হিজাব শুধু কোনো একটা পোশাকের নাম নয়, হিজাব একটি দর্শনের নাম। হেফজ, হাফেজ, হিফাজত ও হিজাব, হেফজুন একই আরবি শব্দের ভিন্ন ভিন্ন রূপ। এর মূল শব্দ হেফজ, যার অর্থ কোনো কিছুকে সংরক্ষণ করা বা সুরক্ষিত করা। কোনো কিছুকে সংরক্ষণ করাকে, আমরা বলি- তা হিফাজত করা, আবার কোনো কিছুকে হিফাজত করা মানে হচ্ছে- কোনো কিছুকে সুরক্ষিত করা। ঠিক হিজাব অর্থও নিজেকে সুরক্ষিত করা। একজন নারীকে যেমন সুরক্ষিত করার প্রয়োজন হয়, ঠিক একজন পুরুষকেও সুরক্ষিত করার প্রয়োজন হয়। প্রশ্ন হলো- হিজাব কি শুধু নারীদের জন্য, পুরুষদের হিজাব করার প্রয়োজন নেই? নারীরা শুধু সুরক্ষিত থাকবে, আর পুরুষরা অরক্ষিত থাকবে, তা কি হয়? ইসলামে নারী ও পুরুষ উভয়ের সুরক্ষিত থাকার ব্যাপার হলো হিজাব। এর মানে হিজাব নারী-পুরুষ উভয়কেই করতে হয় নিজেদের সুরক্ষার জন্য। কুরআনে বলা হয়েছে- ‘(হে নবী!) মুমিন পুরুষ ও নারীদের বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে সংযত রাখে ও তাদের লজ্জাস্থানের হিফাজত করে (সূরা নূর : ৩০-৩১)।
তাহলে বোঝাই যাচ্ছে, হিফাজত বা সুরক্ষিতকরণের ব্যাপারটি নারী ও পুরুষ উভয়ের জন্য। ব্যাপারটি বোঝাই যাচ্ছে, হিজাব নারী ও পুরুষ উভয়ের সুরক্ষিত রাখার এক বিশেষ ব্যবস্থা ও বিধান। তারপর প্রশ্ন হলো- হিজাব কি চাপিয়ে দেয়া কোনো বিষয়? হিজাবকে যদি কেউ চাপিয়ে দেয়া কোনো বিষয় বলে, তাহলে এটিও একটি প্রশ্ন যে, প্রত্যেকের নিজেকে সুরক্ষিত রাখার ব্যাপারটিও চাপিয়ে দেয়া? কিন্তু না, সুরক্ষিত রাখার ব্যাপারটিও চাপিয়ে দেয়া নয়, এটি যার যার স্বতঃস্ফূর্ত ব্যাপার।
একজন সচেতন মানুষ যেমন স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজেকে সুরক্ষিত করতে চায়, হিজাবের ব্যাপারটিও তাই ব্যক্তির স্বতঃস্ফূর্ত, নিজেকে সুরক্ষিত রাখার ব্যাপারটি যেমন স্বতঃস্ফূর্ত। তাই হিজাব বা সুরক্ষিতকরণ ব্যাপারটি কোনো চাপিয়ে দেয়া বিষয় নয়। এটি স্বতঃস্ফূর্ত গ্রহণ ও বর্জনের বিষয়।
যাই হোক, এবার হিজাবের দর্শন নিয়ে আলোচনা করা যাক, হিজাব হচ্ছে নিজেকে সুরক্ষিতকরণের ঢাল। প্রথমত, পোশাক এই হিজাব নামক ঢালের একটি শাখা মাত্র।
প্রশ্ন হলো- মানুষের সুরক্ষা কখন দরকার? কারণ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ও সময়ে বিপদ বা ঝুঁঁকি থাকতে পারে। এর মানে সুরক্ষার প্রয়োজনীয়তার ব্যাপারটির সাথে রিস্ক বা ক্ষতিকর কোনো বিষয় জড়িত। যদি ঝুঁঁকি কিংবা ক্ষতিকর কোনো ব্যাপার না থাকে তাহলে সুরক্ষার প্রয়োজন হয় না। তাই হিজাব মেনটেইন করা মানে হচ্ছে নিজেকে যেকোনো প্রকার ঝুঁঁকি কিংবা কোনো ক্ষতিকর উপাদান থেকে নিরাপদ করা। এখন আমাদের শনাক্ত করতে হবে ঝুঁকি ও ক্ষতিকর উপাদানগুলো কি কি?
প্রবৃত্তির ঝুঁঁকি থেকে সুরক্ষা : দেহের দাবিকে প্রবৃত্তি বলে। মানুষের প্রবৃত্তির চাহিদা অসীম হতে পারে, অসীম হলেই, তাই জীবন পর্যন্ত ঝুঁঁকিতে পড়ে, যেমন বিবাহিত স্ত্রী থাকার পরও পরকীয়া প্রেম ব্যক্তির জীবন ও সাথে তার পরিবারের জীবনও ঝুঁকিতে পড়ে। শুধু তাই নয়, প্রবৃত্তিকে অনেক সময় ইলাহের স্থলে স্থান দেয় (আল-কুরআন : ২৫-৪৩) এই পয়েন্টেই মানুষ প্রবৃত্তির তাড়নায় ধর্ষণ করে খুন পর্যন্ত করে ফেলে, অন্য দিকে ব্যভিচার রোধের প্রতিরোধ ঢাল হলো বিয়ে। প্রবৃত্তির এসব ঝুঁঁকি থেকে মানুষকে সুরক্ষা দেবে বিয়ে, পোশাকের হিজাব ও মানুষের বিচারবুদ্ধি। আবার বিচারবুদ্ধি মানুষের প্রবৃত্তি নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে প্রবৃত্তির ঝুঁঁকিকে নিয়ন্ত্রণ করবে। তাহলে বিয়ে, পোশাক ও বিচারবুদ্ধি প্রয়োগ প্রত্যেকটিই হিজাবের অংশ।
আবেগের ঝুঁঁকি থেকে সুরক্ষা : আবেগ মানুষের সহজাত ও স্বতঃস্ফূর্ত অনুভূতি, যা মানুষের সচেতন উদ্যম থেকে আসে না, যেমন- খেয়ালখুশি, সুখানুভূতি, ভালোবাসা, স্নেহ, রাগ, ক্ষোভ, হিংসা, বিদ্বেষ ও অহঙ্কার ইত্যাদি। আবেগের এই বৈশিষ্ট্যগুলো ইতিবাচক কিংবা নেতিবাচক দিকে প্রবাহিত হতে পারে। আবেগ নেতিবাচক দিকে প্রবাহিত হলে অনেক ধরনের ঝুঁঁকি তৈরি হয়, যেমন- রাগের মাথায় কাউকে খুন করে ফেলা, ব্যক্তিগত রেষারেষির কারণে কারো প্রতি প্রচণ্ড ক্ষোভ ও ঘৃণা পোষণ করা, প্রতিবেশীর উন্নতি দেখে হিংসা পোষণ করা। এসব ঝুঁঁকি মোকাবেলার সুরক্ষাবেষ্টনী হিসেবে কাজ করে মানুষের বুদ্ধিবৃত্তি ও বিচারবুদ্ধি। অনর্থক কাজে লিপ্ত থাকা এটি আবেগি কাজ। এ থেকেও ঝুঁঁকি আসে, যেমন- যে ছেলেটি অনর্থক কাজে সময় নষ্ট করে বেলাশেষে, তার চরিত্র, কর্ম ও ক্যারিয়ার ঝুঁকির মধ্যে পড়ে। এ জন্য আবেগপ্রবণ হওয়ার চেয়ে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিতে কুরআন বলেছে- যদি আমরা বিবেক বুদ্ধির প্রয়োগ করতাম, তাহলে আমরা বিপথগামী হতাম না (৬৭ : ১০)। এর মানে বিবেক বুদ্ধির প্রয়োগ না করলে, মানুষের বিপথগামী হওয়ার ঝুঁঁকি থাকে। এ জন্য এই ঝুঁকি থেকে সুরক্ষার উৎকৃষ্ট ঢাল হচ্ছে- বিবেক বুদ্ধির প্রয়োগ। এটিই আবেগের হিজাব।
আচরণগত ঝুঁকি থেকে সুরক্ষা : আচরণের সুরক্ষা দেয়াই হচ্ছে আচরণগত হিজাব। কুরআনে নারীদের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে- তারা যেন তাদের সৌন্দর্য ও সাজসজ্জা প্রকাশের জন্য জোরে চলাফেরা না করে (২৪ : ৩১)। এর মানে কেউ যদি চালচলনে আচার-আচরণে শালীন পোশাক পরার পরেও নিজের সৌন্দর্য ও সাজসজ্জা পুরুষকে দেখানোর প্রবণতা থাকে, তবে সেটি নিজেকে সুরক্ষিতকরণের মধ্যে পড়বে না। এর মানে এটি হিজাব হবে না। কেননা, তার আচার-আচরণে নিজের সৌন্দর্য দিয়ে অন্য মানুষকে আকৃষ্ট করার প্রবণতা রয়েছে, এ থেকেই প্রেম, পরকীয়া, ধর্ষণের মতো ঝুঁঁকিগুলো আসতে পারে। তাই আত্মপ্রদর্শনের প্রবণতা নিজের সুরক্ষার পথে বাধা সৃষ্টি করে। নবী লোকমান আ: তাঁর পুত্রকে শিক্ষা দিয়েছেন- তুমি অহঙ্কারবশে কাউকে অবজ্ঞা করবে না, বিনয়ের সাথে চলাফেরা করবে, পথ চলবে সংযতভাবে, নিচু কণ্ঠস্বরে কথা বলবে। এই সব শিক্ষা আচরণগত হিজাবের শিক্ষা (৩১ : ১৭-১৯)। যেন নবীর সন্তান সুন্দর অমায়িক আচরণে সুরক্ষিত থাকে। এরপর কুরআনে বলা হয়েছে- কাউকে দান করে খোটা দেয়ার চেয়ে দান না করে, তার সাথে সুন্দর আচরণ করো (২ : ২৬৩)।
ইসলাম মানুষকে আত্মমর্যাদাসম্পন্ন জীব হিসেবে সম্মান দেয়। সুতরাং দান করে খোটা দিলে দানপ্রাপ্ত ব্যক্তি আত্মসম্মানে আঘাতপ্রাপ্ত হয়। ফলে কারো আত্মসম্মানে আঘাত করা, এটি সুন্দর আচরণ নয়। তাই মানুষের আচরণের সুরক্ষার জন্য বলা হয়েছে, দান করে খোটা দেয়ার চেয়ে, দান না করে তার সাথে সুন্দর আচরণ করতে। আজকে মানুষে মানুষের সম্পর্কের মধ্যে যে সমস্যাগুলো হয়, তার বেশির ভাগই আচরণগত সমস্যা। তাই আচার-আচরণে রূঢ় হওয়া, আচরণে কাউকে কষ্ট দেয়া, কারো সম্মানহানি করা ইত্যাদি। এসব সমস্যা থেকে সুরক্ষার জন্য আচরণগত হিজাব অপরিহার্য। আর আচরণগত হিজাবের অংশ হচ্ছে- কুরআনের শিক্ষায় সুশিক্ষা ও নিজের বিচারবুদ্ধির বিকাশ এবং প্রয়োগ।
আত্মিক ঝুঁঁকি থেকে সুরক্ষা : সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো- আত্মিক ঝুঁঁকি থেকে সুরক্ষা। মানুষের চালিকাশক্তি হচ্ছে তার আত্মা। আত্মার কোয়ালিটি দিয়ে নির্ধারিত হয় মানুষের চিন্তা ও কর্ম। আত্মার অবস্থা পরিচ্ছন্ন ও ইতিবাচক হলে মানুষের চিন্তা, ধ্যান-ধারণা ও কর্ম নিজের এবং সমাজের মানুষের জন্য কল্যাণকর হবে। বিপরীতে আত্মা কলুষিত হলে চিন্তা, ধ্যান-ধারণা কুসংস্কারাচ্ছন্ন হয়, এমনকি তার কর্মও মানুষের জন্য ধ্বংসাত্মক। এ পরিস্থিতিতে আত্মাকে পবিত্র ও পরিচ্ছন্নভাবে সুরক্ষিত রাখতে যে ঢাল দরকার হয় সেটি হচ্ছে ঈমান ও বিচারবুদ্ধির প্রয়োগ। বিচারবুদ্ধি মানুষকে ন্যায় ও অন্যায়ের পথ দেখায়, ফলে ব্যক্তির আত্মায় অন্যায় প্রবেশের পথে ঢাল হিসেবে বাধা তৈরি করে তার বিচারবুদ্ধি। তাকওয়া হচ্ছে আত্মার উত্তম হিজাব। তাই তাকওয়া, ঈমান ও বিচারবুদ্ধির চর্চা হচ্ছে আত্মার হিজাব।
প্রিয় পাঠক, তাহলে হিজাব মানে শুধু পোশাক নয়; হিজাব একটি কম্প্রিহেন্সিভ বিষয়। আরবি লেবাস শব্দ যার অর্থ হচ্ছে- শরীর আবরণের পোশাক, সচরাচর যেসব শালীন পোশাক আমরা পরিধান করি। আবার জালাবিব বা জিলবাব হচ্ছে চাদর, আবায়া হচ্ছে এটিও চাদর জাতীয় পোশাক। মানুষের শরীরকে ঢেকে রাখতে ব্যবহৃত হয়। লেবাস জিলবাব, আবায়া আর হিজাব একেবারেই ভিন্ন বিষয়, আমরা তা বুঝতে পারলাম।
লেখক : কলেজ শিক্ষক ও ইসলামিক গবেষক
Leave a Reply