আমাদের দেশে প্রাপ্তবয়স্ক লোকের প্রায় ৮-১০ শতাংশ ডায়াবেটিস রোগে আক্রান্ত। হিসাবে প্রায় ৭০ লাখ ডায়াবেটিস রোগী। নানা রকমের থাইরয়েড রোগীর সঠিক পরিসংখান না থাকলেও ধারণা করা যায় এরূপ রোগীর সংখ্যাও প্রায় কোটির কাছাকাছি হবে। এ ছাড়া রয়েছে অপেক্ষাকৃত বিরল হরমোনজনিত রোগী যেমন- এডিসন ডিজিস, কুশিং ডিজিস, ডায়াবেটিস ইনসিপিডাস, পিটুইটারি গ্রন্থির নানা রোগ, মেয়েদের ডিম্বাশয় বা ওভারির হরমোনজনিত রোগ, পুরুষদের টেস্টিস গ্রন্থির রোগ ইত্যাদি। সব মিলিয়ে এত সংখ্যা যে প্রায় প্রতি পরিবারেই দু-একজন হরমোনজনিত রোগী আছে। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ আমাদের দেশে প্রায় সব প্রাপ্তবয়স্ক লোকই রমজান মাসে রোজা রাখেন। এ সময় হরমোনজনিত রোগীদের চিকিৎসায় কিছু সাবধানতা, পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের প্রয়োজন হয়। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে লাখ লাখ হরমোনজনিত রোগীর চিকিৎসাবিষয়ক পরামর্শ হরমোনবিশেষজ্ঞ ছাড়াও অন্যান্য চিকিৎসকের উপরও বর্তায়। আবার এই একমাস সময়ে প্রায় লক্ষাধিক নতুন রোগীকে প্রথমবারের মতো রোগ শনাক্ত করার প্রয়োজন হয়। সব মিলিয়ে রমজানে হরমোনজনিত রোগের চিকিৎসা ও রোগ নির্ণয়ের বিষয়টি ব্যাপক। রোগী ও চিকিৎসকদের মাঝে এ ব্যাপারে আগে থেকেই যথেষ্ট সচেতনতা ও পরিকল্পনা থাকা প্রয়োজন। অতীতে রোজার সময় চিকিৎসাবিষয়ক পরামর্শ জানা ও মানার ব্যাপারে অনেক বিতর্ক ছিল, আজো আছে এবং চিকিৎসাবিজ্ঞানের আরো উন্নতি হলে ভবিষ্যতে তা কমে যাবে আশা করা যায়।
রমজানের সময় ডায়াবেটিস চিকিৎসা নিয়ে জনসচেতনতামূলক অনেক প্রোগ্রাম হওয়ার রেওয়াজ অনেক আগে থেকেই রয়েছে। এ ব্যাপারে রোগী ও চিকিৎসকদের মাঝে ডায়াবেটিসের ব্যাপারে যতটা আগ্রহ দেখা যায় অনান্য হরমোনজনিত রোগের ব্যাপারে ততটা দেখা যায় না। কাজেই ডায়াবেটিসের ব্যাপারে আলোচনা সংক্ষিপ্ত করে অন্যান্য হরমোনজনিত রোগের বিষয়টিকেই প্রাধান্য দেয়া হলো।
রমজানে ডায়াবেটিস রোগীদের প্রথম করণীয় হলো রোজা শুরুর বেশ আগেই চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নেয়া, রোজা থাকা ঠিক হবে কি না বা রোজা থাকার স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি কতটুকু- এসব জেনে নেয়া। ডায়াবেটিস রোগীদের ৯০ শতাংশই টাইপ-২ ডায়াবেটিস রোগী। এদের মধ্যে যাদের রক্তের গ্লুকোজ শুধু খাদ্য নিয়ন্ত্রণ, মেটফরমিন ও গ্লিপটিন জাতীয় ওষুধ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত থাকে এবং অন্য কোনো সিস্টেমের মারাত্মক সমস্যা নেই তাদের রোজা থাকায় তেমন কোনো ঝুঁকি নেই।
সাধারণভাবে বলা যায়, রোজা শুরু হওয়ার তিন মাস আগে থেকে কোনো রোগীকে যদি ডায়াবেটিসজনিত জটিলতার জন্য হাসপাতালে ভর্তি হতে হয় তবে রোজা থাকার ব্যাপারে স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি বেশি। গর্ভবতী ও শিশুকে দুধ পান করান এমন মহিলা, বারবার রক্তে গ্লুকোজ কমে যাওয়ার প্রবণতা, কিডনির কার্যকারিতা অনেক কমে গেছে এমন ডায়াবেটিস রোগী, বেশির ভাগ সময় ডায়াবেটিস অনিয়ন্ত্রিত থাকা, রক্তে গ্লুকোজ কমে গেলে বুঝতে পারে না এমন রোগী, হার্ট বা লিভার ফেইলুর এবং টাইপ-১ ডায়াবেটিস রোগীদেরও রোজা থাকার স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি অনেক বেশি। এসব ডায়াবেটিস রোগীকে চিকিৎসকরা রোজা থাকার স্বাস্থ্যগত ঝুঁকির কারণে রোজা না থাকতেই বলা হয়। আবার এই দুই গ্রুপের মাঝামাঝি ডায়াবেটিস রোগীদের রোজা থাকার স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি চিকিৎসকের পরামর্শের ভিত্তিতে নির্ণয় করা প্রয়োজন।
রোজার সময় সাধারণত অন্যান্য সময়ের সকালের ওষুধ ইফতারির সময় ও বিকেল এবং রাতের ওষুধ সাহরির সময় সেবন করতে হয়। দিনের যে দীর্ঘ সময় না খেয়ে থাকতে হয় সে সময় রক্তের গ্লুকোজ যাতে অনেক কমে না যায় সে জন্য সাহরির সময় ডায়াবেটিসের ওষুধ বিশেষ করে ইনসুলিনের পরিমাণ ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ কম করে সেবন করতে হয়। কোন ওষুধ ব্যবহার করা অধিক সঙ্গত তা চিকিৎসকের কাছ থেকে জেনে নেয়া উচিত। ইফতারির সময় একবারে অনেক খাবার গ্রহণ না করে পরিমিত খাবার গ্রহণ করতে হবে। মিষ্টি জাতীয় শর্করার চেয়ে আশযুক্ত ও মিষ্টি নয় এমন শর্করা যেমন- ভাত, রুটি ইত্যাদি খাবার গ্রহণ বাঞ্ছনীয়। দিনের ভাগে অতিরিক্ত ব্যায়াম না করে রাতের কোনো এক সময়ে হাঁটাহাঁটি করাই সঙ্গত। পরিপূর্ণ ধারণার অভাবে চিকিৎসকদের মাঝে ওষুধের ব্যাপারে কিছুটা মতানৈক্য থাকলেও চিকিৎসকের পরামর্শই রোগীর মেনে চলা উচিত। রোজার সময় অন্তত ইফতারির আগে ও পরে সাহরির আগে, সকালে ও বিকেলে গ্লুকোমিটার দিয়ে রক্তের গ্লুকোজ মেপে ডায়াবেটিক চার্ট তৈরি করা যাবে।
হরমোনজনিত অন্যান্য রোগের নামের সাথে সর্বসাধারণের পরিচিতি কম থাকাই স্বাভাবিক তবে রোগী ও চিকিৎসাসংশ্লিষ্ট অনেকেই নামগুলো বুঝতে পারবেন ।
হরমোনজনিত রোগগুলোর মধ্যে রোজা পালনে অত্যধিক ঝুঁকিপূর্ণ রোগ যেমন- থাইরটক্সিক ক্রাইসিস, ইনসুলিনমা, এডিসন ক্রাইসিস, অতিমাত্রার হাইপোথাইরয়েডিসম, টিটানি, পিটুইটারি গ্রন্থির আকস্মিক কার্যকারিতা লোপ, এডরেনাল টিউমারজনিত উচ্চ রক্তচাপ ইত্যাদি ক্ষেত্রে রোজা পালন অত্যধিক ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় ঝুঁকিমুক্ত না হওয়া পর্যন্ত রোজা না রাখাই যুক্তিসঙ্গত। আবার সুনিয়ন্ত্রিত হাইপোথাইরয়েডিসম ও সঠিকভাবে শনাক্তকৃত ও চিকিৎসা পাওয়া থাইরয়েডের অন্যান্য রোগ, হাড়ক্ষয়জনিত রোগী, হরমোনের কারণে অবাঞ্ছিত লোম, অতিরিক্ত ওজন, সাধারণ গলগণ্ড ইত্যাদি রোগীর রোজা থাকায় তেমন কোনো ঝুঁকি না থাকায় শুধু চিকিৎসকের পরামর্শানুযায়ী ওষুধের মাত্রা ও সেবনের সঠিক সময় ঠিক করে রোজা পালন করা যাবে।
থাইরয়েড হরমোনের আধিক্যে থাইরটক্সিকসিস নামক রোগী চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে রোজা পালন করতে পারবেন। এ ক্ষেত্রে চিকিৎসক ওষুধের মাত্রা ও সেবনের সময় বিচক্ষণতার সাথে নির্ধারণ করবেন। হরমোন ও মেটাবলিক কারণে অনেক বিরল রোগ সম্পর্কে সাধারণ রোগী ও সাধারণ চিকিৎসকের সচেতনতার যুক্তিসঙ্গত ঘাটতি থাকার সম্ভাবনা থাকে। তাই রমজানের আগে থেকেই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করা উচিত। থাইরয়েড গ্রন্থির রোগ নির্ণয়ে ও চিকিৎসায় প্রায়ই প্যাথলজি, সার্জারি, রেডিওলজি, অনকোলজি ও নিউক্লিয়ার মেডিসিনসহ অনেক বিভাগের সহযোগিতার প্রয়োজন হয়। রমজানে এসব বিভাগের সাথে সমন্বয় করে থাইরয়েড রোগীর চিকিৎসা দেয়া প্রয়োজন ।
থাইরটক্সিকসিস রোগ নির্ণয়ের প্রথমদিকে সপ্তাহখানেক রোজা না রাখাই ভালো। চিকিৎসা গ্রহণ করে অনেকটা সুস্থ হলে রোজা রাখা যেতে পারে তবে ওষুধে কিছুটা পরিবর্তন করতে হবে।
হাইপোথাইরয়েড রোগীদের মূল ওষুধ থাইরক্সিন ইফতার ও সাহরির মাঝামাঝি সময়ে সেবন করা ভালো। রোজার সময় মানবদেহে থাইরয়েড হরমোনের যে পরিবর্তন হয় তার কোনো স্বাস্থ্যগত প্রভাব আছে কি না তা নির্ধারণ করা যায়নি, আরো গবেষণা প্রয়োজন।
যেসব রোগী এডরেনাল গ্ল্যান্ডের রোগের জন্য করটিসল জাতীয় হরমোন বা স্টেরয়েড গ্রহণ করে থাকেন তারা রোজা রাখলে বিকেল বেলায় হাইপোটেনসন, হাইপোগ্লাইসেমিয়াসহ শারীরিক সমস্যায় পড়তে পারেন। এ জন্য সাহরির সময় দীর্ঘ সময় কাজ করে এরূপ স্টেরয়েড গ্রহণ করা যায়।
রোজায় পিটুইটারি হরমোনের কিছুটা পরিবর্তন হলেও যারা পিটুইটারি ফেইলুরের জন্য ওষুধ সেবন করেন তার পরিমাণ অপরিবর্তিত রেখে ইফতারি ও সাহরির মাঝামাঝি সময়ে ওষুধ সেবন করে ঝুঁকিমুক্তভাবেই রোজা পালন করতে পারবেন।
যারা ইনসুলিনমা নামক রোগে বারবার রক্তে গ্লুকোজ কমে যাওয়ার মতো রোগে আক্রান্ত তাদের রোজা থাকা ঠিক তো নয়ই বরং কখনো রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা কমে যাওয়ার সাথে সাথে মিষ্টিজাতীয় কোনো খাবার খেয়ে ঝুঁকিমুক্ত হতে হবে।
কোন হরমোনজাতীয় রোগে কী করা প্রয়োজন তা রোজা শুরুর বেশ আগেই চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করে জেনে নেয়া উচিত। উল্লেখ্য, কিছু সংখ্যক সরকারি মেডিক্যাল কলেজ ছাড়া হরমোনজনিত রোগের বিশেষজ্ঞ দেশের সর্বত্র পর্যাপ্ত সংখ্যক না থাকায় বিশেষজ্ঞ পরামর্শ গ্রহণে কিছুটা অসুবিধা হতে পারে। নিকটস্থ অভিজ্ঞ মেডিসিন বিশেষজ্ঞরা এ ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারেন।
বিভাগীয় প্রধান, এন্ডোক্রাইনোলজি,
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ
Leave a Reply