানহাটন ডিসট্রিক্টের অ্যাটর্নি অ্যালভিন ব্র্যাগের নেতৃত্বে এবং নিউইয়র্ক সিটির তদন্তের সাথে সম্পর্কিত বলে তারা একই বিষয়ে তদন্ত করছে।
এ নিয়ে কী বলছেন ট্রাম্প?
ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং তার আইনজীবীরা বলেন, তাদের কোম্পানি কোনো অবৈধ কাজ করেনি।
লেটিশিয়া জেমস, যিনি একজন ডেমোক্র্যাট। তার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার অভিযোগ করেন এই বলে যে অ্যাটর্নি জেনারেল নির্বাচিত হওয়ার আগে তিনি নাকি মন্তব্য করেন, তিনি ট্রাম্পের বিরুদ্ধে মামলা করবেন এবং তাকে অবৈধ রাষ্ট্রপতি হিসেবে চিহ্নিত করবেন।
তাহলে এসব অভিযোগ কতটা গুরুতর?
জেমস সেপ্টেম্বরে একটি জালিয়াতির মামলা করেন, যার ফলে তাত্ত্বিকভাবে ট্রাম্প অর্গানাইজেশনের অস্তিত্ব বর্তমান আকারে বন্ধ হতে পারে।
তিনি বলেন, সাবেক রাষ্ট্রপতি তার তিন বড় সন্তান ও কোম্পানির দু’জন নির্বাহী ২০১১ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে অসংখ্য জালিয়াতি করেছেন।
মামলায় অভিযোগ করা হয়, এই পরিবার তাদের নেট মূল্য বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বাড়িয়ে দেখিয়েছে। সরকারি কৌঁসুলিরা এখন প্রতারণা করে পাওয়া ২৫০ মিলিয়ন ডলার ফেরত চাইছেন। মামলায় বিভিন্ন জরিমানাও দাবি করা হয়েছে। যেমন, নিউইয়র্কের যেকোনো ব্যবসায় নেতৃত্বের ভূমিকা পালনে ট্রাম্প এবং তার সন্তানদের ওপর নিষেধাজ্ঞা।
ট্রাম্প পরিবারের বিরুদ্ধে ফৌজদারি তদন্ত এখন কিছুটা নীরব। তবে জেমস তার তদন্তের প্রতিবেদন ফেডারেল প্রসিকিউটরদের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে যাকে কেন্দ্র করে একটি নতুন তদন্ত শুরু করতে পারে।
কী তদন্ত করা হচ্ছে?
জর্জিয়া অঙ্গরাজ্যের সরকারি কৌঁসুলিরা ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফলাফলকে উল্টে দেয়ার অভিযোগ সম্পর্কে অনুসন্ধান করছেন।
গত বছরের ২ জানুয়ারি ট্রাম্প ও ওই রাজ্যের একজন শীর্ষ নির্বাচনী কর্মকর্তার মধ্যে এক ঘণ্টা দীর্ঘ এক টেলিফোন আলাপের কথা ফাঁস হওয়ার পর এ নিয়ে ফৌজদারি তদন্ত শুরু হয়।
সেই ফোন কলে রিপাবলিকান সেক্রেটারি অফ স্টেট ব্র্যাড রাফেনস্পারগারের প্রতি ট্রাম্পকে বলতে শোনা যায়, ‘আমি শুধু ১১ হাজার ৭৮০ ভোট খুঁজে পেতে চাই।’ নির্বাচনে ওই সুইং স্টেটে বিজয়ের জন্য তার জন্য এই সংখ্যক ব্যালট প্রয়োজন ছিল।
কী বলেছেন ট্রাম্প?
তার বিরুদ্ধে অন্য তদন্তের মতোই ট্রাম্প এই তদন্তকেও হয়রানিমূলক বলে বর্ণনা করেছেন।
ওই তদন্তের নেতৃত্বদানকারী আইন কর্মকর্তা ফুলটন কাউন্টির প্রধান প্রসিকিউটর ফানি উইলিসকে আক্রমণ করে বলেন, তিনি একজন তরুণ, উচ্চাভিলাষী, উগ্র বামপন্থী ডেমোক্র্যাট। যিনি সবচেয়ে অপরাধপ্রবণ ও দুর্নীতিগ্রস্ত জায়গার একটির নেতা।’
অভিযোগ তাহলে কতটা গুরুতর?
উইলিস গত মাসে ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকায় এক সাক্ষাৎকারে বলেন ‘অভিযোগগুলো খুবই গুরুতর। অভিযোগ প্রমাণিত হলে এবং দোষী সাব্যস্ত হলে অভিযুক্তদের জেলে যেতে হবে।’
তিনি এর সাথে যোগ করেন, অভিযুক্তের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত আসন্ন নয়। কিন্তু ট্রাম্পকে শিগগিরই আদালতে সাক্ষ্য দেয়ার জন্য সমন পাঠানো হতে পারে।
কিন্তু এই ঘটনায় ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে সরাসরি কোনো তদন্ত হচ্ছে কিনা তা জানা না গেলেও, তার সহযোগীদের মধ্যে কারো কারো বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে বলে জানা যাচ্ছে।
এদের একজন হলেন ট্রাম্পের সাবেক ব্যক্তিগত আইনজীবী রুডি জুলিয়ানি। যিনি নির্বাচনের ফলাফলকে বিতর্কিত করার জন্য আইনি চ্যালেঞ্জের নেতৃত্ব দেন। জুলিয়ানির আইনজীবী বলেন, তাদের মক্কেল কোনো বেআইনি কাজ করেননি।
খবর পাওয়া যাচ্ছে যে তদন্তকারীরা জর্জিয়ার কর্মকর্তাদের কাছে করা টেলিফোন কলে কোনো অপরাধমূলক কাজ হয়েছে কিনা তা যাচাই করে দেখছেন। একই সাথে সেখানকার রাজনীতিবিদদের কাছে দেয়া মিথ্যে বিবৃতিগুলোও তারা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন।
তবে ফৌজদারি মামলায় দোষী প্রমাণের জন্য সরকারি কৌঁসুলিদের শেষ পর্যন্ত যুক্তিসঙ্গত সন্দেহের অতীত প্রমাণ জোগাড় করতে হবে এবং দেখাতে হবে যে অভিযুক্তরা জানতো তাদের কাজগুলো ছিল প্রতারণামূলক।
সূত্র : বিবিসি
Leave a Reply