একজন নারী- সে কখনো জননী, ভগ্নী, জীবনসঙ্গিনী, কন্যা। ইসলামে নারীসম্রাজ্ঞী, বীরাঙ্গনা, লাবণ্যময়ী মুসলিমাহ। প্রায় দেড় হাজার বছর আগে নারীর সম্মান ও ন্যায়সঙ্গত অধিকারের সার্টিফিকেট আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাঁর হাবিব রাসূল সা:-এর মাধ্যমে বিশ্বময় জানিয়ে দিয়েছেন। মুসলিমাহ হিসেবে তাই তুমি সৌভাগ্যবান! অথচ দুনিয়ার মোহে পড়ে নারী তার সম্মান, অধিকারের স্বচ্ছ পাতাটাকে কলুষিত করছে।
প্রাক-ইসলামী যুগে উন্নত সভ্যতার তকমাধারী সভ্যতাগুলোতে নারীর সম্মান কেমন ছিল? ব্যবিলনীয় সভ্যতায় নারীর কোনো আইনি অধিকার স্বীকৃত ছিল না। তখন নারীর মূল্য, মর্যাদা ছিল এমন, যদি কোনো পুরুষ ঘটনাক্রমে কোনো নারীকে হত্যা করত তবে তাকে শাস্তি প্রদানের পরিবর্তে তার স্ত্রীকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হতো।
গ্রিক সভ্যতা পূর্বকালের সব সভ্যতার মধ্যে শ্রেষ্ঠতম ও উজ্জ্বলতম বলে গণ্য করা হয় গ্রিক সভ্যতাকে। তথাকথিত এই উজ্জ্বল সভ্যতায় নারী ছিল সব রকমের অধিকার থেকে বঞ্চিত। উপরন্তু অস্তিত্বগতভাবে অত্যন্ত নিকৃষ্ট বলে পরিগণিত হতো। এ কারণে নারীদের ঘৃণার চোখে দেখা হতো তখন। গ্রিক পৌরাণিক শাস্ত্রের এক কাল্পনিক নারী চরিত্র ‘প্যানডোরা’। যাকে বিশ্ব মানবতার সব দুর্ভোগের মূল কারণ বলা হতো সেই নারীকে। এ কারণে গ্রিকরা নারীদের ‘মানুষের মতো বটে কিন্তু সম্পূর্ণ মানুষ নয়’ (প্রায় মানুষ) মনে করত।
রোমান সভ্যতার বিকাশের শিখা যখন তুঙ্গে তখন একজন পুরুষ যেকোনো সময় তার স্ত্রীকে হত্যা করার অধিকার রাখত এবং নগ্ন নারী যেকোনো আসরের সৌন্দর্য ছিল। বেশ্যালয়ে গমন ছিল পুরুষের সংস্কৃতি। মিসরীয় সভ্যতায় নারীকে ‘ডাইনি’ এবং শয়তানের নিদর্শন হিসেবে গণ্য করা হতো।
ইসলামের আবির্ভাবের প্রাক্কালে আরবে নারীর অবস্থান ছিল ঘরের অন্যান্য ব্যবহার্য আসবাবের মতো। আর অনেক পিতা কন্যাসন্তানকে অসম্মানের কারণ হিসেবে জীবন্ত কবর দিত। কতটা বেদনাদায়ক এই বর্বরোচিত সভ্যতা ইতিহাসে তা ফুটিয়ে তোলা দুঃসাধ্য!
ইসলাম নারীকে সম্মানের উচ্চাসনে আসীন করেছে ন্যায়সঙ্গতভাবে। ইসলাম এ প্রত্যাশা করে নারী তার সম্মান মর্যাদা ধরে রাখবে আল্লাহর হুকুমতের ওপর। নারী ‘কন্যা’ হিসেবে কেমন মর্যাদাপ্রাপ্য এ ব্যাপারে বর্ণিত আছে-
উকবা ইবনে আমর রা: বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সা:-কে বলতে শুনেছি, যার তিনটি কন্যাসন্তান আছে এবং সে তাদের ব্যাপারে ধৈর্যধারণ করে এবং তাদের যথাসাধ্য উত্তম পোশাকাদি দেয়, তারা তার জন্য দোজখ থেকে রক্ষাকারী প্রতিবন্ধক হবে (আবু দাউদ, ইবনে মাজাহ)।
তা ছাড়া রাসূল সা: বলেছেন, ‘তোমরা মেয়েদের পিতাকে গালি দিও না। যে এরূপ করল সে যেন আমায় গালি দিলো।’
ইসলাম বলে, নারী যখন ‘মা’ তখন তার পায়ের নিচে সন্তানের জান্নাত। নারী যখন ‘কন্যা’ সে আল্লাহর রহমত। নারী যখন ‘স্ত্রী’ তখন সে স্বামীর আচ্ছাদন। ইসলামের সৌন্দর্য বর্ধনে নারীর প্রতি স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গি বিশেষ ভূমিকা রাখে।
সভ্যতা, সংস্কৃতির ইতিহাসে অবহেলিত নারীর পাশে সর্বপ্রথম ইসলাম দাঁড়িয়েছে। ইসলামকে অলঙ্কৃত করে সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণকারী নারী। মুসলিমাদের আদর্শের মুকুট নবীহৃদয়ের সম্রাজ্ঞী উম্মাহাতুল মুমিনিন খাদিজাতুল কুবরা রা:। সর্বপ্রথম ইসলামের জন্য শহীদ হয়েছেন তিনিও নারী। আম্মার ইবনে ইয়াসার রা:-এর জননী সুমাইয়া রা:। যারা বলে, ইসলাম নারীকে সঙ্কীর্ণতায় রেখেছে তাদের বলতে চাই, ইতিহাস গবেষণায় দেখা যায়- অন্দর ও বাইরে পূর্ণাঙ্গ ইসলামী পদ্ধতিতে জীবনযাপন করেও মুসলিম নারীরা জ্ঞান-বিজ্ঞান, সমর ক্ষেত্রে অনুপম উজ্জ্বল কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে গেছেন কালের সোনালি পাতায়। তাদের তালিকাও সুদীর্ঘ।
আয়েশা রা:- হাদিস বর্ণনা, ইসলামী আইন, ফিকহ, ইতিহাস, বংশতালিকা, কবিতা ও চিকিৎসাবিজ্ঞানে পারদর্শী ছিলেন। আসমা বিনতে আবু বকর রা: ও উম্মে আবিদুল্লাহ বিন জুবায়ের- তাঁরা উভয়ই হাদিস বর্ণনায় দক্ষ ও পারদর্শী ছিলেন।
আয়েশা বিনতে ত্বালহা- তিনি কবিতা, সাহিত্য, জ্যোতিষশাস্ত্র ও নভোমণ্ডল বিষয়ে অত্যন্ত পারঙ্গমতার পরিচয় দিয়েছিলেন। সাকিনা বিনতে হুসাইন ও খানসা- তাঁরা কাব্য ও সাহিত্যে প্রবাদতুল্য ছিলেন।
মায়মুনা বিনতে সাদ রা: হাদিসশাস্ত্রে পারদর্শী ছিলেন। ওমর রা:ও তাঁর থেকে হাদিস বর্ণনা করেছেন। কারিমা মারজিয়া রহ: হাদিসে বিজ্ঞ পণ্ডিত ছিলেন। ইমাম বুখারি রহ:ও যাঁর থেকে হাদিস সংগ্রহ করেছেন।
ফাতিমা বিনতে আব্বাস- প্রখ্যাত ইসলামী আইনবিদ। তিনি মিসর ও দামেস্কের প্রভাবশালী নেত্রী ছিলেন। উখত মজনি রহ: ছিলেন ইমাম শাফেয়ি রহ:-এর শিক্ষক। হুযায়মা বিনতে হায়ই রহ: প্রখ্যাত তাবেয়ি ও হাদিসবিদ। আয়েশা বিনতে আহমদ স্পেনের অধিবাসী ক্যালিগ্রাফিতে অনন্যতার পরিচয় দিয়েছেন।
ফাতিমা বিনতে আলী বিন হোসাইন বিন হামজাহ ছিলেন হাম্বলি মাজহাবের পণ্ডিত। সমসাময়িক আলেমরা তাঁর থেকে হাদিস শিখেছেন এবং প্রসিদ্ধ হাদিসগ্রন্থ দারেমি শরিফের সনদের অনুমতি নিয়েছেন (সূত্র তাবাকাতে ইবনে সাদ : ৮/৪৫-৪৮; দালায়িলন-নবুয়্যাহ : ৫/৪১৬; ইবনে আসির : ৫/৪৫০; আল-বেদায়া-ওয়ানা-নেহায়া : ৫/৭৮)।
এ ছাড়া ইবনে কায়েসের বর্ণনায় দেখা যায়, প্রায় ১২ জন নারী সাহাবি ফতোয়া ও ইসলামী আইনশাস্ত্রে খ্যাতি অর্জন করেন। তাঁদের মধ্যে সাতজন ‘উম্মাহ তুল মুমিমিন’ বা নবীপতœীগণ ছিলেন।
ইতিহাস অলঙ্কৃত, রওশান সমুজ্জ্বলকারী ক্ষমতা বিস্তৃতির অনুপম সৌন্দর্য তো মুসলিমারা রেখেছেন। আমাদের নতুন করে জানা উচিত, বোঝা উচিত। শুধু নিজের জন্য নয়, আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য। তবেই ভবিষ্যৎ প্রাণগুলো পাবে সুন্দর সজীব এক পৃথিবী।
কালের করাল ঘর্ষণে সুন্দর সমাজ কর্তিত, পৃথিবী আক্রান্ত। শুধু পুরুষরা সৈনিক নয়, নারীরাও এক একজন সৈনিক নিজ নিজ অবস্থান থেকে। পর্দার অন্তরালে থেকে আমাদের পূর্বসূরি নারীগণ রেখে গেছেন আদর্শের ছাপ। দ্বীনিজ্ঞান, উন্নত শিক্ষা, জীবনাচার-কর্মে নারীরাও সমুজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন আমাদের জন্য। তখন জ্ঞান অর্জন ছিল কষ্টসাধ্য। ছিল না এত আধুনিক ব্যবস্থা। সহজলভ্য ছিল না কিছুই। যারা মিথ্যা প্রপাগান্ডা চালায় এই বলে, ‘নারীকে ইসলাম সঙ্কীর্ণতায় রেখেছে, বন্দিনী করে রেখেছে!’ তাদের সব বাকপটুতার জবাব খুঁজে পাবে আমাদের সোনালি অতীতে।
নারী যেরূপেই থাকুক- ঘরোয়া, বিদ্যানুরাগী, সৈনিক সব ক্ষেত্রেই সে নৈপুণ্যের ছাপ, কঠিন অধ্যবসায়ের ছাপ রাখে। আমরা পারছি না আমাদের আদর্শ সেই নারীদের আদর্শের রঙে নিজেদের রাঙাতে। আধুনিকতা জীবনের মান উন্নয়ন করেছে, কৃষ্টি, কালচার, পোশাক-আশাক, সাজসজ্জায় এসেছে পরিবর্তন। আদর্শ অনুকরণেও এসেছে পরিবর্তন পোশাকের ধরন যতটা পাল্টেছে, তার চেয়ে বেশি পালটে গেছে আমাদের হৃদয়ের আচ্ছাদন।
আজ নারীরা অন্যের চোখে দেখে, অন্যের মন দিয়ে ভাবে, অন্যের শেখানো কথা বলে। মিথ্যার বলয়ে থেকে মরীচিকার বাইরের ঝলকটাকে সত্য এবং জীবন গড়ার আশ্রয় হিসেবে ধরে নিয়েছে। তথাকথিত আধুনিক, বস্তুবাদী সমাজ নারীমুক্তির মুখস্থ ফাঁকা বুলি ঝাড়ে। তবে এ সমাজেই কেন নারী এত লাঞ্ছিত? কেন নারী তার ‘অধিকার চাই, অধিকার চাই’ দাবি তুলবে? কেন আজকের সমাজে খুঁজে পাওয়া যায় না আলোকোজ্জ্বল সেই ইতিহাসের প্রতিচ্ছবি?
একদা এই নারীর শ্রম ও ছোঁয়া পেয়েছিল ইসলাম। আর ইসলাম কখনো তা অস্বীকার করে না। ইসলাম নারীকে তার যথোপযুক্ত সম্মান দিয়ে দেখে। ইসলাম এও প্রত্যাশা করে নারী সে তার মর্যাদা রক্ষা করবে।
ইসলামের কাছে প্রতিটি রূপে নারী সম্মানের, গচ্ছিত, লুকায়িত সম্পদ। তুমি লিখতে পারবে না, লড়তে পারবে না? কিন্তু তুমি জননী তো! তুমি খালিদ বিন ওয়ালিদ, ওমর, হামযা, আলী রা:-কে আবার ধরণীতে তুলে আনতে পারো। তোমার হাতে গড়ে উঠবে, মূসা বিন নুসায়ের, তারিক বিন জিয়াদ, মুহাম্মদ বিন কাশিম, সালাউদ্দীন আয়ুবি, নুরুদ্দীন জঙ্গিদের মতো ইসলামের বীর সেনানীরা। তোমার কোমল হস্তেকলম, অস্ত্র তুলে নিতে যেমন পারো তেমনি জাতির জন্য উত্তম কর্ণধার গড়ে তুলতে পারো। ইসলাম তোমায় বলে সম্রাজ্ঞী। ইসলামের সফলতার সাথে হাজারো নারীর রক্ত-শ্রম মিশে আছে। ইসলামের ললাটে রক্তিম সূর্যের ঘনঘটা ‘নারী’ চোখেই অঙ্কিত হয়।
নারী যখন রবের হুকুম পালন এবং নিজ সম্মান আব্রু রক্ষায় নিজেকে পর্দা আবৃত করে তখন সে মূলত কুরআনের আয়াতে নিজেকে আবিষ্ট করে। এ শুধু আয়াত নয় রবের ভালোবাসার পরশ, তাকওয়ার আবরণ, যুগ যুগ ধরে মুসলিমাদের সম্মানের বহমান স্রোতধারা। এখানেই মেলে আবে হায়াত!
হে নবী! আপনি আপনার স্ত্রীদেরকে, কন্যাদেরকে ও মুমিনদের নারীদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের চাদরের কিছু অংশ নিজেদের ওপর টেনে দেয়। এতে তাদেরকে চেনা সহজতর হবে। ফলে তাদেরকে উত্ত্যক্ত করা হবে না। আর আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু (সূরা-আহযাব; আয়াত-৪৯)।
লেখক : শিক্ষার্থী, কামিল, হাদিস বিভাগ, ফরিদগঞ্জ মজিদিয়া কামিল মাদরাসা, চাঁদপুর
Leave a Reply