হজরত আলী রা: যখন মুসলিম জাহানের শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন, সে সময়ে একবার তাঁর ঢাল চুরি হলো। চুরি করল একজন ইহুদি। হজরত আলী রা: আদালতের শরণাপন্ন হলেন। কাজী (বিচারপতি) খলিফা হজরত আলী রা:-এর কাছে সাক্ষী চাইলেন। সাক্ষী হিসেবে খলিফা হাজির করলেন তাঁর এক ছেলে ও চাকরকে। কিন্তু আইনের দৃষ্টিতে আপন সন্তান ও চাকরের সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য নয় বিধায় কাজী খলিফার অভিযোগ নাকচ করে দিলেন। মুসলিম জাহানের অধিপতি হয়েও তিনি কোনো বিশেষ বিবেচনা পেলেন না। ইসলামী আইনে শাসক-শাসিত, উঁচু-নীচু, শত্রু-মিত্র সবাই সমান। ইহুদি বিচার দেখে অবাক বিস্ময়ে বলে উঠল, অপূর্ব এই বিচার, ধন্য সেই বিধান যা খলিফাকে পর্যন্ত খাতির করে না আর ধন্য সেই নবী যার প্রেরণায় এরূপ মহৎ ও ন্যায়নিষ্ঠ জীবনের সৃষ্টি হতে পারে। হে খলিফাতুল মুসলিমিন, ঢালটি সত্যই আপনার। আমিই তো চুরি করেছিলাম। এই নিন আপনার ঢাল। শুধু ঢাল নয়, তার সাথে আমার জান-মাল, আমার সব কিছু ইসলামের খেদমতে পেশ করলাম।
হজরত আলী রা:-এর খেলাফতকালে জনৈক মুসলিম কর্তৃক একজন জিম্মি নিহত হয়। হজরত আলী আততায়ী মুসলমানের প্রাণদণ্ডের আদেশ দেন। হজরত আলী রা: সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করেন, ‘আমরা যাদের জিম্মি বা দায়িত্ব নিয়েছি, তাদের রক্ত আমাদের রক্ততুল্য। তাদের রক্ততুল্য আমাদের রক্তমূল্য। সুচারুরূপে চলছিল অর্ধপৃথিবীর শাসক দ্বিতীয় খলিফা হজরত উমর ফারুক রা:-এর খেলাফতকাল। ঠিক একই সময়ে মিসরের শাসনকর্তা হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন হজরত আমর ইবনুল আস রা:। সে সময় একদিন আলেক জান্দ্রিয়ার খ্রিষ্টান পল্লøীতে হইচই পড়ে গেল। কেউ একজন যিশু খ্রিষ্টের প্রস্তরনির্মিত মূর্তির নাক ভেঙে ফেলছে। খ্রিষ্টানদের সন্দেহের তীর মুসলমানদের দিকে। তারা উত্তেজিত হয়ে উঠল। খ্রিষ্টান বিশপ অভিযোগ নিয়ে শাসনকর্তা আমর ইবনুল আসের কাছে এলেন। আমর ঘটনা শুনে অত্যন্ত দুঃখ প্রকাশ করলেন। তিনি ক্ষতিপূরণস্বরূপ মূর্তিটি নতুনভাবে তৈরি করে দিতে চাইলেন। কিন্তু খ্রিষ্টান নেতাদের প্রতিশোধস্পৃহা ছিল অন্যরকম।
তারা চাইল মুহাম্মদ সা:-এর মূর্তি তৈরি করে অনুরূপভাবে নাক ভেঙে দিতে। খ্রিষ্টানদের এ মতামত ব্যক্ত করার মধ্য দিয়ে যে ঔদ্ধত্য প্রকাশ পেয়েছে, তাতে তাদের কতটুকু বাক ও ব্যক্তি স্বাধীনতা ছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায়। যে নবী সা: আজীবন পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন, সে নবীর মূর্তি তৈরিকে মুসলমানরা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারলেন না। হজরত আমর কিছুক্ষণ নীরব থেকে খ্রিষ্টান বিশপকে বললেন, ‘আমার অনুরোধ, এ প্রস্তাব ছাড়া অন্য যেকোনো প্রস্তাব করুন, তা বাস্তবায়নে আমি রাজি আছি। আমাদের যেকোনো একজনের নাক কেটে আমি আপনাদের দিতে প্রস্তুত, যার নাক আপনারা চান।’ খ্রিষ্টান নেতারা সবাই এ প্রস্তাবে সম্মত হলো। পরদিন খ্রিষ্টান ও মুসলমানরা বিরাট এক ময়দানে একত্রিত হলো। মিসরের শাসক সেনাপতি আমর রা: সবার সামনে হাজির হয়ে বিশপকে বললেন, ‘এ দেশ শাসনের দায়িত্ব আমার। যে অপমান আজ আপনাদের, তাতে আমার শাসনের দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে। তাই তরবারি গ্রহণ করুন এবং আপনিই আমার নাসিকা ছেদন করুন।’ এ কথা বলেই তিনি বিশপকে একখানি তীক্ষè ধারালো তরবারি হাতে দিলেন। জনতা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, খ্রিষ্টানরা স্তম্ভিত। চারদিকে থমথমে ভাব।
সে নীরবতায় নিঃশ্বাসের শব্দ করতেও যেন ভয় হয়। সহসা সেই নীরবতা ভঙ্গ করে একজন মুসলিম সেনা এগিয়ে এলো। চিৎকার করে বলল, ‘আমিই দোষী, সিপাহসালারের কোনো দোষ নেই। আমিই মূর্তির নাক ভেঙেছি, তা আমার হাতেই আছে। তবে মূর্তি ভাঙার কোনো ইচ্ছা আমার ছিল না। মূর্তির মাথায় বসা একটি পাখির দিকে তীর নিক্ষেপ করতে গিয়ে এ দুর্ঘটনা ঘটেছে।’ সেই সেনা এগিয়ে এসে বিশপের তরবারির নিচে নিজের নাসিকা পেতে দিলো। নির্বাক সবাই! বিশপের অন্তরাত্মা রোমাঞ্চিত হয়ে উঠল। তরবারি ছুড়ে দিয়ে বিশপ বললেন, ‘ধন্য সেনাপতি, ধন্য এই বীর সৈনিক, আর ধন্য আপনাদের মুহাম্মদ সা:, যাঁর মহান আদর্শে আপনাদের মতো মহৎ উদার নির্ভীক ও শক্তিমান ব্যক্তি গড়ে উঠেছে। যিশু খ্রিষ্টের প্রতিমূর্তির অসম্মান করা হয়েছে সন্দেহ নেই, কিন্তু তার চেয়েও অন্যায় হবে যদি অঙ্গহানি করি। সেই মহান ও আদর্শ নবীকেও আমার সালাম।’ পরধর্ম সহিষ্ণুতার এ জলন্ত উদাহরণ আজো বিশ্ববাসীকে অবাক করে।
উপরিউক্ত ইতিহাসখ্যাত ঘটনাপ্রবহ প্রমাণ বহন করে, ইসলামী শাসনব্যবস্থায় অমুসলিমদের জীবনযাত্রা, জান-মালের নিরাপত্তা, ধর্মীয় স্বাধীনতা, নাগরিক অধিকার ও মর্যাদা কতটুকু ছিল। ভিন্নধর্মীদের অধিকারের ব্যাপারে মানবতার মুক্তির দূত, সারা জাহানের রহমত নবী মুহাম্মদ মোস্তফা সা: ইরশাদ করেন- ‘কোনো অমুসলিম নাগরিককে যে অত্যাচার করল বা তার অধিকার ক্ষুণ্ন করল বা তাকে সাধ্যাতীত পরিশ্রম করাল বা তার অমতে তার থেকে কিছু নিয়ে নিলো, কিয়ামতের দিন আমি হবো তার বিপক্ষে মামলা দায়েরকারী।’ তিনি আরো বলেন, ‘যে কোনো অমুসলিম নাগরিককে কষ্ট দিলো আমি তার বাদি হবো। আর আমি যার বিরুদ্ধে বাদি হবো কিয়ামতের দিন আমি হবো বিজয়ী।’ তিনি অন্যত্র বলেন, ‘যে সংখ্যালঘুকে উত্ত্যক্ত করল সে আমাকে উত্ত্যক্ত করল, আর যে আমাকে উত্ত্যক্ত করল আল্লাহকেই সে উত্ত্যক্ত করল।’ অমুসলিম নাগারিককে হত্যা করা সম্পর্কে রাসূলে মকবুল সা: বলেছেন, ‘যে কোনো সংখ্যালঘুকে হত্যা করবে সে বেহেশতের সুঘ্রাণও উপভোগ করতে পারবে না। অথচ বেহেশতের সুঘ্রাণ ৪০ বছরের দূরত্ব থেকেও অনুভব করা যাবে।’
মানবাধিকার দিয়েছেন মহান আল্লাহ, দিয়েছেন প্রত্যেক ধর্মের মানুষকে ধর্মীয় অধিকার। অমানবিকতা কেড়ে নিয়েছেন। যেমন- যে মানব অন্য নিরীহ মানুষের রক্তপিপাসু তাকে বাঁচার অধিকার দেয়নি। যে মানব অপর মানবের সম্মান নষ্ট করে তার সে অধিকার ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে। কখনো কোনো মানুষকে জোর করে ইসলামে দীক্ষিত করা ইসলামে নিষিদ্ধ বা হারাম করা হয়েছে। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে, ‘আর আপনার রব যদি চাইতেন, তাহলে পৃথীবিতে যারা আছে তারা সবাই ঈমান আনত। তবে কি আপনি মানুষের ওপর বলপ্রয়োগ করবেন?’ হজরত মুহাম্মদ সা: সুস্পষ্ট ভাষায় অমুসলিমদের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা বিধানের জন্য ঘোষণা দিয়েছেন, ‘তাঁদের রক্ত আমাদের রক্তের মতো এবং তাঁদের ধনসম্পদ আমাদের ধনসম্পদের মতো।’ অমুসলিমদের জান-মাল মুসলমানদের নিজের জান-মালের মতো পবিত্র ও নিরাপত্তাযোগ্য। রাসূলুল্লাহ সা:-এর প্রতিষ্ঠিত মদিনাকেন্দ্রিক ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা ছিল একটি মৌলিক নাগরিক অধিকারপূর্ণ-সাম্যের সমাজ। তাঁর প্রদর্শিত জীবনব্যবস্থার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে ভারতের জাতির জনক মহাত্মা গান্ধী বলেছিলেন, ‘প্রাচ্য যখন অন্ধকারে নিমজ্জিত, প্রাচ্যের আকাশে তখন উদিত হলো এক উজ্জ্বল নক্ষত্র এবং অন্ধকার পৃথিবীকে তা দিলো আলো ও স্বস্তি। ইসলাম একটি মিথ্যা ধর্ম নয়। শ্রদ্ধার সাথে হিন্দুরা তা অধ্যয়ন করুক, তাহলে আমার মতোই তারা একে অপরকে ভালোবাসবে।’
পৃথিবীর বিভিন্ন মুসলিম দেশ যেমন- সিরিয়া, মিসর, স্পেন, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া প্রভৃৃতি দেশে শত শত বছর ধরে অমুসলিমদের অবস্থান, তাদের প্রতি মুসলিমদের সহনশীলতার প্রমাণ বহন করে। এ অপরিসীম সহনশীলতার জন্য মুসলিমদের হাত থেকে স্পেন অন্য ধর্মাবলম্বীরা দখল করে নিয়েছিল। সেখানে মুসলিমরা প্রায় কয়েক শ’ বছর শাসন করেছিল। কিন্তু যখন খ্রিষ্টানরা শাসনক্ষমতা দখল করে, তখন তারা প্রথমেই মুসলিমদের বিতাড়িত করার কাজে হাতে নেয়। তাই রবার্টসন বলেছিলেন, ‘অন্য ধর্মের অনুসারীদের প্রতি সহনশীলতার ঈর্ষান্বিত দাবিদার এবং দাবি করার উপযুক্ত একমাত্র মুসলিমরাই, তাদের ধর্ম পালনের মাধ্যমে এমনকি যখন তারা তাদের ধর্মকে সর্বত্র ছড়িয়ে দেয়ার জন্য খোলা তলোয়ার নিয়ে যুদ্ধে লিপ্ত হয় তখন বিজিত স্থানের লোকদেরকে তাদের ধর্মমত পরিত্যাগ করার জন্য বাধ্য না করে তাদের ইচ্ছার ওপর ছেড়ে দেন।
শতাব্দীর পর শতাব্দী মুসলমানরা অমুসলিমদের ধর্মীয় অধিকার ইসলামী আইন অনুযায়ী দিয়ে এলেও কিছু হলুদ সাংবাদিক, বিতর্কিত লেখক, কিছু নিছক মিডিয়া ইসলামের সুমহান আদর্শ না জানার কারণেই হোক বা সাম্প্রদায়িক মন-মানসিকতা থেকেই হোক অথবা মুসলিমদের প্রতি বিদ্বেষের কারণেই হোক, তারা বরাবরই ইসলামকে নিচু দেখানোর জন্য ইসলাম সম্পর্কে অপপ্রচার করতে সিদ্ধহস্ত। সম্প্রতি দেখা মিলছে বিভিন্ন মিডিয়ার টকশোর টেবিলে মানবতার ধর্ম ইসলাম ও মুসলমানদের সন্ত্রাস-জঙ্গি হিসেবে উপস্থাপনের দুঃসাহস। মুসলমানরা অমুসলিমদের দমন-নিপীড়ন নির্যাতন করছে রূপে মিডিয়া প্রচার চালাচ্ছে। পক্ষান্তরে অমুসলিম কর্তৃক আল-আমিন (বিশ্বস্ত) খেতাবপ্রাপ্ত নবী সা:-এর আদর্শে আদর্শিত মুসলমানরা এর থেকে যোজন যোজন দূরে! বরং ইতিহাস সাক্ষী দেয় একমাত্র ইসলামই নাগরিক অধিকার পূর্ণাঙ্গভাবে দিয়ে আসছে। যুগ যুগ ধরে ইসলামের সুমহান শান্তির অমীয় সুধা সংখ্যালঘুদেরও প্রশান্তি দিয়ে চলছে। সম্প্রতি বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর পাশবিক হিংস্রতার সঠিক বিচার দাবি করছি। হিন্দু বাড়িতে আগুন, মন্দির ভাঙচুরের সাথে জড়িতদের মুখোশ উন্মোচন করার অনুরোধ জানাচ্ছি। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির প্রতীক বাংলাদেশ শান্তির রোলমডেল হয়েই থাকুক।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও ইসলামী বক্তা
Leave a Reply