মহামারীর ধাক্কা কাটিয়ে দুবছর পর এবার চাঙ্গা ছিল ঈদবাণিজ্য। রেকর্ড কেনাকাটা ও বেচাবিক্রিতে পুরোদমে সরগরম হয়ে ওঠে ঈদের বাজার। এবারের ঈদকে কেন্দ্র করে দেড় লাখ কোটি টাকার বাণিজ্যের লক্ষ্যমাত্রা ছিল। কিন্তু বাণিজ্য হয় লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও প্রায় ২৫ শতাংশ বেশি। অর্থাৎ এবার ঈদবাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকা।
তবে এবারের অলঙ্কার বিক্রি কম হয়েছে। কারণ হলো, দুবছর পর বিধিনিষেধ উঠে যাওয়ায় অনেকে ভারত ও ইন্দোনেশিয়ায় ঘুরতে যান এবং সেখান থেকেই অলঙ্কার কেনেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এবারের ঈদে অলঙ্কারের বেচাবিক্রি গতবারের তুলনায় ২০-২৫ শতাংশ কম হয়েছে।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর সহসভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু আমাদের সময়কে বলেন, ‘গেল দুবছর করোনায় সব কিছু স্থবির ছিল। ঈদে মানুষ ঘর থেকে বের হতে পারেনি। কারও মনে ঈদ ছিল না। একদিকে ব্যবসায়ীরা দোকানপাট খুলতে পারেনি, অন্য দিকে ক্রেতারাও ঘর থেকে বের হতে পারেনি। কারও মনে ঈদের আনন্দ ছিল না। এ বছর করোনার প্রকোপ ও লকডাউন না থাকায় সবার মধ্যে ঈদের আনন্দ বিরাজ করেছে। ব্যবসায়ীরা ভালো বিক্রি করেছেন, আর ক্রেতারাও দুই বছরের কেনাকাটা একসঙ্গে করেছেন। ফলে বেচাবিক্রি অনেক ভালো হয়েছে।’
বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মো. হেলাল উদ্দিন আমাদের সময়কে বলেন, ‘লক্ষ্যমাত্রার
তুলনায় বাণিজ্য বেশি হয়েছে। এতে ব্যবসায়ীরা খুশি। তারা গত দুবছরের ক্ষতি কিছুটা হলেও পুষিয়ে নিতে পেরেছেন।’
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যমতে, সারাদেশে প্রায় চার কোটি পরিবার রয়েছে। আর এ চার কোটি পরিবারের সদস্য সংখ্যা ১৭ কোটির বেশি। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে এখন বিপুল পরিমাণ ভোক্তা শ্রেণি গড়ে উঠেছে। মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি এবং জীবনমান উন্নয়নে মানুষের ক্রয় ক্ষমতা অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে এখন বেশি। এ ছাড়া দেশের প্রায় ১ কোটি মানুষ প্রবাসে চাকরি ও ব্যবসা-বাণিজ্য করছেন। প্রবাসীরা নিকটাত্মীয়দের কাছে বিপুল অঙ্কের রেমিট্যান্স পাঠান ঈদ উৎসবে। সরকারি-বেসরকারি খাতের চাকরিজীবীরা বেতন-ভাতা ও ঈদ বোনাস পেয়ে থাকেন। এর পাশাপাশি সঞ্চয় এবং মানুষের ব্যক্তিগত তহবিলের অর্থ চলে আসে ঈদের কেনাকাটায়। ফলে লাখ লাখ কোটি টাকার বেচাকেনা হয় ঈদের বাজারে।
ঈদকে কেন্দ্র করে শীর্ষ ১০ পণ্য কেনাকাটার মধ্যে সবার ওপরে থাকে পোশাক। এর পরই জুতা-স্যান্ডেল, লুঙ্গি-গেঞ্জি-গামছা। খাদ্যপণ্যের মধ্যে সেমাই-চিনি, মাংস, মিষ্টি, গ্রসারি পণ্য রয়েছে। প্রসাধনী, টেলিভিশন, মোবাইলসহ নানা ধরনের পণ্যও কেনা হয় ঈদ উপলক্ষে। অনেকে আবার সোনার গহনা, ঘরের আসবাবপত্র কেনেন বলে ঈদে এসব পণ্যের বিক্রি স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে অনেকগুণ বেড়ে যায়। এর বাইরে ঈদের ছুটিতে পর্যটন খাতেও মানুষ অর্থ ব্যয় করে।
ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ঈদে পোশাকসহ পরিধেয় খাতে ৬০ হাজার থেকে ৭০ হাজার কোটি, জুতা-কসমেটিকস তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার কোটি, ভোগ্য পণ্য সাত হাজার কোটি, জাকাত-ফিতরা ও দান-খয়রাত ৩৮ হাজার কোটি, যাতায়াত বা যোগাযোগ খাতে ১০ হাজার কোটি, সোনা-ডায়মন্ড পাঁচ হাজার কোটি, ভ্রমণ খাতে সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি, ইলেক্ট্রনিক্স চার হাজার কোটি, স্থায়ী সম্পদ ক্রয় এক হাজার কোটি, পবিত্র ওমরাহ পালন তিন হাজার কোটি, আইনশৃঙ্খলাসহ অন্যান্য খাতে লেনদেন হয় আরও এক হাজার কোটি টাকা।
এ ছাড়া করোনা সংকট দূর হওয়ায় এবার রাজনৈতিক দলসহ নানা ধরনের সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন ইফতার পার্টির আয়োজন করছে। এটিও অর্থনীতির জন্য একটি ইতিবাচক দিক। ব্যবসায়ীরা বলছেন, খাদ্যপণ্য, পোশাক, বিনোদন ও পরিবহন খাতে বাড়তি এ অর্থ যোগ হবে। সরকারি চাকরিজীবী, দোকানের কর্মচারী, পোশাক ও বস্ত্র খাতের শ্রমিকসহ বিভিন্ন শ্রেণির শ্রমজীবীদের বোনাসও এ অর্থনৈতিক কর্মকা-ে যোগ হবে।
এদিকে বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির তথ্যমতে, এবার রোজায় অতিরিক্ত এক লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকার লেনদেন যোগ হয়। এর মধ্যে শুধু পোশাকের বাজারে যোগ হয় ৬০ হাজার কোটি টাকা। নিত্যপণ্যের বাজারে কেনাকাটা হয় ২৮ থেকে ৩০ হাজার কোটি টাকা। এর বাইরে ইফতারসামগ্রী বিক্রি হয় সারাদেশে। এখানেও হাজার হাজার কোটি টাকার লেনদেন ও বাণিজ্য হয়ে থাকে। এ ছাড়া আয়ের হিসাবে সাড়ে ১২ লাখ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, বেসরকারি খাতের ৬০ লাখ দোকান কর্মচারী, তৈরি পোশাক ও বস্ত্র খাতের ৭০ লাখ শ্রমিকের বোনাস ঈদ অর্থনীতিতে যোগ হবে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, গত দুবছর ঈদুল ফিতরের উৎসবে করোনার কারণে ফ্যাশন হাউসগুলোর প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে। এবার পরিবেশ খুব ভালো ছিল। বেচাবিক্রি ভালো হয়েছে।
সারাদেশে বিক্রি হওয়া স্থানীয় পোশাকের ৭০-৮০ শতাংশের জোগান দেয় ঢাকার কেরানীগঞ্জসহ বুড়িগঙ্গার তীরবর্তী এলাকার উৎপাদকরা। নিম্ন ও মধ্যবিত্তের পোশাক উৎপাদনের কেন্দ্রস্থল হিসেবে পরিচিত কেরানীগঞ্জের ব্যবসায়ীদের উৎপাদিত পোশাকের ৭০ শতাংশ বিক্রি হয় ঈদুল ফিতরে।
Leave a Reply