বর্তমান সরকারের অধীনে তাদের নিয়োগকৃত কাজী রকিব ও নুরুল হুদার নির্বাচন কমিশনের পরিচালনায় ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি ও ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত দশম ও একাদশ সংসদ নির্বাচনে জনগণের ভোটাধিকার নিয়ে ছিনিমিনি খেলায় নির্বাচনের ইতিহাসে যে কলঙ্কময় অধ্যায় রচিত হয়েছে, তা ঢেকে দিতেই স্বাধীনতার ৫০ বছর ও বর্তমান সরকারের ক্ষমতায় থাকার আনলাকি থার্টিন বছর পর জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিবিহীন সংসদে আইন পাস করে সাবেক দুই নির্বাচন কমিশনের বৈধতা দান করে নতুন প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও চারজন কমিশনারের নাম খুঁজে বের করার জন্য মহামান্য রাষ্ট্রপতি যে অনুসন্ধান কমিটি গঠন করেছিলেন সেই কমিটি সরকারি ও সরকার সমর্থক রাজনৈতিক দল, বুদ্ধিজীবী, সুশীলসমাজের কাছ থেকে পাওয়া ২২০ জনের নামের তালিকা থেকে যাচাই-বাছাই করে ১০ জনের একটি তালিকা মহামান্য রাষ্ট্রপতির সমীপে দাখিল করেছিলেন। তিনি ওই তালিকা থেকে নির্বাচন কমিশনের সাবেক সচিব কাজী হাবিবুল আউয়ালকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট যে নির্বাচন কমিশন গঠন করেছেন, তাদের ওপর কে এম নুরুল হুদা কমিশনের অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করার ও ২০২৩ সাল থেকে অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনের দায়িত্ব পড়েছে।
বর্তমান প্রধান নির্বাচন কমিশনারের একসময়ের বস ও পূর্বসূরি কে এম নুরুল হুদাও ২০১৭ সালের মধ্য ফেব্রুয়ারিতে দায়িত্ব গ্রহণের পর রাজনৈতিক দল, বুদ্ধিজীবী, সুশীলসমাজ, প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সিনিয়র সাংবাদিকদের সাথে ধারাবাহিক সংলাপ করে দীর্ঘ ২২ মাস প্রস্তুতি নিয়েই ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ সংসদ নির্বাচনে ভোটগ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু তার অধীনস্থ প্রশাসন, পুলিশ ও পোলিং অফিসাররা ভোটগ্রহণ শুরুর সময় ৮ ঘণ্টা এগিয়ে এনে জিরো আওয়ারে নির্ধারণের বিষয়টি সরকারি দলের পলিটিক্যাল অ্যাক্টিভিস্টদের জানিয়ে দেয়ায় ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৯২টি আসনের কেন্দ্রগুলোতে রাতদুপুরেই সর্বনিম্ন ৭০ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ শতভাগ অস্বচ্ছ ব্যালট কেটে স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স পূর্তি করে সকাল ৮টায় পুলিশ ও পলিটিক্যাল অ্যাক্টিভিস্টরা লাঠি হাতে ভোটকেন্দ্রে চার পাশে দাঁড়িয়ে থেকে যে প্রাচীর গড়ে তুলেছিল তা ভেদ করে কোনো মাদারসান ভোটকেন্দ্রে ঢুকতে না পারলেও শত শত কেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়ার রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছিল। ফলে মানব পাচারকারী শহিদুল ইসলাম ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী ডা: মুরাদ হাসানের মতো বিতর্কিত শত শত প্রার্থী লাখ লাখ ভোটের ব্যবধানে ‘জয়ী’ হয়ে এলাকার ভোটারদের অবাক করে দিয়েছিলেন। ৩০০ আসনের বাকি যে দুই হালি আসন ছিল সেই আসনের ১৪ দলের প্রার্থীরা সিলেটের সাবেক মেয়র মরহুম বদরুদ্দিন কামরানের মতো হওয়ায় তারা জয়ের জন্য ৪ঢ়’র ওপর ভর না করে নিজের ও প্রতীকের জনপ্রিয়তার ওপর নির্ভর করায় ৫০০০ ভোটের ব্যবধানে যেমন মেয়র কামরান পরাজিত হয়েছিলেন, তেমনি জাতীয় নির্বাচনেও ওই দুই হালি প্রার্থীকে বিএনপি ও গণফোরামের প্রার্থীর কাছে পরাজিত হতে হয়েছিল। নির্বাচনে নৌকার এইরূপ অবিশ্বাস্য ভোটপ্রাপ্তির হার সদ্য সমাপ্ত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। সাধারণত সরকারি কোনো অফিসের চিফ বস বদলি হয়ে নতুন বস যোগদানের পর অধীনস্থ কর্মকর্তাদের প্রথম দায়িত্ব হয় সাবেক বসের ভুলত্রুটিগুলো নতুন বসের নজরে এনে তার আস্থাভাজন হওয়া। নতুন বস নিজেও সাবেক বসের ফাইলপত্র ঘেঁটে তাঁর কর্মপরিকল্পনা তৈরি করে থাকেন। তবে একটি বিষয়ে সাবেক ও বর্তমান বসের কর্মপরিকল্পনা হুবহু এক হয়ে থাকে; তা হচ্ছে সরকারের নেক নজরে থাকার প্রচেষ্টা। চাটুকাররা বসকে খুশি করতে নিত্যনতুন পন্থা অবলম্বন করে থাকেন। যেমন এক বস এসেছেন যিনি চাটুকারিতা মোটেই পছন্দ করেন না। তাই দেখে অধীনস্থ এক কর্মকর্তা বলেছিলেন, ‘স্যার, ২০ বছর চাকরি জীবনে আপনিসহ ১০ জন বস পেয়েছি, তাদের মধ্যে আপনি একমাত্র ব্যতিক্রম। আপনি চাটুকারিতা একদম পছন্দ করেন না। স্যার আমি ভাগ্যবান যে, আপনার মতো বস আল্লাহ আমার ভাগ্যে জুটিয়ে দিয়েছেন।’ বস তো শুনে খুশিতে ডগমগ। প্রধান নির্বাচন কমিশনার নির্বাচন কমিশনের সচিব থাকায় এবং তিনিসহ অন্য কমিশনাররা এ সরকারের অধীনে ১০-১২ বছর চাকরি করার পর অবসর গ্রহণ করেছেন। অবসর জীবনে সময় কাটানোর জন্য প্রতিদিনের পত্রিকাগুলো নিশ্চয়ই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়েছেন। তা হলে ২০১৮ সালের সিটি করপোরেশনের নির্বাচন, জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও ২০২১-২২ সালে অনুষ্ঠিত পৌর ও ইউপি নির্বাচনের যেসব খবরাখবর পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল তা নিশ্চয়ই তাদের নজরে পড়েছিল। কিন্তু তার কোনো ছাপ নির্বাচন কমিশনের কর্মকাণ্ডে পরিলক্ষিত হচ্ছে না। কারণ তিনিও তার পূর্বসূরির পদাঙ্ক অনুসরণ করে ২০২৩ সালে অনুষ্ঠিতব্য দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন হয়তো ‘সরকারের অভিপ্রায় অনুযায়ী’ করতে বুদ্ধিজীবী, সুশীলসমাজ, প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সিনিয়র সাংবাদিকদের সাথে ধারাবাহিকভাবে অর্থহীন ও অপ্রয়োজনীয় সংলাপ করছেন।
যেহেতু নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য যে অনুসন্ধান কমিটি করা হয়েছিল তা নিয়ে রাষ্ট্রপতির সংলাপ বিরোধীদল বর্জন করেছিল, তাই নির্বাচন কমিশনের সংলাপও যে বিরোধী দল বর্জন করবে- এটি জেনেবুঝে তিনি সংলাপ করছেন, তাদের সাথে যারা নির্বাচনে কোনো পক্ষ নন। নির্বাচনের পক্ষ থাকে তিনটি : সরকারি দল, বিরোধী দল ও ভোটার জনগণ। সরকারের নিয়োগকৃত নির্বাচন কমিশনের কাজ হচ্ছে, খেলার রেফারি হিসেবে সরকারি দলের ফাউল-মুক্ত নির্বাচন নিশ্চিত করে বিরোধী দল ও জনগণের জন্য ১৯৯১ সালের বা ১৯৯৬ সালের ১২ জুনের মতো নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করা। এখানে গোলজাজ হিসেবে সংলাপে অংশগ্রহণকারীরা ভূমিকা রাখতে পারেন। এককথায়, সরকারি দলের খবরদারিমুক্ত নির্বাচন করা। ১৯৯১, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে নির্বাচনকালীন সরকার ও নির্বাচন কমিশন গঠিত হওয়ায় ৭৫ দিনের মধ্যে নির্বাচন হয়েছিল। বিচারপতি আবদুর রউফ কমিশন ও সাবেক সচিব আবু হেনা কমিশন গঠিত হওয়ার ৭৫ দিনের মধ্যে যদি পরাজিত দল ছাড়া সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন উপহার দিতে পারেন তা হলে কাজী রকিব কমিশন ও কে এম নুরুল হুদা কমিশন ২০-২২ মাস এবং ১৪ দলীয় সরকার দীর্ঘ ৬০ মাস সময় পেয়েও ১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালের মতো নির্বাচন উপহার দিতে ব্যর্থ হলে তার দায় কাদের ওপর বর্তায়?
২০০১ সালের নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করেছিল আওয়ামী লীগ সরকার। নির্বাচন কমিশনও তারা গঠন করেছিলেন। গোপালগঞ্জের কৃতীসন্তান সাবেক সিএসপি আবু সাইদকে ২০০০ সালের এপ্রিলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। তিনিও প্রায় ১৮ মাস প্রস্তুতি নিয়ে ২০০১ সালের ১ অক্টোবর যে নির্বাচন করেছিলেন আওয়ামী লীগ তাকে স্থূল কারচুপির নির্বাচন আখ্যা দিয়ে রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদ, প্রধান উপদেষ্টা প্রধান বিচারপতি লতিফুর রহমান ও প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে বেঈমান বলে আখ্যায়িত করে নিজেদের রাজনৈতিক দেউলিয়াপনার পরিচয় দিলেও বুদ্ধিজীবী, সুশীলসমাজ তার সমর্থক ছিলেন। অথচ অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদদের সমন্বয় গঠিত ৫০ সদস্যের মন্ত্রিসভা ও ২৬৫ জন এমপি পাঁচ বছর ক্ষমতায় থেকে কাজী রকিব কমিশন ১৮ মাস প্রস্তুতি নিয়ে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি ভোটারবিহীন নির্বাচন উপহার দিয়ে জাতিকে বিস্মিত করলেও যারা ওই নির্বাচনকে সফল করতে গণজাগরণ মঞ্চের উত্থান ঘটিয়েছিলেন সেই বুদ্ধিজীবীদের সাথে কে এম নুরুল হুদা কমিশন যেমন সংলাপ করেছিলেন, তেমনি কাজি হাবিবুল আউয়ালও সংলাপ করছেন কেন? কে এম নুরুল হুদা কমিশনের ২০১৭-১৮ সালের সংলাপের বাই প্রডাক্ট ছিল ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচন। তা হলে কি ওই সংলাপের কার্যবিবরণীর নথিটি নির্বাচন কমিশনের অফিস থেকে লাপাত্তা হয়েছে যে, একই গোষ্ঠীর সাথে আবার একই বিষয়ে সংলাপে বসতে হবে? সংবিধান অনুযায়ী জনগণ সকল ক্ষমতার মালিক। তাদের প্রতিনিধি হিসেবে সরকারি দল তা পাঁচ বছর ধরে ভোগ করে থাকেন। যেমন এক ভিক্ষুক এক ব্যক্তির কাছে ভিক্ষা চাওয়ায় তিনি ‘মাফ কর’ বলায় ভিক্ষুক আর এক ব্যক্তির কাছে অনুযোগ করে বলেছিল। দেখেন তো, উনি ভিক্ষা দেবেন না কেন? উনার টাকা উনারই থাকবে, আমি শুধু আল্লাহর নামে বকশে দেবো। জনপ্রতিনিধিরা জনগণের ভোটকে ভিক্ষুকের দৃষ্টিতে দেখে থাকেন বলে যে সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে তা পাশ কাটানোর জন্যই এ সংলাপ। স্বাধীনতার দুই দশক পরে গণ-আন্দোলনে স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের পতনের পর ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি সর্বপ্রথম সরকারি দলের খবরদারিমুক্ত নির্বাচনে বিএনপির কাছে পরাজিত হয়ে ওই নির্বাচনকে সূক্ষ্ম কারচুপির নির্বাচন আখ্যা নিয়ে ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে সরকারি দল ক্ষমতায় থাকলে বিরোধী দলের জয় অসম্ভব ভেবেই নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আওয়ামী লীগ, জাপা, জামায়াত ও ওয়ার্কার্স পার্টির ১৪৭ জন এমপি সংসদ থেকে পদত্যাগ করে হাইকোর্টে রিট করে পদত্যাগপত্র গ্রহণে স্পিকারকে বাধ্য করার মাধ্যমে জনগণের ভোটে নির্বাচিত পঞ্চম সংসদের অপমৃত্যু ঘটানো হয়েছিল। তার পর ১৭৩ দিন হরতাল পালন করে সচিব মহিউদ্দিন খান আলমগীরের নেতৃত্বে সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীদের ‘বিদ্রোহ’ ঘটিয়ে প্রশাসন অচল করে দেয়ার মতো আন্দোলনের ফসল ছিল বিচারপতি হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার। এই অরাজনৈতিক সরকারের তিন মাসের শাসনামলে গঠিত সাবেক সচিব আবু হেনা কমিশন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দিতে সক্ষম হয়েছিল, ক্ষমতাসীন সরকারের কোনো রাজনৈতিক স্বার্থ না থাকায়। জাপার সরকারি দল যেমন ১৯৮৬ সালের ৯ মে দিনদুপুরে ভোট ডাকাতি করে আওয়ামী লীগকে হারিয়ে দিয়েছিল, তেমনি ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে বিরোধী দলের ভাগ্যে জুটেছিল মাত্র দুই হালি আসন।
২০০১ সালের নির্বাচনে কোনো সরকারি দল না থাকায় সদ্য ক্ষমতা থেকে সরে যাওয়া রাজনৈতিক দল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কারণে ভোট ডাকাতির সুযোগ থেকে বঞ্চিত হওয়ায় তাদের আন্দোলনের ফসল, নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রতি মোহভঙ্গ ঘটে। কারণ বাঙালি ভোটাররা বিশেষ করে শিক্ষা-দীক্ষায় বাঙালি হিন্দুদের চেয়ে পিছিয়ে পড়া বাঙালি মুসলমান ভোটাররা ভোটাধিকার প্রয়োগের ক্ষেত্রে বেশি সচেতন বলেই ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে ভোট দিয়ে পূর্ব বাংলাকে ভারতীয় ইউনিয়নের আওতাবহির্ভূত রাখায় আমাদের স্বাধীনতার ভিত রচিত হয়েছিল। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টকে ভোট দিয়ে পাকিস্তানিদের হার্টবিট বাড়িয়ে দেয়ায় ১৯৭০ সালের পূর্ব পর্যন্ত জনগণকে আর ভোট দেয়ার সুযোগ দেয়া হয়নি। ১৯৭০ সালের নির্বাচনকালীন কোনো রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় না থাকায় জনগণ অবাধে ভোট দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের ভাগের ১৬২টি আসনের মধ্যে ১৬০টিতে বঙ্গবন্ধুর দলকে জয়ী করার সুফল পেল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত আমাদের মহান স্বাধীনতা। গত ৩০-০৬-২০১১ তারিখে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাসের মাধ্যমে তারাই ওটা বাতিল করেন যারা একই দাবিতে সংসদ থেকে পদত্যাগ, ১৭৩ দিন হরতাল পালন ও সরকারি কর্মচারীদের বিদ্রোহ ঘটিয়ে দাবি আদায় করেছিলেন এবং ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি এ সেনাবাহিনীর সহায়তায় তার শতভাগ বিশুদ্ধতা প্রতিষ্ঠা করে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে ২৬৫ আসন পেয়েছিলেন, যার ফল হচ্ছে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ও ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের মতো নির্বাচন। এই দুই নির্বাচনের কলঙ্কের চিহ্ন যাদের কপালে শোভা পাচ্ছে, তাদের নিয়োগকৃত নির্বাচন কমিশন ওই সরকারের সহযোগিতায় ১৯৯৬ সালের ১২ জুনের মতো নির্বাচন বা ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের মতো নির্বাচন দিয়ে ভোটের মাধ্যমে সরকারি দল ও বিরোধী দল পরিবর্তনের ক্ষমতা জনগণের হাতে ফিরিয়ে দেবেন; এটি কেউ বিশ্বাস না করলেও নির্বাচন কমিশনের আহূত সংলাপে অংশগ্রহণকারীরা বিশ্বাস করেন বিধায় তারা সংলাপে অংশ নিয়েছেন। সংবিধান অনুযায়ী সব ক্ষমতার মালিক জনগণ হলেও তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা তা ১৮২৬ দিন ভোগ করতে পারলেও, জনগণ ১৯৯১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছর অন্তর অন্তর এক দিনের জন্য ভোগ করতে পারলেও ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি থেকে তা বন্ধ হয়ে গেছে। এমনকি ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে জনগণের ভোটে বিরোধী দলও পরিবর্তিত হয়নি। জনগণের ভোটে ইউপি চেয়ারম্যান নির্বাচনের ক্ষমতার ও জনগণের হাতে নেই। তা ১৪ দলীয় সরকারের হাতে চলে যাওয়ায় প্রশাসন, পুলিশ, পোলিং অফিসারদের সহায়তায় পলিটিক্যাল অ্যাক্টিভিস্টরা নৌকার ব্যালট রিজার্ভ রেখে মেম্বার ও মহিলা মেম্বারের ব্যালট বা ‘ইভিল’ ভোটিং মেশিনের বাটন ভোটারদের হাতে তুলে দেয়ায় নৌকার ভোটপ্রাপ্তির সংখ্যা বর্তমানেও অটুট আছে। এরূপ নির্বাচন ২০১৪ সাল থেকে শুরু হলেও বুদ্ধিজীবী, সুশীলসমাজ তার ঘোর সমর্থক হওয়ায় তারা জনগণের পক্ষে টুঁ শব্দটিও করেননি। তাই তারা সংলাপে অংশ নিয়ে মন্ত্রীদের ভাষায় বলছেন, কোনো দলকে নির্বাচনে আনার কাজ নির্বাচন কমিশনারের নয়। বিরোধী দলকে জামাই আদর করে নির্বাচনে আনার দরকার নেই। নির্বাচন কমিশনারের দায়িত্ব হচ্ছে সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন করা। তাতে যদি কমিশনকে সাহসী হতে হয় তবে তা হতে হবে।
জনগণ মনে করে, নির্বাচন কমিশন যদি ভালো নির্বাচন করতে চাইতেন তাহলে আওয়ামী লীগের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়েছিল যে নির্বাচন অর্থাৎ ১৯৯৬ সালের ১২ জুনের মতো নির্বাচন বা ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের মতো নির্বাচন করার ইচ্ছা থাকলে উপায় বের করার জন্য সরকারি দল নয়, সরকারের সাথে সংলাপে বসে নিজেদের স্বাধীনতার দৌড় জেনে নিতে পারতেন। যে দেশের বর্তমান সরকারি দল বিরোধী দলে থাকাকালে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য একবার বেসামরিক তত্ত্বাবধায়ক সরকার, আবার আধা সামরিক তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করতে পারে এবং ওই আন্দোলনকারীদের পরে পুরস্কৃত করতে পারেন তারা অন্তত এটি করতে দেবেন না। তত্ত্বাবধায়ক সরকার অবৈধ অবৈধ বলে ঘোষণা করে রায় এবং ফখরুদ্দিন সরকারকে বৈধ বলে রায় দিয়ে জনগণের ঘাড়ে ভোটারবিহীন নির্বাচন ও রাতদুপুরের ভোট ডাকাতির নির্বাচন চাপিয়ে দেয়ার মাধ্যমে যে বিচারিক সুবিধা সরকারি দলকে প্রদান করা হয়েছে, তাতে তাদের কাছে জনগণ আর কী আশা করতে পারে? আওয়ামী লীগ ‘বিরোধী দলে থাকলে নির্বাচনকালীন শতভাগ নির্দলীয় সরকার হতে হবে’ আর ‘ক্ষমতায় থাকলে শতভাগ ১৪ দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে হবে’ এরূপ বিশ্বাস হতে যে পর্যন্ত না আমাদের দেশে সরকারি দল ও তাদের সমর্থক বুদ্ধিজীবী, সুশীলসমাজ ও আমলারা বের হয়ে আসতে না পারছেন তত দিন পর্যন্ত জনগণের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে না। গত দু’টি নির্বাচনে সরকার ও তার নিয়োগকৃত নির্বাচন কমিশন, অধীনস্থ প্রশাসন, পুলিশ ও পোলিং অফিসারদের সহায়তায় যে কলঙ্কের জন্ম দেয়া হয়েছে, তা ধামাচাপা দিতে যেমন ছলের অভাব হয় না, তেমনি নির্বাচনের অভিনব পরিবেশ সৃষ্টি করতে নির্বাচন কমিশন এ সংলাপের আয়োজন করেছে। তাই সরকার সমর্থক বুদ্ধিজীবী, সুশীলসমাজ তাতে অংশ নিয়ে তাদের মূল্যবান উপদেশ ও পরামর্শ দিয়েছেন। ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি অর্থমন্ত্রী থাকাকালে জেনারেল মইনকে ২০০৮ সালে পরামর্শ দিয়েছিলেন অনেকটা তেমন। উদ্দেশ্য একটাই : যারা ক্ষমতায় আছে তারাই থাকবে; জাপা বিরোধী দলে থাকবে না সরকারি দলে আসবে তা নির্ধারণের জন্য একটি নির্বাচন প্রয়োজন। জনগণ আশায় বুক বেঁধে আছে, হয়তো সরকারি দল ও সমর্থক বুদ্ধিজীবী, সুশীলসমাজ ১৯৯৪-৯৬ ও ২০০৬-০৭ সালের বিশ্বাস ফিরে পেয়ে ১৯৯৬ সালের ১২ জুনের মতো বা ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের মতো নির্বাচন দিয়ে জনগণের মুখের হাসি ফিরিয়ে দেবেন।
Leave a Reply