২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সাভারের রানা প্লাজা ধসে ১১শ’র বেশি পোশাক শ্রমিকের মৃত্যু হয়। যা শুধু বাংলাদেশের নয়, বিশ্ব-ইতিহাসেরই অন্যতম ভয়াবহ শিল্প-দুর্ঘটনা। আজ রোববার ওই ঘটনার ৯ বছর পূর্ণ হয়েছে। তবে ওই ঘটনায় দায়ের হওয়া হত্যাসহ তিন মামলায় বিচার একচুলও এগোয়নি। মামলাগুলোয় প্রসিকিউশনের সাফল্য শুধু অভিযোগপত্র দাখিল এবং অভিযোগ গঠন।
ছয় বছর আগে অভিযোগ গঠন হলেও হত্যা মামলায় সবেমাত্র বাদীর সাক্ষ্যগ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে। আর ইমারত নির্মাণ আইনের মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু করতে পারেননি আদালত। তবে ইমারত নির্মাণে দুর্নীতির অপর মামলায় সাক্ষ্য চলমান।
এদিকে, মামলা তিনটির ৪২ আসামির মধ্যে একমাত্র ভবনটির মালিক সোহেল রানাই এখন কারাগারে আছেন। অপর আসামিদের মধ্যে সাতজন পলাতক, ৩২ জন জামিনে এবং দুই আসামি মারা গেছেন। অন্যদিকে, তিন মামলার এখনো কোনো সুরাহা না হলেও এ ঘটনার পর রানার বিরুদ্ধে সম্পদের হিসাব দাখিল না করার মামলায় তিনি ২০১৭ সালের ২৮ আগস্ট তিন বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছেন। তার বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনের একটি মামলা এবং শ্রম আদালতে শ্রকিমদের দায়ের করা আরও ১১টি মামলা বিচারাধীন আছে বলে জানা গেছে।
এ ছাড়া অবৈধ সম্পদ অর্জন ও তথ্য গোপনের মামলায় সোহেল রানা মা মোসা. মর্জিনা বেগমের ২০১৮ সালের ২৯ মার্চ ৬ বছরের কারাদণ্ডের রায় দিয়েছেন।
হত্যা মামলা : হত্যা মামলায় ২০১৫ সালের ১ জুন রানা, রানার বাবা-মাসহ ৪১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেন সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার বিজয় কৃষ্ণ কর। এরপর মামলাটির পলাতক আসাসিদের বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট এবং পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তিসহ বিভিন্ন কার্যক্রমের পর ২০১৬ সালের ১৫ মার্চ জেলা ও দায়রা জজ আদালতে বিচারের জন্য আসে। ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ এসএম কুদ্দুস জামান ২০১৬ সালের ১৮ জুলাই আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন। এরপর মামলার বিচারে ৩৯ আসামির মধ্যে শুধু দুজনের পক্ষে উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ দিলে সাক্ষ্যগ্রহণ থেমে ছিল, যা সম্প্রতি খারিজ হলে বিচার প্রক্রিয়া আবার শুরু হয়।
এ সম্পর্কে পাবলিক প্রসিকিউটর শেখ হেমায়েত হোসেন বলেন, দুই আসামির পক্ষে হাইকোর্টের স্থগিত থাকায় সাক্ষ্যগ্রহণ থেমে ছিল। ওই স্থগিতাদেশ সম্প্রতি প্রত্যাহার হওয়ার পর গত ১৬ মার্চ বাদীর সাক্ষ্যগ্রহণ হয়েছে। আগামী ২৯ মে মামলাটিতে পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণের দিন ঠিক আছে।
রাজউকের ইমারত নির্মাণ আইনের মামলা : ইমারত নির্মাণ আইন না মেনে রানা প্লাজা ভবন নির্মাণ করায় ২০১৩ সালের ২৫ এপ্রিল রাজউকের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. হেলাল উদ্দিন ১৩ জনকে আসামি করে সাভার থানায় একটি মামলা করেন। ওই মামলায়ও হত্যা মামলার সঙ্গে ২০১৫ সালের ১ জুন পৃথক একটি অভিযোগপত্র দাখিল করেন সিআইডির একই কর্মকর্তা। তাতে ভবন মালিক সোহেল রানাসহ ১৮ জনকে অভিযুক্ত করা হয়। এই মামলার আসামিদের মধ্যে ১৭ জনই হত্যা মামলার আসামি।
২০১৬ সালের ১৪ জুন ঢাকার অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মোস্তাফিজুর রহমান আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন। অভিযোগ গঠনের পর আসামিদের মধ্যে তিনজন আসামি চার্জ আদেশ বাতিলের জন্য ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ আদালতে পৃথক তিনটি রিভিশন মামলা দায়ের করেন। ওই রিভিশন মামলার মধ্যে দুটি খারিজ হলেও অপর একটি রিভিশন মামলা বিচারাধীন থাকায় মামলাটিতে এখনো সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু করতে পারেনি আদালত।
এ সম্পর্কে ওই আদালতের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর আনোয়ারুল কবির বাবুল বলেন, ‘আমরা সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য প্রস্তুত। কিন্তু জেলা ও দায়রা জজ আদালতে রিভিশন বিচারাধীন থাকায় আদালত সাক্ষ্যগ্রহণ করতে পারছেন না।’
ইমারত নির্মাণে দুর্নীতির মামলা : রানা প্লাজা ভবন ছয়তলা পর্যন্ত নির্মাণের অনুমোদন থাকলেও নিমার্ণ করা হয় ৯ তলা। ভবন নির্মাণে দুর্নীতি করায় ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারা ও দণ্ডবিধির ১০৯ ধারায় সাভার থানায় ২০১৩ সালের ১৫ জুন মামলাটি করে দুদক। মামলায় রানাসহ ১৮ জনের বিরুদ্ধে প্রথম দফায় ২০১৪ সালের ১৬ জুলাই এবং দ্বিতীয় দফায় ২০১৭ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি অভিযোগপত্র দাখিল করেন তদন্ত কর্মকর্তা দুদকের উপ-পরিচালক মফিদুল ইসলাম। পরবর্তীতে মামলাটিতে ঢাকার বিভাগীয় বিশেষ জজ এম আতোয়ার রহমান ২০১৭ সালের ২১ মে অভিযোগ গঠন করেন।
এ মামলা প্রসঙ্গে দুদকের প্রসিকিউটর মোশারফ হোসেন কাজল বলেন, ‘মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ চলমান। আশা করি অপর সাক্ষীদের সাক্ষ্য নিয়ে দ্রুত মামলাটির বিচার শেষ করতে পারব।’
তিন মামলার আসামিদের অবস্থান : তিন মামলা মিলে মোট আসামি ছিল ৪২ জন। যার মধ্যে সাতজন এখনো পলাতক রয়েছেন। তারা হলেন, সাভার পৌরসভার সাবেক সহকারী প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমান, সাভার পৌরসভার নগর পরিকল্পনাবিদ ফারজানা ইসলাম, নান্টু কন্ট্রাকটার, মনোয়ার হোসেন বিপ্লব, রেজাউল ইসলাম, নয়ন মিয়া ও সফিকুল ইসলাম। অন্যদিকে, কারাগারে রয়েছেন শুধু ভবন মালিক সোহেল রানা। আসামি আবু বকর সিদ্দিক এবং মো. আবুল হাসান মারা গেছেন। অপর ৩২ জন আসামি জামিনে আছেন।
তারা হলেন, প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম, সাইট ইঞ্জিানয়ার মো. সারোয়ার কামাল ও ইমারত পরিদর্শক মো. আওলাদ হোসেন, ভবন মালিক সোহেল রানার বাবা আব্দুল খালেক ওরফে কুলু খালেক, সাভার পৌর মেয়র রেফাত উল্লাহ, কাউন্সিলর মোহাম্মাদ আলী খান, উপ-সহকারী প্রকৌশলী রাকিবুল হাসান রাসেল, নিউওয়েব বাটন লিমিটেডের চেয়ারম্যান বজলুস সামাদ আদনান, নিউওয়েব স্টাইপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহমুদুর রহমান তাপস, ইতার টেক্সটাইলের চেয়ারম্যান আনিসুর রহমান ওরফে আনিসুজ্জামান, আমিনুল ইসলাম, মো. মধু, অনিল দাস, মো. শাহ আলম ওরফে মিঠু, সাভার পৌরসভার প্রধান নির্বাহী কমকর্তা উত্তম কুমার রায়, সোহেল রানার মা মর্জিনা বেগম, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শনের সাবেক উপ-প্রধান পরিদর্শক মো. আব্দুস সামাদ, উপ-প্রধান পরিদর্শক বেলায়েত হোসেন, পরিদর্শক প্রকৌশল মো. ইউসুফ আলী, পরিদর্শক প্রকৌশল মো. মহিদুল ইসলাম, ইতার টেক্সটাইলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জান্নাতুল ফেরদৌস, মনোয়ার হোসেন বিপ্লব, মো. আতাউর রহমান, মো. আব্দুস সালাম, বিদ্যুৎ মিয়া, সৈয়দ শফিকুল ইসলাম জনি, মো. আব্দুল হামিদ, আব্দুল মজিদ, মো. আমিনুল ইসলাম, মো. ইউসুফ আলী ও মাহবুল আলম।
রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় ১ হাজার ১১৭ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়। পরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরও ১৯ জন মারা যায়। সে হিসেবে নিহত হয় ১ হাজার ১৩৬ জন। অন্যদিকে, আহত হয় ১ হাজার ১৭০ জন। গুরুতর আহত হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করে ৭৮ জন।
Leave a Reply